গুরুচন্ডালি প্রকাশিত 'এক ব্যাগ নব্বই' সিরিজ এক অভিনব উদ্যোগ। সুলভে নব্বইয়ের ঊনিশজন কবির একটি করে ক্ষীণ কলেবরের কাব্যগ্রন্থের একটি একত্রিত সেট। এই উনিশটি বইয়ের একটি সেট বইমেলা থেকে কিনে নিয়ে আসার অব্যবহিত পরেই পড়তে শুরু করি এবং মনে হলো: না, ঠকিনি। পড়তে শুরু করেছি, শেষ হয়নি, কেননা এমনকি একটি কবিতাই যেখানে সতত পুনঃ পুনঃ পাঠের দাবী রাখে, সেখানে গোটা এক দশকের ঊনিশজন সুদক্ষ সময়ের প্রতিনিধির সম্পূর্ণ পাঠ কার্যত মগ্ন পাঠশ্রমের চির-মুখাপেক্ষী। প্রসঙ্গত, নব্বইয়ের দশক আমাদের লার্ভাদশা থেকে উত্তরণের সেই অখণ্ড কলেজজীবন, এবং, লিটল ম্যাগের দুনিয়ায় অফুরান পরিভ্রমণের সেই ছিল বুঝিবা প্রকৃত সুসময়। তৎকালীন রকমারী পত্র পত্রিকায় যেসব কবির নাম দেখতে পেতাম, সেই কবিদের অনেককেই আবার ফিরে খুঁজে পাওয়া গেল। পাশাপাশি পেলাম কিছু অচেনা নামও। কিছু কিছু কবিতা বারম্বার পড়তে ইচ্ছে করে। এই সিরিজ পাঠ যেন এক যুগসন্ধিকেই ফিরে পাওয়া, এক সন্ধিক্ষণে যখন নব্বই সুদূর অতীত আজ, যখন আমরাও একটু একটু করে একাকী হয়ে উঠছি আরো, যে যার মতো হারিয়ে আছি স্বপ্ন-দ্যাখা-বারণ, নিদারুণ জেলুসিলপ্রবণ কর্মজীবনে, তখন এই চল্লিশ-উত্তীর্ণ মাঝবয়সে নব্বই আজ পুরু লেন্সের চশমায়, শ্লথ, আবছা, তথাপি, উদগ্রীব ফিরে দ্যাখা। সেই জায়গা থেকেই বইগুলি পড়তে শুরু করি বাড়তি আকর্ষণে। এলোমেলো অনেকগুলি বইয়ের ছন্নছাড়া পাঠ থেকে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার চেয়ে আপাতত দুটি কাব্যগ্রন্থ তুলে এনে সামগ্রিক প্রতিক্রিয়া দেওয়া অধিকতর সঙ্গত মনে হলো। এতে কবি-চরিত্র, ভাবনার ঐকিক নিজস্বতা ধরা পড়বার সম্ভাবনা বেশী। সেই জায়গা থেকে আপাতত দুটি বই বেছে নিয়েছি, তা-ও খানিকটা র্যাণ্ডম পদ্ধতিতেই। বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এই পাঠ একান্ত প্রাতিস্বিক, চুপিসাড় এবং অতীব সন্তর্পণ। ফলে মতপার্থক্যের সম্ভাব্য পরিসর ও স্বাভাবিক অবকাশ থাকবেই। পরে বাকি কিছু বই নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার আন্তরিক ইচ্ছে রইল। তবে মুগ্ধতা থাকছেই সেইসব কবিদের প্রতি, যারা সময়কে তুখোড় মুন্সীয়ানায় কামড়ে ধরেছেন, আয়ত্ত করেছেন নিজস্ব কৌশলে ঐশী ভাবনার গহন বীজশব্দবপন। ফলে, ফিরে পড়ব, বাকিদের পড়াব এবং সময় ও সুযোগে সমস্ত কবিদের কবিতা নিয়ে আবার বলার অবকাশ থাকবেই।
পাখিয়াল- সায়ন কর ভৌমিক: শিকড়ের পিছুটান
সিরিজে সায়ন কর ভৌমিক লিখিত, 'পাখিয়াল' বইটি উল্লেখযোগ্য। সায়ন নিজে 'পাখিয়াল' নামটিতে তাঁর দেখার ঝোঁকটি জানিয়ে দিচ্ছেন, 'উড়ান ছাড়া কীই বা বলা যায় একে, খাদ্য এবং উষ্ণতার সন্ধানে, চোখে চোখ রেখে দেখতে পারি না এই সময়ের স্রোতকে, পাখির চোখে দেখতে চাওয়া নাকি ওপরে তাকিয়ে ঠাহর করা ঋতুবদলের ডানার শব্দ। অযত্নের টবে উড়ে আসা পালক তুলে রাখার পাখিয়ালি এই।'
পাতা খুলেই দেখি সায়ন নিজের জীবনযাপনের টুকিটাকি, স্থানাঙ্ক, কবিতার সঙ্কেত ও লিখনশৈলীর ইঙ্গিত পাঠককে দিয়ে রাখছেন। কিভাবে নব্বইয়ের দশক তাঁকে প্ররোচিত করেছিল শূন্য ও একদশক অবধি, এই কবিতায় তার সাক্ষ্য মিলবে:
'আজকাল সব ছন্নছাড়া হয়ে গেছে, রক্তচাপ, ক্ষুধামান্দ্য, সংসার, এমনকী যৌনসততা পর্যন্ত, রাতে ঘুম নাই, বাটামের ভয় আছে না?
