Thursday, April 11, 2019

আলো ছায়ার কারুকাজ- রুচিরা কর্মকার






"যে দৃশ্য দেখোনি তুমি
 সেই দৃশ্যে আলো এসে পড়ে"

                       অথবা

"কিছুটা প্রতীকে বলি
 কিছুটায় দৃশ্যমান আলো"

আমাদের দেখা না দেখার উপর এভাবেই আলো ছায়ার কারুকাজ। কুবলা খানের অনিন্দ্যসুন্দর প্রাসাদ, যেখানে উষ্ণতা এবং শীতলতার এক অদ্ভুত সমাবস্থান, কবি কোলরিজকে অনুপ্রেরণা দিয়েছিল এক সঙ্গীতময় কাব্যময় বায়বীয় প্রাসাদ গড়ে তোলার। কোলরিজ বর্ণিত সেই প্রাসাদ যখন আমরা মগ্ন হয়ে পাঠ করি, দেখি আমাদের শরীরজুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে সেই প্রাসাদ এবং তাঁর আনুসাঙ্গিক ভূমিরূপ। সেই গভীর গিরিখাত, ঘন জঙ্গল, উদ্দাম আক্রোশী টালমাটাল সুদীর্ঘ নদী, বিমর্ষ ফ্যাকাশে চাঁদ, যার নীচে গোপন প্রেমিকের জন্য কাঁদে কোনও নিষিদ্ধ প্রেমিকা দুস্থ--
                 
কিছুটা প্রতীক ভেঙে
  কাছাকাছি পাখি যেতে চায়
  নিরাসক্ত কুয়াশার গুলে যায়
  সহজ দ্রবণ  

শরীরপরব”- এ শরীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। ঘুরে ফিরে আসে আবার ফিরে ঘুরে যায়। নিরীশ্বর আপাতগহীনসব শব্দ- যা শরীর বেয়ে ওঠে এবং শরীর ছাপিয়ে যায়। পাঠক দেখে দৃশ্যজুড়ে শরীর এবং শরীরজুড়ে ফুটে ওঠে। কবি স্বীকার করেন এ শরীর উদার অছিলাএবং "সন্তান সম্ভব"। কবি নিজে সমস্ত দৃশ্যে চরিত্রমাত্র। আহ্নিক গতিতে তাঁর দৃষ্টি ঘোরে এবং দৃশ্য ধরা পড়ে। এক একটি ফ্রেম, যেখানে তিনি নিজেকে বারবার দেখতে পাচ্ছেন। আর তাঁর দেখাটাই অনুবাদ করে শব্দের মাধ্যমে তুলে ধরতে চাইছেন পাঠকের কাছে। প্রকাশিত হওয়ার এক ভয়ঙ্কর ছটফটানি। কিন্তু শব্দ কি সক্ষম সমস্ত দর্শন ফুটিয়ে তুলতে ? কিছুটা তো হারিয়েই যায় অনুবাদে। সম্ভাবনাময় সমস্ত শব্দ সম্ভাবনাতেই আটকে থাকে---
                     
 " সব শব্দ নিরীশ্বর আপাতগহীন
   পূর্ণতার বাড়ি যাই ভিক্ষাভান্ড হাতে
   আকুলি বিকুলি মেখে ফিরি মাঝরাতে "

এই যন্ত্রণা 'শরীরপরব'-এর সমস্ত শরীর জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। কোলরিজের বিষণ্ণ চাঁদের মতোই চন্দ্রকরোটিতে অপার মাধুরি ছিল, কিন্তু তরুণ অপরিণত ন্যাকামির সে ছবি ভেঙে গেছে- হয়তো অনুদিত হতে গিয়েই। শরীর আর শব্দ তাই এক হয়ে যায়, একই রকম আহত এবং অর্থহীন। 
আবার কখনও তিনি আশাবাদী। তাঁর দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে নক্ষত্র এবং মহাকাশের সম্ভাবনাময় সব প্রতীক। তিনি দেখছেন--- 

" সমূহ শরীর নিয়ে 
 জেগে আছে বেদনারাক্ষসী
 ভাবতে পুলক জাগে; পুরুষাঙ্গ দৃঢ় হয়ে আসে "

প্রকাশের সন্নিকটে তিনি। অপ্রকাশিত থাকাই কি স্বাভাবিকতা ? তবে বিপরীত পথগামী তিনি। আহ্বান জানান ---       
                
"এসো দাঁত এসো ক্ষুরধার
 মাংসের মহিমা নিয়ে বাঁচো"

এই প্রকাশের আকাঙ্খা এবং অপ্রকাশের বেদনা ব্যক্ত হতে থাকে বিভিন্ন ছত্রে ছত্রে। অর্থ এবং অর্থহীনতার দোদুল্যমানতার মানসিক টানাপোড়েন নিয়েই কবি এগিয়ে চলেন। হাত পাতেন কখনও বা অনন্যোপায় হয়ে- নিরাকার অনন্যার কাছে। অনুর কাছে আঘাত ভিক্ষা করেন আর----
  
" অর্থহীন গভীরতা লেখে কিছু আহত পাগল..."

