হঠাৎ জ্বলে
ওঠা শান্ত
একটা দীপশিখা
কবিতার ভিতর আমি বয়ে
যেতে দেখি,
আর তার
দাহবোধ আমি
খোঁজার চেষ্টা
করি স্রষ্টার
মনের ভিতর। শীত পেরিয়ে বসন্তের
অভিমুখে এমনই
একটা শিমূল-রেখা আমার
চেতনার ভিতর
ফুটিয়ে তুললেন তরুণ
কবি তৃষা
চক্রবর্তী'র
সদ্যপ্রকাশিত ' লিপি
ছাড়া ক্ষত
কিছু আছে?
' কাব্যগ্রন্থটি।
শীত পেরিয়ে
বসন্ত আসছে,
কুয়াশার রঙ
জমতে জমতে
যেন পলাশের
আভায় ফুটে
উঠছে বাংলাদেশ,
তেমনই তরুণ
কবির কুয়াশা
তার চেতনার আধো-অন্ধকার রঙ পাঠককে-ও মগ্ন হতে
শেখায়। তৃষার কাব্যভাষা
তেমনই সহজাত
ও প্রাকৃতিক বলে মনে
হয়।
" যেকোনো শিল্পের
কাছে
নত হতে হতে
আমি প্রশ্ন
করি
তুমিই কি সে?
তুমি কি সে,
যার কাছে
বরাবর
উন্মোচিত হয়ে আছে
আমার অবৈধ
জন্মরহস্য
উন্মোচিত হয়ে আছে
জন্মদানকারী প্রতিটি
শরীরের খুঁতস্বভাবগুলি"
বাংলা কবিতার
অলীক কুনাট্যের
দিনে, অর্ধচেতনের এই অন্ধকার লীলাভূমে এই তরুণীর উদ্ভাসিত
এইসব উচ্চারণগুলি মনে
হয় তাই
ইঙ্গিতবাহী। খবরের কাগজের
অন্ধকার কেটে
কেটে কবিতা
রচনার থেকে
দূরে থাকা
তৃষার কবিতা
তাই বলতে
চায় চেতনা,আবেগ ও
মগ্নতার মেশামেশির
কথা।
" এমন বাদলার দিনে
মনোমালিন্য তৈরি
করতে নেই। পাগলামিকে দেগে দিতে
নেই অসহায়তা
বলে। তোমার কাছে এসেছি-
সে কোনো
আশ্রয়ের লোভে
নয়। ভালোবাসা এমনি
টেনে আনে
পথে"
অথচ এই কবি যেন অনায়াসে খুঁজে পান এই সাধারণ দৈনন্দিন বেঁচে থাকার মধ্যে এক মহাজাগতিক ঐকতান।
তাঁর উপলব্ধি স্বতঃস্ফূর্ত, তবে শুধুই বাস্তবতার উপলব্ধি
নয়, বরং উপলব্ধি চৈতন্যেরও
"আর
তোমার ঘুমের মাঝখানে, বারবার, সিরিয়াল শুরু শেষ এবং
মধ্যপথগামী
বাজনাকে, মৃত তারাদের অনৈসর্গিক আলোয় পেঁজা পেঁজা
অন্ধকারের
ভিতর
মহাজাগতিক
ঐকতান ভেবে শুনে গেছ"
তাঁর উচ্চারণ কখনো শান্ত
আবার কখনো তাঁর চেতনাঅর্জিত দীপ্তি তাকেই বলিয়ে নেয় দৃপ্তভাবে। যেন এক ‘অপর’-কে
তিনি তাঁর ভিতরে বহন করে চলেছেন, খণ্ড আত্মা-কে যেন সেই অপর এক সম্পূর্ণতার দিকে
নিয়ে যায়, অথচ লেখাটি শেষ হয় এক অপূর্ণ সত্ত্বা-কে বজায় রেখেই। যেমন একটি কবিতায়
তিনি লেখেন
“ঘনঘোর সন্ধে আর, সদ্য লেখা কবিতার
তৃপ্তি ছেড়ে বেরোও এবার।
পথে পথে ফেরি করো দুঃখের বেসাতি,
কার দুঃখ? বলো দুঃখ, তুমি কার?
