কলেজ স্কোয়ারের বাঁধানো পুকুরটা আড়াল করে আছে গাছগুলো। পাতার অন্তরালে বিদায় নিচ্ছে আজকের
আলো।ঠিক এমন গোধূলিতে একজন মহিরূহ চলেছেন ধীর পদক্ষেপে।আশপাশ সম্ভ্রমে কোলাহল
স্তব্ধ করে দেখে নিচ্ছে তাঁকে।একটা একটা করে ধাপ পার হয়ে তিনি আরো ওপর দিকে দৃষ্টি
নিবদ্ধ রেখেছেন।দীর্ঘ দেহ পক্ক কেশ মুখে প্রশান্ত হাসি।ইনি কবি ও দার্শনিক
কালীকৃষ্ণ গুহ।জোতির্ময় এই পুরুষ আপনার বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র।
2019 বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রাসঙ্গিক কবিতার বই "বাড়িটা অন্ধকার হয়ে আছে " প্রকাশক অহিরা।
একদম নামকরণ থেকেই বোঝা যায় কবি তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখছেন আমাদের যাপন বাড়ি আমাদের মনন বাড়ি আজ মধ্যযুগীয় আঁধারাচ্ছন্ন।
কবিতাগুলি লেখা হয়েছে জানুয়ারি 2016থেকে মার্চ 2017 সময়কালের মধ্যে।
ভূমিকা বা গোড়ার কথা নয় তিনি বইটি সূচনা করেছেন এই বইটির কয়েকটি কবিতার কোলাজ , 'মুখপাত' নামে।
'মিত্রার জন্য' থেকে 'যজ্ঞশালা'অবধি ছাপ্পান্নটি কবিতা।
প্রতিটি কবিতা এক অদ্ভুত আবেশ তৈরি করে দেয় মনের মধ্যে।কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হয়।
একটি সাধারণ চিত্রকল্প নিয়ে যে কবিতা শুরু হয় তা শেষ হয় অতীন্দ্রিয় অনুভূতি তে।একটি সাধারণ দৃশ্য আর সাধারণ থাকছে না।ইঙ্গিত করছে একটি ধ্রুব সত্য বা আবহমানতাকে।বোধহয় একেই বলা যায় ট্রান্সেন্ডেন্টালিসম।প্রসঙ্গত
সুররিয়ালিস্ট কবি কালীকৃষ্ণ গুহ ষাটের দশকের সাহিত্যিক।প্রথম বই প্রকাশ 1967।
আমাদের কবিতা পরিক্রমা শুরু হয় মিত্রার সঙ্গে মেপল গাছের বন্ধুত্বে যা সময়ের গতিবেগের সঙ্গে সাযুজ্য সৃষ্টি করে।
"বাড়ি"(পৃষ্ঠা ষোলো)তে এসে দেখি
...."যে বাড়ির মালিক শেষ জীবনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতেও অমর হবার কথা ভাবতেন",কবি দৌড়ে বাড়িটা পার হয়ে যান আর পেছনে কয়েকটি কুকুর তাড়া করে।পাঠক যখন কবিতাটি বিনির্মাণ (deconstruction)করেন মানুষের সেই অনন্ত প্রয়াস উন্মোচিত হয়।আমরা এই অন্ধকার বাড়ি (পার্থিব জগত) থেকে যত সরে যেতে চাই কাম ক্রোধ প্রভৃতি রিপু আমাদের তাড়া করে বেড়ায়।
