ওপাশে ঝরনা রঙের
বউঠাকুরানির হাট
আর মনের মধ্যে
সবটুকু দ্বিধা নিয়ে
বাগান করছেন
বৃদ্ধ বাঞ্ছারাম-
যাঁর উত্তরপুরুষ
আজ চানাচুরের
দোকান খুলে বসে আছে রাস্তার ওধারে।
উপরের
পাঁচটি লাইন যদি কোনো ধাঁধার সমাধান সূত্র
হয় এবং আপনাকে প্রশ্ন করা হয় বলুন তো ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া কোন সিনেমা হলের উজ্জ্বল
স্মৃতি,
আপনার মনের মণিকোঠায় উঁকি দিচ্ছে?
আপনি চট্ করে বলে দেবেন...
হ্যাঁ ঠিক,
বলেও দিয়েছেন -"উজ্জ্বলা"! কী কোরে বললেন! আমি
বলছি ,
আমারই মতো আপনারও স্মৃতির পাঁজরে ,জাস্ট আলতো একটু খোঁচা দেওয়া হয়েছে। যা উসকে দিয়েছে আস্ত উবে যাওয়া একটি ছায়ামহলের ঝলমলে উজ্জ্বল
স্মৃতি।
যার অদৃশ্য ছায়াকে , রাস্তার উল্টো ফুটে দাঁড় করিয়ে রেখে, মুচমুচে সুস্বাদু এক চানাচুরের দোকান , তার খাস্তা হলুদ পাপড়ি গুলির উপরে,
অসংখ্য ছায়াছবির বর্ণময় স্মৃতির মতো,
গিজগিজে লাল চিনাবাদাম ছড়িয়ে, গরম গরম বিক্রি করছে , ব্রাউন পেপারের তেলতেলে ঠোঙায়...
এরকমই অজস্র
স্মৃতি বিস্মৃতির লুকোচুরি খেলা বুকে নিয়ে, সদ্য "একশো আশি ডিগ্রি" থেকে
প্রকাশ পেয়েছে রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের নতুন কাব্যগ্রন্থ,"কলকাতার ছায়ামহল"।কাব্যগ্রন্থটি
নতুন,
কিন্তু তার
কবিতাগুলি, লিপিনাগরিক পত্রিকার পুরোনো একটি সংখ্যায়,
এক রাশ ভালোবাসা মেখে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিলো।তাও আবার
বেশ কয়েক বছর ধরে।
খবরটা আগেই ছিলো,
তাই কলকাতা বই মেলার দ্বিতীয় দিনে,
লিটিল ম্যাগ প্যাভিলিয়নে ছুট্টে গিয়ে,
একশো আশি ডিগ্রি-র টেবিল থেকে ছোঁ মেরে তুলে নিয়েছিলাম রোগা
পাতলা হালকা হলুদ রঙের বইটিকে।তখন কি আর জানতাম এত এত মনকেমন লুকিয়ে আছে বইটির
মধ্যে!
আসলে এটি একটি
মনখারাপ করা মেদুর স্মৃতি কাব্য। যা সারা কলকাতার বুক থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে
যাওয়া সিঙ্গল-স্ক্রিন সিনেমা হল , কিম্বা ভূতুরে বাড়ির মতো নিষ্প্রাণ দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামহলগুলির
সেই সব সুখ স্মৃতি, যাদের আলোছায়া ঘেঁটে ঘেঁটে কবি রজতেন্দ্র সৃষ্টি করেছেন
অতুলনীয় এক মায়া কাব্য।যার আনাচে কানাচে লুকিয়ে আছে অজস্র কালজয়ী ছায়াছবির নাম ,তাদের কলা কুশলী ও তাদের নিয়ে কল্পনার এক অদ্ভুত স্বপ্ন আবহ,
যার ফ্লেভর একেবারেই অন্য রকম । আবার সেই ফ্লেভরই কবির মনকে
উতলা কোরেছে , যখন তার স্মৃতি ভাণ্ডার থেকে ভেসে উঠেছে সেই সব ছায়ামহলের কোল ঘেঁষে থাকা
ক্যান্টিনগুলির এগ-ডেভিল বা কুচোচিংড়ি দিয়ে তৈরি করা চপ কাটলেটের লোভনীয় সুগন্ধ।
যারা ছায়ামহলগুলির সাথে হাত ধরাধরি কোরে,প্রকৃত বন্ধুর মতই একদিন ঝাঁপ দিয়েছে, বিস্মৃতির অতল গঙ্গায়
।