যা কিছু লিখেছ লিপি, একক ক্ষতের
নাই যদি ভুলতে পারো, মনেও না-রাখো যদি
কোথায় দাঁড়াবে তবে, অকস্মাৎ দ্বিতীয়টি ? ”
বলাবাহুল্য তাঁর ভাবনায় এই
সিন্থেসিস শিল্পের পাঠক হিসাবে আমাকে আশান্বিত করে, স্বপ্ন দেখায়। ‘পথে পথে ফেরি
করো দুঃখের বেসাতি’- কবিতায় যেন অগোচরে লুকিয়ে থাকা সমস্ত অপমান, ম্লান একটি দুঃখবিন্দু
হয়ে ঢালু পথের দিকে গড়িয়ে চলে যায় , কিংবা হয়তো কবিকে তিনি সাধারণ জীবনের মধ্যে
খুঁজে পান না, তাই এই আর্তি তাঁর । অথচ যে মুহূর্তেই উচ্চারণ করেন ‘ বলো দুঃখ তুমি
কার’? পাঠকের সামনে ঝলসে ওঠে একটি প্রশ্ন চিহ্ন। এই কবির চলার প্রতিটি পথেই
শিরোনামে অলংকৃত ওই ‘প্রশ্নচিহ্ন’ যেন ফুটে ওঠে। তাঁর কাব্যিক এই দেখা তিনি পাঠকের
সামনে তাই খুব সহজ ভঙ্গিতেই উপস্থাপিত করতে পারেন। নিজেকে চেনা, ভিতরের অপর, এবং তাঁর অস্তিত্বের সমস্ত
প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পরত গুলিকে চিনতে পারাই তাঁর কাব্যভাষার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে।
কিন্তু একটানা লেখাগুলি কোথাও
ক্লান্ত করে।একটানা ঘুমের মতন
ক্লান্ত করে,
তবে ঘুম-ভাঙা মানুষের
চোখেই ফিরিয়ে
দেয় মানুষের পুরনো স্বপ্নগুলি। কয়েকটি দীর্ঘ
লেখায় দর্শনের বাহুল্যে কবিতা হিসাবে কিছুটা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। কিন্তু এই ভুল
করতে তিনি ভয় পান না, তাই তাঁর উচ্চারণ আড়ষ্ট ও শীতল মন্ত্রোচ্চারণে পর্যবসিত করে
না, পাশাপাশি তিনি যে দীর্ঘ একটি ঘোর তৈরি করতে চান তাতেও চ্যুতি ঘটে না। ছন্দের ব্যবহার তার কবিতায়
নেই, নিপাট
গদ্যে লেখা
কবিতায় তৃষা
কখনোই চমক
তৈরি করার
প্রয়াসও করেন না। আলো থেকে অন্ধকারে,
অন্ধকার থেকে
রামধনু রঙের
ভিতরে তার
কবিতার ভাষা
প্রাচীন, অথচ
ভাব আধুনিক। অত্যাধিক লাফালাফি নেই
তার কবিতায়,
আছে অন্ধকারের
স্থিরতা, আলোর
চিত্ত এবং
নিজের উপলব্ধি
বলবার সূক্ষতা।
"আর কতবার
বেদনায় তম
আচ্ছন্ন হবে
কাম ও মোক্ষের হে দেবতা
তুমি
নগ্ন দাঁড়াও এসে,
তোমাকে প্রত্যক্ষ
করি
কী তুমি অনাবিল
রহস্য রেখেছ
আড়ালে
কী তুমি এতকাল
ফুটিয়ে তুলেছ
বারবার"
কবি সংসারের
মধ্যে আবদ্ধ,
অধিকন্তু সমন্ন্যাসের
দিকে।তরুণ কবির
প্রথম কাব্যগ্রন্থে
সেই ইশারা
কৃতঘ্ন উপহার। তৃষার কবিতায় তার
প্রচ্ছন্ন প্রভাব
যেমন আছে,
তেমন-ই
মিশে আছে
পূর্বজ কবিদের
প্রভাব-ও। তাই স্বাভাবিক, জীবনের
শুরুতেই প্রভাবহীন
কবিদের কবিতা
সন্দেহের যোগ্য।
"তোমাকে জেনেছি,
তাই না-জানার দূরত্ব
চাই পুনর্বার। "
কিংবা
"অবশেষে কিছু
রাখো,
যেভাবে শীতের কাছে
রেখে যায়
অন্ধকার উত্তরের
হাওয়া"
প্রথম কাব্যগ্রন্থে
আমি তৃষাকে
কোনও প্রশংসা
বাক্য দিতে
চাইনা, শঙ্কা
ও শঙ্কাহীনতার দিকে তার
আত্মা আরও
প্রসারিত হোক,
আরও কবিতায়
আমাদের চেতনা
ভরে উঠুক
গ্রন্থ -লিপি
ছাড়া ক্ষত
আছে কিচু?
কবি- তৃষা
চক্রবর্তী
প্রকাশক- তৃতীয়
পরিসর
দাম- ১০০
টাকা
No comments:
Post a Comment