এই কবিতা পরিক্রমায় আমরা মুখোমুখি এক রাক্ষসের যার পা দুটো ফোলা,হাত সরু ,সে জাদুঘরের সামনে লোহার চেয়ারে বসে কাঁদে।পরাবাস্তবচেতনার একটি দৃষ্টান্ত।ব্যক্তিগত ন্যারেটিভে লেখা কবিতাগুলি শুরু হয় সাধারন দৃশ্যকল্প দিয়ে অন্তিম বাক্যে যা এক অসীম অনুভবে চিরন্তন সত্য প্রকাশ করে।
দুটি বাদে প্রায় সব কবিতা তাই শেষ হয় কোনো যতি চিহ্নবিহীন কয়েকটি ডট মাত্র দিয়ে।কবি কী আবহমানতাকে বোঝাতে চান! As a symbol of infinity?এই ডটগুলি আমাদের লাঁকার তত্ত্বটির কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই অন্ধকার পথে কবি একটি আলো জ্বেলে রাখেন দার্শনিক জেনোফোনের কথা ভেবে।একটি জ্ঞানের আলো "যা কিছু প্রকৃতি থেকে আসে তার মধ্যে সত্য ও সরলতা আছে"(জেনোফোন),
কবি কালীকৃষ্ণ গুহর একটি নিজস্ব ডিকশন আছে।প্রত্যেকটি কবিতার শেষে একটু স্পেস দিয়ে মূল ভাবার্থ টি সামিং আপ করেন একটি মেটাফর বা এলিগরির সাহায্যে।পাঠকের ডিকনস্ট্রাকশন এখানে শুরু।
কয়েকটি কবিতা অতি ব্যক্তিগত কথপোকথন যেন।কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছি কতদিন......তিনি লিখেছেন "তুমি ঘুমিয়ে পড়লে
কী ভাগ্য!(ভাগ্য)" দারুণ এক আর্তি ফুটে ওঠে।......"তুমি ঘুমিয়ে পড়ে আরো সুন্দর হয়েছ" চমকে উঠি এ ত আমার কথা," তোমাকে দেখতে পাব---/শুধু এই প্রত্যাশা নিয়ে এই সভায় এসেছি "।(বকুলগাছ)একই সময়ে তাঁর কবিতাটি পড়ে আমিও বকুলগাছের কবিতা লিখেছি মনে পড়ে।কোথাও মুদ্রিত হয়েছিলো।
বেশিরভাগ কবিতাই গদ্যে লেখা।কিছু কবিতা স্বরবৃত্তে (পূর্ণিপুকুর),আবার মন্ত্রপাঠ কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত টানা দশমাত্রায় গদ্যের ঢঙে লেখা।
এই বইটির বেশ কিছু কবিতা কনফেশনাল বা নিজস্ব স্বীকারোক্তি মূলক।একটি কবিতা আমাদের স্তব্ধ করে দেয় যখন কবি বলছেন "জুয়োখেলে বড়লোক
হওয়া যায় এই প্রশ্ন নিয়ে ফুটপাথের আলোচনা সভা"............"আমিও কি ওই সভায় অংশগ্রহণ করিনি?
আমিও কি ওদের একজন নই!"যেন এই হাহাকার আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এক অদ্ভুত বিপন্নতায়।
"সোফোক্লিস " কবিতায় .......