কিন্তু সে যাই হোক; এইসব শূন্যদশক, একের শতক এই সবই কিন্তু গাপ হয়ে ছিল নব্বইয়ের ভাঁজে।
দহরম মহরম ছিল বাপু, তাহাদের সাথে। সাতেপাঁচেই ছিল সব, নয়েছয়ে, বাহান্নতিপান্নতেও ছিল সব বাইপাসের ধারে ভুট্টাপোড়ার সাথে দুইটি ছিলিম।'
এর পরের অংশ, পাঠক, পড়ুন।
'এখন অনেকেই ছন্নছাড়া হয়ে গেছে। ধারকর্য করে অন্যদের টরেটক্কা সংকেত করি
ধারকর্জ, এই যেমন ব্যানাল পদ্য, শব্দের মালিক না হলেও ধার তো আছেই
লেভেল ক্রসিং হার্টক্রেনএইসব। টরেটক্কা সংকেত পাঠাই, পদ্য লিখি এখানে ওখানে
ইউক্যালিপটাসের পাতা, ভেজাল দিই, এদিক ওদিক, একপাতায় ছাপিয়ে দিই টরেটক্কা,
ক্যাপ্টেন স্পার্ক হলে ধরে ফেলতো ঠিক, বুঝে নিত সন্ধে নামার ঝোঁকে
জনবহুল সাইকেলরিক্সাসঙ্কুল পথের কোনাখামচিঘেঁষা
ভুলভালকোড।'
প্রথমাংশে সায়ন নব্বইয়ের দশকে তার তুমুল ছাত্রজীবনের অনুষঙ্গগুলি লিখছেন। গাপ, বাটাম, দহরম মহরম, সাতেপাঁচে, ছিলিম ইত্যাদি চালু শব্দগুলি, যেন, সমকালীন এক কৌম নাগরিক জীবনের ইঙ্গিতদেয়। দ্বিতীয়াংশে তিনি লেখেন: 'এখন অনেকেই ছন্নছাড়া'। জীবনের এই নিয়ম যেন অমোঘ। কলেজজীবন মানুষকে এক সখ্যতার পাঠ দেয়, ভাগ করে নিতে শেখায় অনেক কিছু। কিন্তু, পরে মানুষ পেশাগত জীবনে ঢুকে আস্তে আস্তে ব্যক্তিগত হয়ে পড়ে, শুরু হয় বিচ্ছিন্ন সংসারজীবন।
পরের অংশে সায়ন তাঁর ব্যক্তিগত লিখনভঙ্গিটিই তুলে ধরলেন:
'ধারকর্জ করে অন্যদের টরেটক্কা সংকেত করি
ধারকর্জ, এই যেমন ব্যানালপদ্য, শব্দের মালিক না হলেও ধার তো আছেই
লেভেল ক্রসিং হার্টক্রেনএইসব।'
এখানে 'ধারকর্জ' শব্দটিতে সায়নের ঝোঁক চোখে পড়ে। 'ঋণ' না লিখে তিনি এই চালু লোকশব্দটিতে বেশি আস্থা রাখেন। আসলে তিনি ট্র্যাডিশনকে একভাবে স্বীকার করেন, তবু, চলতি শব্দ আলগোছে লিখতেই ভালবাসেন। পাঠককে, তাঁর মতো করে, তিনি যেন তাঁর কবিতায় 'টরেটক্কা' পাঠান। লেভেল ক্রসিং ও হার্টক্রেন, শক্তির কবিতা থেকে শব্দবন্ধ তুলে আনেন, এবং যেন এই ধরণের তথাকথিত 'ব্যানালপদ্য'কে ও আত্মস্থ করতে চান, তাঁর মতো করে।
পরবর্তী অংশে যেন পাঠককে তাঁর বার্তা পাঠাতে সায়ন এভাবে আগ্রহী :
'টরেটক্কা সংকেত পাঠাই, পদ্য লিখি এখানে ওখানে
ইউক্যালিপটাসের পাতা, ভেজাল দিই, এদিক ওদিক, একপাতায় ছাপিয়ে দিই টরেটক্কা,
ক্যাপ্টেন স্পার্ক হলে ধরে ফেলতো ঠিক, বুঝে নিত সন্ধে নামার ঝোঁকে
জনবহুল সাইকেলরিক্সাসঙ্কুল পথের কোনাখামচি ঘেঁষা
ভুলভালকোড।'
‘কোড’ এই শব্দটি সায়ন সচেতনভাবে ব্যবহার করছেন। আসলে, এখানে এই শব্দ দ্বিবিধ। নব্বইয়ের শেষে ও শূন্যদশকের সন্ধিক্ষণে সফটওয়ার ও আইটিসেক্টরের উত্থান, বিপুল সংখ্যক যুবা বিদেশ পাড়ি দিতে লাগল এই পেশায়। নতুন শব্দ ও শব্দবন্ধ তৈরী হতে লাগল। কোড ডেভেলপমেন্ট, ডিবাগিং, ডকুমেন্টেশন, অ্যাপ্লিকেশন সফ্টওয়্যার এইসব পরিভাষা নিয়ে নতুন নতুন ঢঙে বিকশিত হতে লাগল নতুন প্রযুক্তি। কোড, এই শব্দটি তখন থেকে এক বিশেষ অর্থ বহন করতে লাগল। অন্যভাবে, কবির শব্দবাহিত সঙ্কেত, চিহ্ন, রূপক, উপমা সবই যেনএক এক ধরনের কোড। প্রসঙ্গত, সেমিওটিক্স, ভাষাশৈলীর এই আঙ্গিকে শব্দকে ডিকোড করে কবিতার টেক্সট পাঠ ও তার নিহিত পাঠোদ্ধার, এই নিয়ে অনেকদিন ধরেই কাজ চলছে বিদেশে।
সায়ন জানাচ্ছেন, 'জনবহুল সাইকেলরিক্সাসঙ্কুল পথের' ' সন্ধেরঝোঁকে', তাঁর কবিতা, যেন দাঁড়িয়ে আছে। পাঠককে এখানে যেন ক্যাপ্টেন স্পার্ক হতে বলছেন সায়ন, মনে করিয়ে দিচ্ছেন কবিতার পাঠ এক নিবিড় প্রক্রিয়া, এখানে পাঠকের ভূমিকাও কম নয়। ঠিক যেরকম সঙ্গীতে গায়কের গায়কী ধরতে গেলে শ্রোতাকেও হতে হয় একনিষ্ঠ।
