বইটি প্রথম হাতে পাই আমার এক
সাহিত্যপ্রেমী বান্ধবী শুভেচ্ছা ভট্টাচার্যের কাছ থেকে , উপহার হিসেবে । চার
ফর্মার সুন্দর হার্ড কভার । কাব্যগ্রন্থের নাম ' সম্পর্ক '
, কবি রঞ্জন আচার্য । প্রকাশনা পুরুলিয়ার নাটমন্দির ।
কাব্যগ্রন্থটি জুড়ে মোট ৬০ টি কবিতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে সিরিজ আকারে । প্রতিটি
কবিতাই এক-একটি মাইলস্টোন , যেন বেরিয়ে আসতে চায় ছাপা
অক্ষর থেকে , যেন কবিতাগুলি নিভৃতে হাত বোলাতে থাকে
পাঠকের মাথায় । সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং একটি সম্ভবনাময় সম্পর্কের অহেতুক সমাপতন
এই গ্রন্থের বিষয়বস্তু হলেও লেখক এর পাশাপশি বহু সামাজিক দিকেও আলোকপাত করেছেন একই
সাথে । এবং এই দুইয়ের মিশেলে এটি হয়ে উঠেছে একটি জীবন্ত দলিল , মুহূর্তের ফ্ল্যাশব্যাক । যা নাড়া দিয়ে গেছে পাঠক হৃদয়কে , সহজ অভিব্যক্তি পেয়েছে বিচ্ছুরণ ।
কবি তাঁর
প্রথম কবিতাতেই বলেছেন -
'' সে এক হাস্যকর অধ্যায়
যখন বোকার মতো
বিশ্বাস করতাম
দুজনেই বকর
বকর করে যাব আজীবন
আর এসএমএস
ছুড়ে যাব গভীর রাত পর্যন্ত
আজ দুজনের
হাতে দুটো মোবাইল
নেটওয়ার্ক নেই
, নট রিচেবল
পরিস্থিতি
শাসন করছে আমাদের
আমরা বোবা হয়ে
দেখছি
হাওয়ায় দুলছে
সম্পর্কের খোলস... '' ( ১ )
এ বিচ্ছেদ
কেবলই সাদামাটা বিচ্ছেদ নয় এ যেন অন্তঃস্থলকে নাড়িয়ে দেয় এমনই তার ক্ষমতা । কবির
সহজ স্বীকারোক্তি , '' আজও তাই মনে করি / প্রতিটা
সম্পর্কের গায়ে চেটানো থাকে এক্সপায়ারি ডেট '' ( ৫ ) । এই
বস্তুবাদী দুনিয়ায় যেখানে কি পেলাম আর কি হারালাম এই নিয়েই যখন সবাই মশগুল ,
সেখানে কবি বলেন আদর্শবাদী হওয়ার কথা । তিনি বলেছেন , '' আমাদের কথা শেষ হয়ে গিয়েছে / শেষ হয়ে গিয়েছে ভেতরের
বিশ্বাস '' ( ৭ ) । তাঁর ভালোবাসার মানুষটি তাঁর জীবন
জুড়ে কীভাবে ছাপ রেখে গেছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় পুরো গ্রন্থটি জুড়ে - '' দিনগুলো অতীত হয়ে গেছে / অতীত হয়ে গেছে সেইসব দিনগুলো / নিঃশব্দে থেমে
গেছে সম্পর্কের ম্যাজিক / এখন আর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামলেও / কিছুতেই মনে পড়ে না
তোমার মুখ / অথচ এই দুটো মুখ একদিন / বর্ষা নামলেই ছটফট করত মুখোমুখি বসে থাকার
জন্য / কেউ কোন কথা বলতাম না / শুধু তাকিয়ে থাকতাম / আর সিগারেট ফুঁকে যেতাম হু হু
করে '' ( ২০ ) । যখনই একের পর এক পাতা উল্টেছি তখনই মনে
হয়েছে এতো আমারই আখ্যান , আবেগ এসে ছুঁয়েছে আঙুল ,
ক্রমশ শান্ত করেছে চারপাশ । ঠিক তখনই কবি লিখেছেন , '' কী আর করা যায় / এসবের মাঝেই যেটুকু আকাশ / তুমি তার নীচে হাসি হাসি
মুখ করে দাঁড়াও / এসো তোমার একটা ছবি তুলে দিই ... '' ( ২৩
) ।
আসলে সমগ্র
কাব্যগ্রন্থটি জুড়ে এমন সব হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া অভিব্যক্তি রয়েছে যে তারপর যেকোন
আলোচনাই ক্লিশে মনে হয় । তাই কয়েকটি লাইন মুগ্ধতা স্বরূপ এখানে উল্লেখ করলাম , '' বুকের পাঁজরে বসে শিস দেয় সম্পর্কের পাখি / পালকে
প্রাচীন রক্ত চোখে মুখে বুজে আসা স্রোত '' ( ২৭ ) ,
'' এরপরও সম্পর্ক বেঁচে থাকলে / লোকে হাসত / যাচ্ছেতাই বলত লোকে
/ তাই তোমাকে তোমারটা বুঝিয়ে / অন্ধকারে মিলিয়ে গিয়েছি ( ৩১ ) , '' তুমি চালাক ও চঞ্চল / জানো কীভাবে পালিয়ে যেতে হয় / ছোট্ট ডজে ছিটকে
দিতে হয় / অলাভজনক সম্পর্ক '' ( ৩৪ ) , '' যা সব ভেবেছিল সকলে / তা যদি সত্যি সত্যিই ঘটে যেত / দুজনেই বুড়ো হয়ে
যেতাম এতদিন '' ( ৫৯ ) । আরো এমন অজস্র টানটান অক্ষরে ভরে
রয়েছে গ্রন্থটি ।
আমাদের কবি
সহজ কথা সহজ করে বলতে জানেন , এ নিয়ে তাঁর কোন কম্পালসন নেই । এবং এজন্যেই দূরবর্তী ল্যান্ডস্কেপের
পাঠক স্বত্তাকে তিনি সহজেই ছুঁয়ে যান , আর আমাদের এই
বাউন্ডুলে জীবনের জন্য রেখে জান বাঁচার রসদ । সবশেষে বলা যায় মেদহীন , স্লিম এই বইটি নিবিড় পাঠের দাবী রাখে । জিশান রায়ের করা প্রচ্ছদটিও
অসাধারণ । বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় নভেম্বর , ২০১৬ তে ।
' সম্পর্ক '
রঞ্জন আচার্য
নাটমন্দির , ৮০ টাকা
প্রচ্ছদ -
জিশান রায়
কবির অন্যান্য
বই :-
কঠোরভাবে
প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ( ২০০০ )
আত্মার
ট্রিগার ( ২০১২ )
বইটি বর্তমানে out of print. যদি hard copy বা সফট কপি পাওয়া যায়।
ReplyDelete