"একজন আরেকজনকে বলছে
'আপনি এত মহত্ যে,আপনার আর কবিতা লেখা উচিত নয় ।'......শেষ লাইনে" সোফোক্লিসের কথাটা ভাবতে ভাবতে চারিদিক/অন্ধকার হয়ে এল......"(এল ,এলো নয় এখানে)।
বইটি পড়ার পর প্রশ্ন জাগে রচয়িতা মূলত দার্শনিক না কবি।
শেষ লাইনগুলিতে কবি পাঠকের ওপর বিনির্মাণের দায়িত্ব সঁপেছেন।
কবি,ভাষাবিদ ও প্রকাশক সেলিম মল্লিককে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন একটি বই অতি যত্ন সহকারে প্রকাশ করার জন্য। প্রচ্ছদ যথাযথ আমাদের এই সামাজিক অস্থিরতা ও দ্বন্দ্বের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে।
প্রকৃত পাঠক সমৃদ্ধ হবেন বইটি পড়লে।বার বার পড়ার মতো "বাড়িটা অন্ধকার হয়ে আছে "।
2019 বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রাসঙ্গিক কবিতার বই "বাড়িটা অন্ধকার হয়ে আছে " প্রকাশক অহিরা।
একদম নামকরণ থেকেই বোঝা যায় কবি তাঁর অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখছেন আমাদের যাপন বাড়ি আমাদের মনন বাড়ি আজ মধ্যযুগীয় আঁধারাচ্ছন্ন।
কবিতাগুলি লেখা হয়েছে জানুয়ারি 2016থেকে মার্চ 2017 সময়কালের মধ্যে।
ভূমিকা বা গোড়ার কথা নয় তিনি বইটি সূচনা করেছেন এই বইটির কয়েকটি কবিতার কোলাজ , 'মুখপাত' নামে।
'মিত্রার জন্য' থেকে 'যজ্ঞশালা'অবধি ছাপ্পান্নটি কবিতা।
প্রতিটি কবিতা এক অদ্ভুত আবেশ তৈরি করে দেয় মনের মধ্যে।কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হয়।
একটি সাধারণ চিত্রকল্প নিয়ে যে কবিতা শুরু হয় তা শেষ হয় অতীন্দ্রিয় অনুভূতি তে।একটি সাধারণ দৃশ্য আর সাধারণ থাকছে না।ইঙ্গিত করছে একটি ধ্রুব সত্য বা আবহমানতাকে।বোধহয় একেই বলা যায় ট্রান্সেন্ডেন্টালিসম।প্রসঙ্গত
সুররিয়ালিস্ট কবি কালীকৃষ্ণ গুহ ষাটের দশকের সাহিত্যিক।প্রথম বই প্রকাশ 1967।
আমাদের কবিতা পরিক্রমা শুরু হয় মিত্রার সঙ্গে মেপল গাছের বন্ধুত্বে যা সময়ের গতিবেগের সঙ্গে সাযুজ্য সৃষ্টি করে।
"বাড়ি"(পৃষ্ঠা ষোলো)তে এসে দেখি
...."যে বাড়ির মালিক শেষ জীবনে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতেও অমর হবার কথা ভাবতেন",কবি দৌড়ে বাড়িটা পার হয়ে যান আর পেছনে কয়েকটি কুকুর তাড়া করে।পাঠক যখন কবিতাটি বিনির্মাণ (deconstruction)করেন মানুষের সেই অনন্ত প্রয়াস উন্মোচিত হয়।আমরা এই অন্ধকার বাড়ি (পার্থিব জগত) থেকে যত সরে যেতে চাই কাম ক্রোধ প্রভৃতি রিপু আমাদের তাড়া করে বেড়ায়।
এই কবিতা পরিক্রমায় আমরা মুখোমুখি এক রাক্ষসের যার পা দুটো ফোলা,হাত সরু ,সে জাদুঘরের সামনে লোহার চেয়ারে বসে কাঁদে।পরাবাস্তবচেতনার একটি দৃষ্টান্ত।ব্যক্তিগত ন্যারেটিভে লেখা কবিতাগুলি শুরু হয় সাধারন দৃশ্যকল্প দিয়ে অন্তিম বাক্যে যা এক অসীম অনুভবে চিরন্তন সত্য প্রকাশ করে।