সায়নের কবিতা দৃশ্যপটকে ধরে, কিন্তু নাগরিক জীবনের শূন্যগর্ভ দিকটিকে ধরতে কখনো পিছপা হয় না। তাঁর কবিতায় ধরা পড়ে, গ্রীষ্মের ছুটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করি আমরা, সমস্ত উপকরণ আর অনায়াস বৈভব নিয়ে, কিন্তু কোথায় যেন এক ফাঁক থেকে যায়:
'মাঝে মাঝে হাওয়া দেবে, জোলো হাওয়া, সে নদী বা পুকুর
কিংবা সমুদ্র হলে তো চমৎকার, সত্তরের গান
হাসিখুশি লোকজন দেখতে ভালোই লাগে
হাতে বই থাকলে সারাক্ষণ পড়তে হবে নাকি
মাঝেমধ্যে হাওয়া দেবে, মাঝেমধ্যে মনে পড়বে
যেসমস্ত লোকজন এইরকম চমৎকার আবহাওয়া না দেখেই
আচমকা চলে গেল, এই দৃশ্যে যদিও খুব মৃত্যু বেমানান।
অফুরন্ত বিয়ার আছে বরফের কোলে
আছে বইপত্র আঙুলে নিকোটিনের ঘ্রাণ, সৈকতে কলরব
হাসিখুশি লোক দেখতে কি চমৎকার লাগে।'
নদী, পুকুর, সমুদ্র, যেকোনো উপকরণ হলেই যেন চলে যায় মানুষের,এইজন্য সায়নের ভাষায় হাওয়া নিছক 'জোলোহাওয়া'। ছুটিকাটানো যেন এক অজুহাতমাত্র, বিয়ারের ক্যান, বরফ, হাতে খোলা বই, এসব যেন এক আধুনিক উপাচার ও একধরণের নিয়মরক্ষা, এ এক ধরণের খেলো জীবনযাপন, প্রকৃতির কাছে এসে এই নাগরিক প্রথার অশ্লীল দিকটি ধরিয়ে দিচ্ছেন সায়ন, ফলে তাঁর কবিতায় যুক্ত হচ্ছে শ্লেষ ও বিদ্রূপ, এর ইঙ্গিত মিলবে অন্যান্য কবিতাতেও, যেখানে তিনি লিখছেন এই লাইনগুলি:
' যদিও আমরা বেশ আরামকেদারা জুড়ে বিলাসী, তবুও বিষাদ মন জুড়ে,
বাষ্পীভূত হয় এই রোদ্দুরে, আদিগন্ত সকালের মুখে
খোলামেলা কপাটে ও লোকজনে মন ভালো হয়
এই শীতকাল চলে গেলে।'
সায়নের কবিতা মনে করাচ্ছে উৎপল বসু ও ভাস্কর চক্রবর্তীকে, বিশেষত, শেষোক্ত কবির ব্যক্তিগত ডায়েরি অনেকের কথা হয়ে উঠেছিল শেষাবধি। মনে পড়ছে রণজিৎ দাশের কবিতাও, বিদ্রূপ যাঁর কবিতায় অন্য মাত্রা পেয়েছিল।
কবিতা লিখছেন সায়ন, কিন্তু সমকালের রক্তক্ষয় ও যুদ্ধের পরিস্থিতিতে কবিতায় ঋতুর বিবরণ লেখা এক ধরনের বিলাস, এক ধরনের পলায়ন, তাই তিনি লিখে ফেলছেন:
'বাইরে যখন আগুন জ্বলছে সত্যি খুনোখুনি
সোজাসাপটা যুদ্ধকালীন ট্রেঞ্চে ও বাঙ্কারে
আদর যেন হুড়ুমতাল অপরিকল্পিত
ঋতুর কথা বর্ণমালায় অনর্থক লেখে।'
অন্যত্র সায়ন, লিখছেন:
' একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে উইন্ডশিল্ডে, যেরকম পরিপাটি বাসা বাঁধে রুপোলি পোকার দল, হলুদ পাখির খড়, ভামবিড়ালের আনাগোনা যেরকম দেখা যায়, যেরকম স্মৃতিতে কলকাতার আলো, দূর থেকে ডাউনটাউন, অন্ত্যমিলের বেহায়া উদযাপন'
সত্যিই যেন কবিতা লেখাও কি আসলে একধরনের নিয়মরক্ষা, একধরণের 'বেহায়া উদযাপন'? সায়ন যেন নিজের দিকেই আঙ্গুল তুলছেন, লেখা যেন ধরতে চেয়েও ধরতে পারছে না স্মৃতির দূরত্বে থাকা সুদূর কলকাতাকে, ধরতে পারছে না দূর থেকে দেখা ডাউনটাউন, প্রবাসীর খেদ ধরা পড়ছে তাঁর কবিতায়, এ এক অসহায়তা, একবিচ্ছিন্নতা। এই বিচ্ছিন্নতা নাগরিক মানুষের এক দুঃসহ একাকীত্ব, এই নিয়ে কোনো রোমান্টিকতা নেই, কিন্তু অভাববোধ, আর শূন্যতা রয়েছে সায়নের কবিতায়:
'সে যাক, এদিকে খুবই বসন্ত আসবে, চমৎকার চেরিফুল, আরো সব নামনাজানা বিলিতি গাছপালা, পাহাড়ের মাথায় দাঁড়ালে দূরের শহর দেখা যায় আলোঝলমল, গাড়িঘোড়া মানুষজন, দোকানপাট কি সুন্দর ডাউনটাউন, আর দুসপ্তাহ বসন্তের পাহাড়ের মাথা থেকে দেখা যাবে মেপল গাছের মধ্য দিয়ে বয়ে যাবে পশ্চিমা বস্নতের হাওয়া। দোল চলে গেছে, এই যা, কদিন আগে তো সরস্বতী পুজাও হয়ে গেল, ফাল্গুনে বিকশিত আম্রমুকুল এইসব হয়েছে তার মানে, কোন সিজনে যেন ডাহুক পাখির ছানাগুলো পুরোটা কালো থাকে, ডোবার ধারে হেঁটে বেড়ায় কুচো মাছ পোকামাকড় খোঁজে, যমকুলি পাখি আড়াল থেকে ডাকে ঝিম ধরা দুপুরে আর তারপর বিশাল ফলহীন আমগাছের পাতায় বাড়ি ঘরদোর কি নোংরা কি নোংরা, তার মধ্যে এক গাদা কাকের বাসা, সেসব কাঁপিয়ে দিয়ে হাওয়া বয় যেন খরবায়ু। তখন সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়তে হয়, তবে এইগুলো সব অতীতকাল হবে, এখনো সেসব নিয়ম আছে কিনা জানা নেই।'
এই ভাষ্যে যিনি ধরা পড়ছেন, তিনি প্রবাসী, অবস্থান ভিন্ন গোলার্ধে, বর্ণনা একেবারে আড়ম্বরহীন, এবং এই দৃশ্যে ভাষ্যকার যেন যুক্ত নয়, তিনি বিচ্ছিন্ন ভাবে দেখছেন 'নাম না জানা বিলিতি গাছপালা', এই দৃশ্য সুন্দর হলেও তাঁর মন পড়ে থাকছে স্বদেশে, কিন্তু নস্টালজিয়া-আক্রান্ত হতে চেয়েও যেন তিনি ব্যর্থ:'কোন সিজনে যেন ডাহুক পাখির ছানাগুলো পুরো কালো থাকে'। লক্ষ্যণীয় এই যে , বিদেশ তকতকে সুন্দর, তবু এই দৃশ্যে যেন ফেলে আসা অসুন্দর দেশের জন্যই তাঁর যত পিছুটান: 'আর তারপর বিশাল ফলহীন আমগাছের পাতায় বাড়ি ঘরদোর কি নোংরা কি নোংরা..' । এক অসহায়তায় প্রবাসী সায়নের কবিতায় যে দৃশ্যপট রচিত হয় তার বাইরেই থাকেন কবি, আসলে যিনি বিষণ্নতায় খিন্ন, ধরতে চেয়েও ধরতে পারেননা কিছু।
এই কবি আসলে শহরতলির, উপকণ্ঠের ভাষ্য লেখেন, যেখানে শহর টানে গঞ্জকে। যিনি, যতটুকু দেখেন, ততটুকুই লেখেন। দুটি ভিন্ন কবিতার পংক্তি তুলে দিইএখানে:
'লেকের জলে মানস থেকে পাখি আসে
সেসব জানে অনেক লোকই, যারা তখন
বাস করেছে বনের ধারে, শহরতলির উপকন্ঠে
যারা তখন মহানগর চিনতো না আর
চিঠি লিখতো ডাকবিভাগের নানান ছুতোয়
কিন্তু সেসব থাকুক; লেক তো অন্যদিকে।'
কিংবা
'অন্যপারে ব্রিজ পেরিয়ে
হঠাৎ করেই শহর কমছে ঝুপসি ছায়া
বাঁশের বন, কাঠালবৃক্ষ
মাটির বাড়ি দরমাবেড়া ছাগলছানা
লক্ষীমন্ত স্টিরিওস্পিকার আচৈচৈ
হাঁসের ছানা হেলতেদুলতে।সন্ধ্যে নামে
আকাশপ্রদীপ, অন্যপারে টাউনশহর
আকাশজোড়া আবছা আলো
জুড়তে জুড়তে গঞ্জশহর
নদীর ওপর শক্তপোক্ত কাঠের ব্রীজে
পার হয়ে যায় উপকণ্ঠের জনমানুষ।'
আমরা রুটিরুজির সন্ধানে গ্রাম থেকে শহরে, শহর থেকে নগরে যাই, হয়ে উঠি প্রবাসী। একটুও সময় নেই আমাদের, নাগরিক এই জীবনে শুধু ইঁদুরদৌড়। তবু, এই পরবাসে কখনো কখনো ফেলে আসা শিকড়ের পিছুটান ঘুমে জাগরণে জাপটে ধরে, মন হয়ে ওঠে অবুঝ ও অভিমানী। অভিমান কোন কবির স্বভাব নয়, প্রিয় পাঠক, বলুন? তখন যেন এমন কবিতায় সায়নের উচ্চারণ আমার ও আপনার উচ্চারণ হয়ে ওঠে।এই কবিতায় 'গরল' শব্দটি যেন শক্তির থেকে ‘ধারকর্জ’/ ঋণ নিয়েছেন সায়ন, এই উচ্চারণ হয়তোবা শক্তির, যিনি অভিমানে লিখেছিলেন: 'তরুণ কবি কখন তোমায় বলত লোকে?'
সায়ন লিখছেন, এই কবিতায়,
'কী আর এমন গরল ছিল তোমার দেশে
সাঁতরে বেড়াও মিথ্যেপাহাড় শহরনদী
মধ্যরাতে এদিক ওদিক অস্তগামী
নষ্টঘুমে আঁকড়ে থাকো কূলকিনারা
বাতিল সময় এপারওপার চক্ষুবিহীন
বন্দরে তার সমুদ্রচিল লুব্ধপাখি
একটুখানি সময় বাঁচাও এই ভিখারি
কীই বা এমন গরল ছিল মন্দ আলোয়
সকল ট্রাফিক থমকে থাকে লাল আলোতে
ডানদিকে আর বাঁদিক জুড়ে জিয়নকাঠি
সবার পাড়ায় জ্বলছেতখন হলুদ আলো
এইতো বুঝি শীতের মুখে ঘাসের গায়ে
দুয়েক ফোঁটা শিশিরএবং শিকড়বিহীন
পরাগরেণু আবছা এবং ফঙ্গবেনে
নাম কি তোমার? কোন শহরে সন্ধে হলো?
