Wednesday, April 10, 2019

চার অধ্যায় - সন্দীপন চক্রবর্তী




শুধু তো দেবর্ষি নয়, 'মগজে সামান্য মেদ' জমেছে তো আমাদের সকলেরই কেউ টের পাই, কেউ পাই না 'তুমি তো পতঙ্গপ্রাণ, স্বভাবত অতিগুঞ্জরন / কিছুটা আয়ত্ত করে দিগন্তে তাকিয়ে থাকো' সেইসময়ে একমাত্র একজন কবিই স্পর্ধাভরে বলতে পারে, 'তোমাকে আশ্চর্য করে স্মৃতিগুচ্ছ ভেঙে চলে যাব / আমি যদি ফিরে আসি / ক্রমাগত ফিরে ফিরে আসি' আর ফিরে আসলে তখন দেখা যায় তার হাঁ-মুখ, তার 'খিদে'  দেখি -- 'আর আমি দিনান্তে রাখি ক্লেশ / নিজস্ব গ্রহাণুপুঞ্জ খুঁটে খাই / ব্রহ্মাণ্ডবিশেষ' টের পাই, 'আমাদের ভয়গুলি / পালকশরীর নিয়ে / মায়ের গভীরে শুয়ে থাকে' আবার 'তার পেটে ব্রহ্মাণ্ড শুয়ে', যেখানে সে দেখতে পায়, 'প্রতি রাতই গর্ভপাত, কাঁচা ভ্রূণ ঝোলে শাখে শাখে / মানুষ শিকার চেনে শিকারও চিনেছে কিছু তাকে' তাই সে লেখাকে নিয়ে যেতে চায় 'আপাতত ভাষার অতীত / গমনেরও অতীত প্রহরে' সে নিজেকে দেখতে চায় না ওই মঞ্চে, যেখানে 'সে তখনো অনর্গল বকে যাচ্ছে বিবিধ বিষয়ে / শুধুমাত্র হাততালির লোভে' বরং সে চায় -- 'লবণের স্বাদ ভেবে চেটে ফেলি অলীক নিশানা' যদিও একদিকে সে বলে 'তোমাকে উদোম করে কপিকলে হে মনীষা / ঝুলিয়ে রেখেছি', তবু 'জানি, অবশেষে বিফলে যাবে না' লোকায়ত ধর্মদর্শনে যেমন থাকে, এখানে দেবর্ষির কবিতাতেও দেখবো ব্রহ্মাণ্ড বা মহাশূন্য ধরা পড়ছে শরীরের মধ্যে দিয়ে তাই 'শরীর ফলিতবিদ্যা -দেহ নশ্বর' আবার এরই পাশাপাশি খুব সহজেই লিখে রাখা যায় 'অথচ আমার কথা আত্মারাম জানে না কখনো' এইসব টানা পোড়েনের জটিল বুনোটের মধ্যে দিয়ে সে শেষ পর্যন্ত যে উপলব্ধিতে পৌঁছয়, সেখানে সে টের পায়, 'জ্বরের বিরতি নেই, ক্ষণজন্মা মানুষেরা শুধুমাত্র এই কথা জানে' আসলে তো যেকোনো কবিরই লেখার মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠতে চায় তার সেই জ্বর-জ্বর ইচ্ছেগুলিই সেভাবেই হয়তো আমরা পৌঁছে যেতে পারি শ্রীদর্শিনীর লেখায়
২.