দুটি বাদে প্রায় সব কবিতা তাই শেষ হয় কোনো যতি চিহ্নবিহীন কয়েকটি ডট মাত্র দিয়ে।কবি কী আবহমানতাকে বোঝাতে চান! As a symbol of infinity?এই ডটগুলি আমাদের লাঁকার তত্ত্বটির কথা মনে করিয়ে দেয়।
এই অন্ধকার পথে কবি একটি আলো জ্বেলে রাখেন দার্শনিক জেনোফোনের কথা ভেবে।একটি জ্ঞানের আলো "যা কিছু প্রকৃতি থেকে আসে তার মধ্যে সত্য ও সরলতা আছে"(জেনোফোন),
কবি কালীকৃষ্ণ গুহর একটি নিজস্ব ডিকশন আছে।প্রত্যেকটি কবিতার শেষে একটু স্পেস দিয়ে মূল ভাবার্থ টি সামিং আপ করেন একটি মেটাফর বা এলিগরির সাহায্যে।পাঠকের ডিকনস্ট্রাকশন এখানে শুরু।
কয়েকটি কবিতা অতি ব্যক্তিগত কথপোকথন যেন।কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়েছি কতদিন......তিনি লিখেছেন "তুমি ঘুমিয়ে পড়লে
কী ভাগ্য!(ভাগ্য)" দারুণ এক আর্তি ফুটে ওঠে।......"তুমি ঘুমিয়ে পড়ে আরো সুন্দর হয়েছ" চমকে উঠি এ ত আমার কথা," তোমাকে দেখতে পাব---/শুধু এই প্রত্যাশা নিয়ে এই সভায় এসেছি "।(বকুলগাছ)একই সময়ে তাঁর কবিতাটি পড়ে আমিও বকুলগাছের কবিতা লিখেছি মনে পড়ে।কোথাও মুদ্রিত হয়েছিলো।
বেশিরভাগ কবিতাই গদ্যে লেখা।কিছু কবিতা স্বরবৃত্তে (পূর্ণিপুকুর),আবার মন্ত্রপাঠ কবিতাটি অক্ষরবৃত্ত টানা দশমাত্রায় গদ্যের ঢঙে লেখা।
এই বইটির বেশ কিছু কবিতা কনফেশনাল বা নিজস্ব স্বীকারোক্তি মূলক।একটি কবিতা আমাদের স্তব্ধ করে দেয় যখন কবি বলছেন "জুয়োখেলে বড়লোক
হওয়া যায় এই প্রশ্ন নিয়ে ফুটপাথের আলোচনা সভা"............"আমিও কি ওই সভায় অংশগ্রহণ করিনি?
আমিও কি ওদের একজন নই!"যেন এই হাহাকার আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় এক অদ্ভুত বিপন্নতায়।
"সোফোক্লিস " কবিতায় .......
"একজন আরেকজনকে বলছে
'আপনি এত মহত্ যে,আপনার আর কবিতা লেখা উচিত নয় ।'......শেষ লাইনে" সোফোক্লিসের কথাটা ভাবতে ভাবতে চারিদিক/অন্ধকার হয়ে এল......"(এল ,এলো নয় এখানে)।
বইটি পড়ার পর প্রশ্ন জাগে রচয়িতা মূলত দার্শনিক না কবি।
শেষ লাইনগুলিতে কবি পাঠকের ওপর বিনির্মাণের দায়িত্ব সঁপেছেন।
কবি,ভাষাবিদ ও প্রকাশক সেলিম মল্লিককে অসংখ্য ধন্যবাদ এমন একটি বই অতি যত্ন সহকারে প্রকাশ করার জন্য। প্রচ্ছদ যথাযথ আমাদের এই সামাজিক অস্থিরতা ও দ্বন্দ্বের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে।
প্রকৃত পাঠক সমৃদ্ধ হবেন বইটি পড়লে।বার বার পড়ার মতো "বাড়িটা অন্ধকার হয়ে আছে "।
This comment has been removed by the author.
ReplyDeleteএকটি শক্তিশালী কবিতার বই, দার্শনিকতায় ভরা।
ReplyDeleteঐ যে পঙক্তি:ফুটপাথে ভিখিরিদের আলোচনা সভা,জুয়া খেলে বড়লোক হওয়া যায় কিনা।
এ প্রশ্ন আমাদেরও। নয়কি! একটা চাবুক থাপ্পড় যেন।
একটি শক্তিশালী কবিতার বই, দার্শনিকতায় ভরা।
ReplyDeleteঐ যে পঙক্তি:ফুটপাথে ভিখিরিদের আলোচনা সভা,জুয়া খেলে বড়লোক হওয়া যায় কিনা।
এ প্রশ্ন আমাদেরও। নয়কি! একটা চাবুক থাপ্পড় যেন।