কীই বা এমন গরল ছিল সেই পাহাড়ে?'
পাঠক, সায়ন পড়ুন, শেষ দুটিপংক্তিতে আপনাকেই হয়তো টরেটক্কা দিয়ে ডাকছেন সায়ন। পড়ে, নিজেকেই খুঁজে পাবেন হয়তো:
‘নাম কি তোমার? কোন শহরে সন্ধে হলো?
কীই বা এমন গরল ছিল সেই পাহাড়ে?'
ফোনঘর: সুমন মান্না : জীবনের আখ্যান
এই সিরিজের সুমন মান্না রচিত 'ফোনঘর' বইটি পড়ার পর মনে হলো, বইয়ের নামটি কবিতাগুলির সঙ্গে খুব মানানসই নয়। একথা অনস্বীকার্য যে নিজের কবিতার বইয়ের নাম কবিই রাখবেন, এ-ব্যাপারে পাঠক/আলোচকের কথা বলা হয়ত অনধিকার চর্চাই। তবু, নামশীর্ষক কবিতা 'ফোনঘর', এবং অন্যান্য কবিতাগুলি পড়ে মনে হলো, সুমনের কবিতার মেজাজ একান্ত আত্মকথনের উর্ধ্বে, এবং তিনি আশেপাশের বয়ে চলা জীবন ছুঁয়ে, ছেনে দেখতে বেশি আগ্রহী। সুমন, লিখতে লিখতে, অবলীলায়, এমন কিছু পংক্তি লিখে ফেলেন যা পাঠককে ভাবায়। অন্তত, আমাকে ভাবিয়েছেন।
চলে আসি কবিতায়। নামশীর্ষক কবিতা ‘ফোনঘর’ থেকেই তুলে নেওয়া যাক কিছু পংক্তি:
'অবশেষে বোতামের অক্ষরে অক্ষরে উপগ্রহ যোগ যদি যায় খুলে
আমরা পৌঁছতে চেয়েছি চাঁদে-মধ্যরাত্রির সিকি ভাগ মাশুলে।
নিতান্ত মামুলি কথা, তবু অনর্থক নয়, সীমিত সামর্থটুকু
নিঙড়ে বরাতমাফিক কথার ক্ষরিত সুখ সামান্য আশয়
পার করে দেয় তার পরদিন থেকে আরও কিছু চন্দ্রহীন তট।
কেউ বুঝি আড়ি পেতেছিল সেইখানে? কেউ বুঝি লিখেছিল পট?
সে-ই বুঝি পথ জুড়েছিল, বটঝুরি দোল দিয়ে দেওয়াল গেঁথেছে?'
এই কবিতায় ফিরে আসছে মধ্যরাতের ফেলে আসা নব্বই দশকের এস টি ডি বুথ, সেখানে 'সীমিত সামর্থটুকু নিঙড়ে' , 'মধ্যরাত্রির সিকিভাগ মাশুলে' অপেক্ষমান সেই তরুণ, ফোনের অন্য পারে রয়েছে কেউ, কিন্তু, কী কথা থাকে এমন এই নৈশ আলাপচারিতার? সুমন জানাচ্ছেন:
'নিতান্ত মামুলি কথা, তবু অনর্থক নয়'
সত্যিই তো, সাধারণ, মামুলি কথার আদানপ্রদানেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সম্পর্ক মানে কি শুধু অলীক এক রামধনু বা খোয়াবের মায়াজাল রচনা? আসলে এই মামুলি কথার মধ্যেই কি লুকিয়ে থাকে না জীবনের আসল অর্থ? সাংঘাতিক এই লাইনটি মনে করিয়ে দিচ্ছে শক্তির সেই অমোঘ পংক্তি:
'অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু ঝলোমলো'
এই অবান্তর স্মৃতি, এই মামুলি কথাই মানুষের সম্বল, মানুষের জীবনযাপনের পুঁজি,তাই সুমন লেখেন এ-কথা: 'নিতান্ত মামুলি কথা, তবু অনর্থক নয়'।
পাঠক, লক্ষ্য করুন, উপগ্রহ ও চাঁদের, সুমনলিখিত গূঢ় যোগসাজস। গ্রহ-যোগের আকস্মিকতা নয়, সুমন লিখছেন 'উপগ্রহ যোগ', স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ এসটিডি র যোগাযোগের অনুষঙ্গে এখানে ব্যবহৃত, ভুক্তভোগীরা জানেন, সে যুগে দুরূহ ছিল বোতাম টিপে এই ফোনের লাইন পাওয়া। মধ্যরাতে যেন দৈব উপগ্রহযোগে, চাঁদে পৌঁছতে চাইছে ফোনের দুদিকের দুই তরুণ-তরুণী, সামান্য কথা তাদের পুঁজি, আর এভাবেই কেটে যাচ্ছে যেন একপক্ষকাল( 'আরও কিছু চন্দ্রহীন তট'), অর্ধচান্দ্রমাস। নেহাৎ মামুলি কথা, তবু যেন কত গোপনতা, তাই লেখেন:
'কেউ বুঝি আড়ি পেতেছিল সেইখানে? কেউ বুঝি লিখেছিল পট?'