রূপবাণী সিনেমা
হলের উদ্দেশ্যে লেখা কবিতায় রজত লিখছেন-
“প্রথম যেদিন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি দেখেছিলাম / সেদিন থেকে সব মেয়েকেই তনুজা বলে
মনে হত”।
ঠিক, তখন তো আমরা কত কত নায়িকার প্রেমে পড়ছি।খুব স্বাভাবিক ফিলিংস।কিন্তু লক্ষণীয়
রজতেন্দ্র তার যৌবনের কোনো অভিনেত্রীর রূপে মুগ্ধ হওয়ার কথা বলছেন না,
বরং তার বয়সের অনুপাতে, জন্মের প্রায় বছর পাঁচ ছয়েক আগের,
মুক্তি পাওয়া একটি ছায়াছবির নায়িকা তনুজা-র কথা বলছেন।যার রূপে
মুগ্ধ হয়ে, ঘোর লাগা এক স্বপ্ন তাড়িতের মতো,তাকে খুঁজে ফিরছেন চার পাশে হেঁটে-চোলে
বেড়ানো বাস্তবের-সুন্দরীদের মধ্যে।ধরেই নিলাম এই সিঙ্গল-স্ক্রিন
সিনেমা হলটির স্মৃতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে তার প্রথম দেখা অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি ও তার নায়িকার
রূপে মুগ্ধ হওয়ার স্মৃতি, যা আসলে ঝাঁ চকচকে মাল্টিপ্লেক্স আর মাল্টিমিডিয়ার দারুণ
উন্নতির যুগে ঝকঝকে কোরে তোলা নায়িকাদের তুলনায় অনেক বেশী স্বাভাবিক অনেক বেশী আকর্ষণীয়।কিন্তু তার
পরেই তাদের বাবাদের উদ্দেশ্যে যে লাইনটি লিখছেন – “আর তাদের বাবাদের/ সন্ধে হয়ে আসা আমাজন জঙ্গলের নিঃসঙ্গ হর্নবিল”।তখন কিন্তু
আমাদের সাধারণ অনুভূতি বা আবেগের সঙ্গে একেবারেই মিলছেনা লাইনটি।কারণ সত্যিই
কি কোনো যুবক, যৌবনে তার প্রেমে পড়ার যোগ্যা কোনো সম্ভাব্য প্রেমিকার, রক্ষণশীল
পিতাকে এমন সহানুভূতির চোখে দেখেছে কোনোদিন। এখানেই কবির কেরিশমা, একটি চিরকালীন মুগ্ধতাকে পৌঁছে
দেওয়া অন্য এক গোলার্ধে।
শ্রী সিনেমার
স্মৃতি রোমন্থনে যে কবিতা, তাতে লিখছেন-
“শুধু পুকুরপাড়ে মিঠাইওয়ালার হেঁটে যাওয়ার দৃশ্যটির সঙ্গে/ক্যামেরাম্যান সুব্রত
মিত্র সেতার বাজিয়েছিলেন”।এ যেন রবিশঙ্করের
প্রতিভার সঙ্গে অদল বদল হলো সুব্রত মিত্রের প্রতিভার।শুধু যন্ত্রগুলোই যা এক রইলো।একজন
ক্যামেরাম্যানও যে তার চোখ দিয়ে ক্যামেরার বুকে আঙ্গুল ছুঁইয়ে সৃষ্টি কোরতে পারেন
সঙ্গীতের মূর্ছনা, তা সুব্রত মিত্র কোরে দেখিয়েছিলেন পথের পাঁচালী-তে।কবিতার এই
লাইনটির হাত ধরে যদি সত্যিই আমরা ফিরে যাই সেই দৃশ্যটির কাছে তাহলে দেখবো এক স্থূলকায়
মিঠাইওয়ালা এক মনোমুগ্ধকর দুলকি চালে হেঁটে চলেছে।আর তার
সঙ্গে সঙ্গতি রেখে রবিশঙ্করের অতুলনীয় আবহ সঙ্গীতের তালে তাল মিলিয়ে মিঠাইয়ের
হাঁড়িগুলিও নেচে নেচে এগিয়ে চলেছে ।যা ঠিক হ্যামলীনের বাঁশিওয়ালার মতই আকর্ষণ করছে
অপু আর দুর্গাকে।এই সমগ্র চলমান সঙ্গীত ও ছন্দের যুগলবন্দীটিকে ক্যামেরাম্যান
সুব্রত মিত্র আলতো করে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন
পাশের এক নিঝুম পুকুরের জলে।
মিনার্ভা
প্রসঙ্গের কবিতায় এসে, রজতেন্দ্র-র ভাবনা আমাদের চমকে দিয়েছে–