সাতটি কবিতার শরীরে ভর করে অনন্যা বিস্তৃত হয়, সঙ্গীতের সাত সুরের মতোই। তার সপ্তক ছুঁয়ে আবার ফিরে আসে খাদে। কবি অনুভব করেন---

" আসলে অনন্যা বলে কেউ নেই
  এইমাত্র বলে গেল-- সাবেকি জোনাকি"

নিজের অক্ষমতায় বিরক্ত বিধ্বস্ত হয়ে আশ্রয় খোঁজেন কবিতার শরীরেই। তীব্র আক্রোশে নিজেকেই কুপিয়ে খুন করতে চান, আবার সমস্ত উন্মত্ততা জড়ো করে কখনও নতুন ভাবে সন্ধান করতে চেষ্টা করেন নিজেকে। যা তাঁর আত্ম উন্মোচন-- সেই তাঁর ঈশ্বর সন্ধান। তাঁর কাতরতা ফুটে ওঠে পংক্তিতে পংক্তিতে---

"...চরম নাস্তিক তবু, ঈশ্বর সহায়
 সমস্ত বিশ্বাস নিয়ে ঈশ্বরের পথে চলে যাব "

তাঁর ব্যক্তি সন্ধান- তাঁর ব্যক্তিগত সন্ধান, যন্ত্রণা এবং পরিশ্রমের সাথী হয়ে ওঠে পাঠক। তিনি নিশ্চিত পাঠকের অদৃশ্য উপস্থিতি সম্পর্কে। নাটকের মঞ্চে দাঁড়িয়ে একটি চরিত্র যখন এক স্বগতোক্তি ছুঁড়ে দেয় আপাত উদ্দেশ্যবিহীন, তখনও সে সচেতন উপস্থিত দর্শক সম্পর্কে। কবিও এখানে তেমনই তাঁর পরিশ্রান্ত, ভগ্ন অনুভব ভাগ করে নেন নিজের সঙ্গেই- অথচ অদৃশ্য পাঠকের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন তিনি, কিন্তু অবরোধ প্রত্যাশী নন। যিনি নিজেকে প্রকাশ করবার জন্য ব্যাকুল, নিজের ব্যর্থতা, নিজের ভ্রান্তি নিয়ে হতাশা থাকলেও তিনি লজ্জিত নন কখনোই। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই তাঁর-

" শূন্যতা খুঁজেছি জলে
 কোনওদিন জীবন খুঁজিনি "

আবার কখনও স্বীকার করে নেন আত্মনির্মান প্রচেষ্টার ভঙ্গুরতাকে---  
" প্রাতঃস্মরণীয় কোনো অস্ত্রের খোঁচায়
  আত্মপ্রতিকৃতিটুকু চৌচির-চুরমার হয়ে গেছে "

"শরীরপরব"-এর কবির সম্বল কেবলমাত্র দুটি। প্রথমটি তাঁর কবিতা এবং দ্বিতীয়টি তিনি নিজে। শরীর একটি উপাদানমাত্র যার মাধ্যমে জীবন উপভোগ করি আমরা। সেই নশ্বর শরীরকেই "মোটিফ" হিসেবে ব্যবহার করে অনশ্বর জীবনসত্য ধ্রুবকে স্পর্শ করতে চেয়েছেন কবি। এছাড়া, তাঁর লেখায় বার বার ফিরে এসেছে যাপনচিত্র, অকৃত্রিম গ্রাম জীবনের শান্ত রেখাচিত্র, যা তাঁর নিজের অস্তিত্বের অংশমাত্র। 
কবিতাই তাঁর একমাত্র পথ। অন্য কোনও মাধ্যম তাঁর কাছে ধরা দেয়নি কবিতার মত করে। তাই ছন্দ এবং শব্দের উপর একান্ত নির্ভরশীল তিনি। নিজের অনুসন্ধান প্রকাশের ইচ্ছায় আত্মবিশ্বাসী এবং স্বচ্ছন্দ আবার নিজেকে লিখে উঠতে না পারার কষ্টে ক্লিষ্ট এবং সন্তান সম্ভব। আঁকিবুকি কেটে তাই দৃশ্যের পর দৃশ্য ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেন। অর্থ তৈরি হয় অর্থের মত করেই। যাপন যন্ত্রণার চিত্র দিয়ে নির্মিত কবিতায় পাঠক সফলভাবে অনুভব করে লেখককে। পাঠক তাঁর যাত্রাসঙ্গী হয়ে ওঠে হয়ত নিজের অজান্তেই। শরীরের মাধ্যমে অশরীরি আদি অকৃত্রিম নশ্বরকে ছুঁতে চাওয়ার প্রচেষ্টায় "মেটাফিসিক্যাল" শুভম চক্রবর্তী স্বীকার করে নেন---       

" কবিতা লেখার নয়
  কবিতা তো সতত দেখার..."

নিজেকে প্রকাশ করতে পারা তো চরম পরিতৃপ্তি। প্রায় পাঁচশত বছর পূর্বে কবি ফিলিপ সিডনি যাকে সন্তান জন্মের সুখের সঙ্গে তুলনা করেছেন, শুভমের মতে তা -- 

"একটি দৃশ্যের পর অসম্ভব অপার্থিব ঘাম !"


কবি শুভম চক্রবর্তীর ' শরীরপরব ' 

প্রকাশনায়-- ইতিকথা পাবলিকেশন
মূল্য - ১৫০ টাকা

প্রচ্ছদ - শূদ্রক উপাধ্যায় 




No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমা...

পছন্দের ক্রম