এই পট আসলে এই কাব্যগ্রন্থের পটভূমিকা গড়ে তুলছে যেন, এক নাগরিক নৈশপরিসর রচিত হচ্ছে, নিতান্ত মামুলি কথাই যেখানে সম্বল, তবু তা অর্থবহ।
এই কবিতায়, সুমনের অন্য কবিতাতেও, লক্ষ্য করছি, সুমন অন্ত্যমিলের চাইতে অন্তর্বর্তী মিল বেশি দেন, একে মধ্যমিলও বলা যায়। লক্ষ্য করুন, তট, পট, পথ ও বট(ঝুরি) শব্দগুলির ধ্বনিগত মিল, অথচ শব্দগুলি পংক্তির শেষে রচিত নয়। ফলে, অন্ত্যমিলহীন কবিতাগুলি পায় এক নিয়মিত ও অনন্য গতিময়তা, যেখানে মিল অন্তর্বর্তী। এই ঝোঁক সুমনের অন্যান্য কিছু কবিতাতেও, পাঠক সজাগ হয়ে সনাক্ত করুন।
সুমনের অন্য কবিতায় নিহিত থাকছে তাঁর লেখার মূল প্রবণতা:
'এই জন্যই বাঁচতে হবে। এক মুহূর্ত দুই মুহূর্ত মণি মুক্তো লুকিয়ে থাকে
তার জন্য এই ইহকাল কয়লা প্রচুর ঘাঁটতে হবে। নির্জনতায় দেখা হলে
আবহাওয়ার কথা উঠবে-ছেলের ইশকুল, বাড়ির সবাই কেমন আছেন
ক'দিন আছি এ তল্লাটে-তারপর ফু:-জলের কণাও সেই বাতাসে
উড়তে উড়তে রঙিন হয়ে কিছুক্ষণের পাখনা পাবে-সেই জন্যই বাঁচতে হবে।'
এখানেও অনুষঙ্গ হিসেবে 'আবহাওয়া', 'ছেলের ইস্কুল' 'বাড়ির সবাই'য়ের খোঁজখবর, এগুলিই সুমন-কবিতার উপজীব্য, এগুলোই লুকিয়ে থাকা 'মণি মুক্তো', সেই 'মামুলি বিষয়'। এর জন্য কবি 'প্রচুর কয়লা' ঘাঁটার মেহনতে রাজি।এভাবেই 'উড়তে উড়তে রঙিন হয়ে কিছুক্ষণের পাখনা' পায় সুমনের কবিতা, এসব কবিতা কোনো অলীক রোমান্টিকতায় রাঙানো নয়, বরং জীবনে নিবিষ্ট হয়ে অন্যের খবর রাখতে উদগ্রীব। 'এর জন্যই বাঁচতে হবে'- এই উচ্চারণ, স্পষ্টভাবে, জীবনে সংলগ্ন থাকতে চায়। এর উজ্জ্বল সাক্ষ্য মিলবে অন্যান্য কবিতায়:
'আমাদের মাঝখানে কেটে গেছে বহু ফসলের কাল, কয়েক প্রজন্ম তার মানুষেরও ছিল-সম্প্রতি স্পর্শ কমেছে কিছু, ধুলোমাটি, পাখির বাহার, রাজত্ব এসেছে বলে কাঁটাতার টুকরো টুকরো করে তোমায় আমায়। আজকাল চিন্তার প্রতিটি সময়ে সমস্যা হানা দেয় বিবিধ প্রাদেশিক বিষয়সমূহ নিয়ে সম্পূর্ণ মানব-শরীর ধারণ, একদা করায়ত্ত ছিল সহজে-তাতে বাধা দেয় সীমানার খুঁটি। হাতে পায়ে কাঁটাতার লাগে বলে চাহনিতে অযথা ভ্রূকুটি। তার পথে অন্তহীন ক্ষয়াটে গোধুলি চকিতে বিভ্রান্ত করে। হাত কাঁপে, দৃষ্টি ঘোলাটে হয়, মুহূর্তে খসে পড়তে চায় হাতের যন্ত্রটি, কাজে ভুল হয়; তুমিও কি সচেতন হয়ে ওঠো ক্রমে? ফসলের কথা আচমকা বলে বসো, শুনি, হিম জমে-মানুষেরও প্রয়োজন নিয়মিত নিড়ানি।'
কৃষিসভ্যতার দেশে কৃষিকাজে যুক্ত হতে উৎসুক যেন এই কবিতা, এই উচ্চারণ তাই নাগরিকতায় সপ্রতিভ নয়, বরং গ্রামীণতায় মুখর। সীমান্তের কাঁটাতার দেশে দেশে বিভাজনই করে নি শুধু, এ-বিভাজন প্রাদেশিক, এ-বিভাজন জমিতে-জমিতে, মানুষে-মানুষে। এই বিভাজন ভেঙে যেন এক যৌথ খামারের স্বপ্ন দেখাতে চাইছে এ-কবিতা। কৃষিজমিনের আদলে মানবজমিনে আবাদ করতে উৎসুক এই কবিতা আক্ষেপ জানাচ্ছে: 'একদা করায়ত্ত ছিল সহজে-তাতে বাধা দেয় সীমানার খুঁটি।' করায়ত্ত শব্দটি কর বা হাতের ভূমিকাই তুলে ধরে, এই হাতেই বীজ বপন করে, ফসল তোলে কৃষিজীবি। এই কবিতা সীমানার খুঁটি, আর কাঁটাতার অতিক্রম করে বলতে চায় এই শুভ বাক্য: 'মানুষেরও প্রয়োজন নিয়মিত নিড়ানি।' মনে পড়ে চেনা গান: 'এমন মানবজমিন রইল পতিত, আবাদ করলে ফলতো সোনা'
মানুষে মানুষে বিভাজন আজকের জ্বলন্ত সমস্যা, এ-বিষয়ে সচেতন সুমন তাই লেখেন:
'আমাদের সমবেত নৈঃশব্দ্য নিঃশর্ত স্তব্ধতাদের জন্ম দিয়েছে দেখা গেল,