“শোলে থেকে গব্বর সিং আর
সোনারকেল্লা থেকে মন্দার বোস/ আলাদা আলাদাভাবে ঢুকে পড়লেন পুরনো নিজামে।.... দু'জনেই অর্ডার দিলেন কাবাব ও পরোটা... আর হ্যাঁ,
দু’জনেই বাঁ-দিকের চোয়ালটি/চিবোনোর কাজে ব্যবহার করছিলেন বেশি।...”, নাইবা ব্যাখ্যা কোরলাম , শুধু লক্ষ্য করুন শেষের দিকের একটি লাইন –
“অথচ দু'জনের কেউই জানেন না/এ হল-এর প্রজেক্টর মেশিনটি দীর্ঘদিন
একাহাতে চালিয়েছেন ভবানীপুরের সাতকড়িবাবু”। কাকতালীয় কিনা জানিনা একাহাতে শব্দটির সঙ্গে কোথায় যেন একহাত,আর একহাত শব্দটির
সঙ্গে একেবারে হাত বিহীন-যেন শোলের ঠাকুরের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আবার সেই ভাবনার ঝলকটাই
তাসের ঘরের মতো জাস্ট টোকা খেয়ে ভেঙ্গে পড়ছে,যখন লিখে বসছেন - সাতকড়িবাবুর সেই
প্রজেক্টর মেশিনের আলো থেকেই জন্ম নিয়েছিলেন আমাদের উত্তমকুমার।
ব্র্যাভো রজতেন্দ্র
ব্র্যাভো আপনার কবিতা আমাদের রোজকার খাদ্য তালিকায় যেন অন্য কোনো নতুন পদের আস্বাদ
যোগায় যা আপনার ম্যাজিক কবিতা, বাজার করিবার সহজ উপায়, কুমির, কিম্বা কাপালিকমালার মতো কাব্যগ্রন্থে আগেও
পেয়েছি।এ বই তার ব্যতিক্রম নয়।অথচ প্রত্যেকেই নিজের নিজের মতো করে এক একটি অনন্য
সৃষ্টি।
মোট পঁচিশটি
সিনেমা হল নিয়ে লেখা পঁচিশটি কবিতা রয়েছে এই বইটিতে।শেষের পাতায় রজতেন্দ্র
লিখছেন-মাত্র পঁচিশটি লিখে থামলাম বটে কিন্তু থামাটা উচিত ছিল না।আরও অন্তত
পঞ্চাশটি বন্ধ হয়ে যাওয়া ছায়ামহলের নাম আমি এক নিঃশ্বাসে বলতে পারি।কিন্তু লিখতে
লিখতে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি হচ্ছিল...বোঝাই যাচ্ছে কতটা কষ্ট নিয়ে লেখা এই কবিতাগুলি,
যা প্রায় প্রিয়জন হারানর বেদনার মতই সত্য...
বইটির ব্যাক
কভারে কবির ছবি সহ বাল্বটি বেশ অভিনব, যেন কোনো সংবাদ পত্রের পাত্র-পাত্রী পাতায়, কোনো
এক পাত্রের বিজ্ঞাপন পড়ছি।আর পাত্রটি হলেন স্বয়ং কবি
রজতেন্দ্র।বইটির প্রচ্ছদ পরিকল্পনা কবি কৃত।আকারে ইঙ্গিতে এই অন্য ধারার
কাব্যগ্রন্থটিকে কিছুতেই হাতছাড়া করা যাচ্ছেনা,ঘুরে ফিরে বার বার ঢুকে পড়তে ইচ্ছে
করছে,আলোছায়া মাখা অন্ধকার সেই হলগুলিতে।যাদের ভাঙ্গা সিটের নড়বড়ে হাতলে ভর দিয়ে,ডুবে
যেতে সেই ধূসর প্রাচীন আটপৌরে কলকাতায়।
আশাকরি আগ্রহী
কবিতা প্রেমীরা নিশ্চয়ই খোঁজ করবেন এই কাব্যগ্রন্থের।তাদের সুবিধার্থে একশো আশি
ডিগ্রি-র ফোন নাম্বারগুলি নিচে দিয়ে দিলাম, নোট করুন-৮২৯৬৯৩২০২১ / ৮৯৮১০৭৯৯৬৮ ।
কলকাতার ছায়ামহল
রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
প্রচ্ছদঃ রজতেন্দ্র মুখোপাধ্যায়
প্রকাশকঃ একশো
আশি ডিগ্রি
৮২৯৬৯৩২০২১ /
৮৯৮১০৭৯৯৬৮
ই-মেল ekshoashidegree@gmail.com
দামঃ ৬৫.০০
No comments:
Post a Comment