আমাদের সমবেত অন্ধত্ব পেল পৃথিবীর গভীরতম অন্ধকার'
আজকের মানুষের বিচ্ছিন্নতা এভাবে জন্ম দিচ্ছে এক সমবেত নৈঃশব্দ্য, সমবেত অন্ধত্ব, যেখান থেকে যেন প্রতিবাদহীন প্রগাঢ় অন্যায় ঘটে যায় সমাজে। আগের উল্লিখিত কবিতায় কাঁটাতারের বিভাজন পীড়িত করেছে কবিকে। তবু এই কবিতার শেষ পংক্তিতে রচিত হয় আশ্চর্য এক প্রবাদ যেন:
'আমরা কিছুতে নই, জানি, পৃথিবীতে হয়ত কিছুটা সবুজ এখনও অধরা রয়েছে।'
সেই কৃষিজমি, সেই অধরা সবুজের দিকে চোখ রাখেন সুমন, তার কবিতা।আসলে সবুজ মানেই নিরাময়, সবুজ মানেই আরোগ্য আর শুশ্রূষা, সেদিকেই ফিরে চান সুমন।
একটি আশ্চর্য কবিতায় চোখ রাখি, সুমনের লিখন-মুন্সিয়ানা পাঠক এড়াতে পারবেন না:
'মাংস সুসিদ্ধ হলে কিছুক্ষণ অমরত্ব পায় প্রয়াত রেওয়াজি খাসিটি
স্বল্প জীবনকালে সামান্য হাসিটি দিয়ে ঘাস ছিঁড়েছিল দাঁতে
অথবা কষাই, যিনি পরম নিষ্ঠাভরে পছন্দ করেছেন তাকে
অভিজ্ঞ জহুরীর চোখ তো দেখনি
গন্ধমাদনের জঙ্গল থেকে অনায়াসে খুঁজে পান মহার্ঘ বিশল্যকরণী।'
এই কবিতায় লক্ষ্যণীয় শ্লেষ আর বিদ্রূপ, কিন্তু তা সহজাত দক্ষতায় রচিত। অমরত্ব তো এক স্বর্গীয় বিষয়, শাশ্বত ও মহাকাব্যিক, তবু 'কিছুক্ষণ অমরত্ব পায়'-এই শব্দবন্ধে শাশ্বত ও স্থির অমরত্বকে ট্রানজিয়েন্ট বা ক্ষণস্থায়ী আকার দেওয়া হলো কাব্যিক দক্ষতায়। রেওয়াজি খাসির আগে 'প্রয়াত' শব্দটি এ কবিতায় অমরত্ব তথা শাশ্বত ধারণাকে বিদ্রূপে বিদ্ধ করে। মাংস সুসিদ্ধ হওয়াতেই যেন খাসির স্বল্প জীবনের সার্থকতা ও মাহাত্ম্য। লক্ষ্য করুন, উল্লিখিত শেষ পংক্তি:
'গন্ধমাদনের জঙ্গল থেকে অনায়াসে খুঁজে পান মহার্ঘ বিশল্যকরণী।'
মহাকাব্যের বিশল্যকরণী খুঁজতে অসমর্থ হনুমান তো আস্ত গন্ধমাদন পর্বত তুলে নিয়ে এসেছিলেন, কিন্তু এখানে তা পর্বত নয় বরং জঙ্গল, এবং, তা অনায়াসে, এই কবিতায়, খুঁজে পেয়ে যান অভিজ্ঞ জহুরী। আসলে প্রথমে উল্লিখিত প্রয়াত খাসির হাস্যকর অমরত্বের অনুষঙ্গে যেন এক অলীক মৃতসঞ্জীবনীর অবতারণা, মহাকাব্য ভেঙে।
কিন্তু, এই কবিতার শেষে রচিত হয় অসামান্য কয়েকটি পংক্তি, যা রূপকের আড়ালে নির্দেশিত করে চরৈবতি জীবনের এক অলীক অমরত্বের সরাইখানার:
'গুটিকয় কারও কাছে পাঠক্রম সূচিপত্র অনুযায়ী আসে
বাকিরা আজীবন ছুটতে ছুটতে ভাবে হয়ত সামান্য পথ আর বাকি
অন্ধকার নামার আগেভাগে অমরত্বের সরাইখানাতে পৌঁছবে।'
কবি এক ধরণের জীবনকে জড়িয়ে ধরেন এবং অন্য এক জীবনকে প্রত্যাখ্যান করেন। এই প্রত্যাখ্যান আসলে অন্য এক আকাঙ্খিত জীবনেরই বিপ্ৰতীপ রূপ, তা এভাবে ধরা পড়ে সুমনের কবিতায়:
'অথবা কাঙাল-কথা, ঘুরে ফিরে মেঙে যাবে অর্থ যশ সচ্ছলতা
প্রাপ্ত সবকিছু সয়ে যায় দ্রুত, অধিকার বোধ টুকু গভীরে প্রোথিত
সামান্য সুযোগে লাউডগা লকলকে ফণা তুলে পৃথিবীতে সোচ্চার।
তোমাদের কাছাকাছি দেখে এগিয়েছে সে পায়ে পায়ে দ্বিধাজরজর
তার কাঁচা ঘুম ভাঙা সারল্য দেখে ভুল হয়ে যায় আপামর মানুষের
সবুরের মেওয়া কুঁড়ি দেখা গেছে উড়েছিল আলো সেই ফানুষের।'
এক অদ্ভুত মধ্যবিত্ত কেরিয়ারিস্ট জীবনের চিরচেনা অর্থ যশ ও সচ্ছলতার চাহিদার প্রতি চপেটাঘাত ও ধিক্কার এই কবিতায়। 'মেঙে'-এই চলতি শব্দটির উপযোগী প্রয়োগ, নির্বিষ লাউডগার ফণা তোলার ছবি এই কাঙাল-কথার ডিপ্রাইভড উপাখ্যানকে যেন অব্যর্থ করে তোলে। সবুরে মেওয়া ফলে, কিন্তু 'সবুরের মেওয়া কুঁড়ি' এক অপূর্ব প্রয়োগ, যা সুমন হয়ত সহজেই পারেন। স্পষ্টতই ‘দ্বিধাজরজর’ ও ‘কাঙাল’ মধ্যবিত্ত জীবনের প্রতি এক ধরণের প্রত্যাখ্যান এ-কবিতায়। এই কবিতার শেষ দুই পংক্তি এরকম:
'অথবা কাঙাল-কথা, শাক ভাতে বিশ্বাস সত্ত্বেও সত্যিটা কিছুতে মানবে না-
গায়ে লেগে থাকা আলোটুকু ছাড়া আর কিছু কখনোই দেখা যায় না।'
এই সেই কাঙাল মধ্যবিত্ত চাহিদা, শাক ভাতে বিশ্বাস করে, তবু যে অর্থ ও সচ্ছলতার কাঙাল, যার সহজাত কোনো আলো নেই। তবু শাক ভাতের উল্লেখ এখানে যেন এক অদেখা ইঙ্গিত রেখে যাচ্ছে। লিখতে লিখতেই মনে হলো, বনপর্বে যক্ষ যুধিষ্ঠিরকে প্রশ্ন করেন, সুখী কে। এর জবাবে যুধিষ্ঠির বলেন, দিনান্তে অন্যের কাছে কোনো ঋণ না রেখে যিনি আত্মীয় ও প্রতিবেশীর সঙ্গে শাকান্ন ভাগ করে খান, তিনিই প্রকৃত সুখী। সেই শাক ভাতের সুখে কি আস্থাভাজন কবিও? জানিনা।
আশেপাশের দেখা লৌকিক আচারের প্রতি অনাস্থা আর অনুকম্পা রেখে যান সুমন, এভাবে:
এইখানে আশ্রয় পেলে, নদীটির পাশে, ক'দিন রয়েছ বসে
চাপা পড়া ঘাসগুলি হলদে হয়েছে ক্রমে, বাকিরা ফ্যাকাসে
তবু মৃত্যু নিকটে এলে বেঁচে থাকা শৃঙ্খলাপরায়ণ হয়
সময়ে পড়তে বসে প্রতিটি বালক, তড়িঘড়ি অফিসেও যায়
নদীটির তাড়া নেই, কয়েকশো বছরের পলি বুকে জমে
হাপরের মতো শ্বাস টেনে আজকেও শেষ খেয়া পার করে ক্রমে।
এখানে রয়েছ তুমি, জরিপাড়, রং কিছু রয়েছে এখনও
মাটি খসে খড় বাঁশ বেরিয়েছে রৌদ্রে প্রকাশ্যে কোথাও
বাহনের চোখ গেছে তাও দেখ একঠায়ে রয়েছে দাঁড়িয়ে
কান খাড়া নদী তাক করে, ভাবখানা কেউ বুঝি যাব এনে দিয়ে
বলে দেবে-যত খুশি খাও। তুমিও কি ভাবছ না মনে
সারা শহরের লোক হত্যে দিয়েছিল স্বীয় সংকল্পসাধনে উৎসব রাতে
রাশি রাশি নৈবেদ্য তোমার, উপবাসক্লিষ্ট তৃষ্ণার্ত ম্লান মুখগুলি
হীরের মতোই জ্বলে খালি পেটে, জামাহীন কাঠি, শরীরে অজস্র মাদুলি।'
শ্লেষ ও বিদ্রূপে, দ্বিধাহীন ভাষায় লোকাচার আর কোনো এক থানের প্রতিমা ও তার পারিপার্শ্বিক আবহ রচনা করেন সুমন।আশ্চর্যভাবে রচিত হয় এক লোকজীবনের সাধারণ সূত্র, এই কটি পংক্তিতে:
'তবু মৃত্যু নিকটে এলে বেঁচে থাকা শৃঙ্খলাপরায়ণ
সময়ে পড়তে বসে প্রতিটি বালক, তড়িঘড়ি অফিসেও যায়'
মৃত্যু, পরীক্ষা, অফিসের ডেডলাইন সব যেন অনিশ্চয়তার টেনশনে ভরা, সেজন্যই বা মানুষের অতি শৃঙ্খলাপরায়ণতা। আর এজন্যই হয়ত সাধারণ মানুষ দেবতার কাছে মানত করে। উপবাস করে মানুষ, কিন্তু পাথরের মূর্তির সামনে পড়ে থাকে নৈবেদ্য, এই লোকাচারের নিহিত অর্থহীনতা তুলে ধরেন সুমন।
এই হলেন সুমন, যিনি তাঁর কবিতায় নিবিড় এক জীবনে হাত রাখতে চান, অন্যদিকে প্রত্যাখ্যান করেন আরেক অনাকাঙ্খিত জীবনকে। তাই সুমনের কবিতা আসলে জীবনেরই আখ্যান।
পরিশেষে, ‘এক ব্যাগ নব্বই’য়ের এই অভিনব উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। ইচ্ছে রইল বাকি কবিতা নিয়েও ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া ভাগ করে নেওয়ার। পাঠকদের অনুরোধ করি বইগুলি পড়ুন, লুপ্ত সময় আবিষ্কার শুধু নয়, কবি-ভাবনার মরমী অংশীদার হয়ে নিজেকেও ঋদ্ধ করুন। কবিতা ছাড়া আর কোথায় এই ভাঙ্গাচোরা পৃথিবীর অমলিন শুশ্রূষা পাবেন?
পাখিয়াল/ সায়ন কর ভৌমিক প্রকাশক: গুরুচন্ডালি প্রচ্ছদ: চিরঞ্জিত সামন্ত মূল্য: 20 টাকা
ফোনঘর/ সুমন মান্না প্রকাশক: গুরুচন্ডালি প্রচ্ছদ: চিরঞ্জিত সামন্ত মূল্য: 20 টাকা
No comments:
Post a Comment