এখন মুম্বাই থাকে আরবসাগর ছুঁয়ে থাকে তবু তার 'জ্বর-জ্বর ইচ্ছেগুলি' আজও ঢেউশীর্ষে জেগে থাকা বুদবুদের মতো ছড়িয়ে পড়ে বাংলা ভাষায় সেইসব ইচ্ছেগুলি 'হৃদমাঝারে দাঁড়ায়, / আর শব্দ রাখে ঠোঁটে, / যতই দূরে ঠেলি / ভবিতব্য হয়ে ওঠে' তাই কবিতা লিখতেই হয় শ্রীদর্শিনীকে, যদিও তার আরেক প্রেম গান এখানেও তাই বারবার ফিরে আসে গানের প্রসঙ্গ, সুরের প্রসঙ্গ, বান্দ্রা আর জুহু বিচের ছবি জড়িয়ে তার বেঁচে থাকা আর যাপন ফেটে বেরিয়ে আসতে চাওয়া সেই 'জ্বর-জ্বর ইচ্ছেগুলি' যেন সুরেরই গড়ন বেয়ে নেমে আসতে থাকে লেখাগুলি তাই বই শুরুই হয় 'ভৈরবী' দিয়ে এগোতে এগোতে, আমরাও টের পাই: 'সময় জানে নতুনতর মুগ্ধতা' সেই পথ বেয়ে প্রায় ডায়েরির ভঙ্গীতে যেন একে একে নেমে আসে 'না হওয়ার গল্পগুচ্ছ' আর সেই যাপনের মাঝেই সে টের পায় 'লাল, ঝুলন্ত কোনো এক ট্র্যাফিক সিগন্যালে / রুপোলি বুদবুদ তৈরির জাদুকাঠি বিক্রি করছে / যে-ছোট্ট, একহারা, বড়োচোখ, কালো মেয়েটি, / তার অন্য নাম গান' জুহু বিচে ঘুরতে ঘুরতে 'গোড়ালির শূন্যতা'- দিকে তাকিয়ে, তার মনে হয় 'চতুর্দিকে দোকানপাট অসমপিকা ক্রিয়ার মতো ঘিরে আছে' বোঝে -- 'কবিতা তোমার নয়, কবিতা আমারও নয় / কবিতা একলা, / বোকা, / আর একরোখা খুব -- / কবিতা আসলে অন্য যেকোনো কিছুর মতো / জীবন্ত এবং নিরুপায়' ফলে 'ভুলে যাব শিশুমৃত্যুগুলি / ভুলে যাব সিরিয়া, ভুলে যাব কৃষকের ভূখ' ভাবলেও, সে ভুলতে পারে না দেখে, 'অথচ আমার কানে জটিল রোগের মতো / স্নায়ু তুলে দিয়েছে চিৎকার' আর তাই 'আপাতমস্তক বন্দি রূপের ক্ষতের নীচে / তখনো পায়ের পাতা বিদ্রোহ করে জেগে থাকে' তারই আরেক নাম -- ভালোবাসা আর তখন 'তোমাকে রক্তিম দেখলে হিংসে হয়, / পাণ্ডুরবর্ণ দেখলে জ্বর-জ্বর ইচ্ছেগুলি হয়' এই 'রোশনাইয়ের দীর্ঘ সংলাপ শেষে' তাই বইয়ের শেষ কবিতা হয়ে ওঠে 'বিজয়া দশমী' টের পাই -- 'বিয়োগফলের গায়ে নুন ছড়াও হে হিম কুয়াশা -- তারও তো সুস্বাদু হতে হবে'! কিন্তু একইসঙ্গে কি কেউ ছড়িয়ে থাকতে পারে না কাছে আর দূরে?
৩.
ঐত্রেয়ীর বইয়ের নাম 'হাঁটু মুড়ে বসে আছি গৃহদ্বারে' কিন্তু প্রবেশক কবিতাতেই বুঝে যাই যে, গৃহদ্বার ছাড়িয়ে অনেক দূরে, 'নক্ষত্রে গেঁথে গেছে' তার উদাসীন আঙুল সে আঙুল ছুঁতে চায় এক নদী আর তার স্রোত, যে স্রোত আমরা টের পাই দিনানুদিনের বাঁচায় 'কাব্যিক'-এর বদলে তার ভাষা তাই টেনে নেয় একধরণের গদ্যের চাল, যাতে ওই 'কাব্যিকতা'-কে হাতে ধরা 'একটি মাত্র নির্মোহ আলপিন' দিয়ে ফুটো করে দেওয়া যায় যাতে 'সময়'-এর পথ ধরে তৈরি হয়ে উঠতে পারে জীবনের স্বাভাবিক স্রোতের 'সম্ভাবনা' সেই যাপনে পৌঁছবার জন্যই বেরোয় 'শিকার পার্টি', যেখানে এই ডাক খুব জরুরী হয়ে ওঠে যে -- 'কে কোথায় আছ / লৌহ শলাকায় বাঁধো / স্রোতের অবিন্যস্ত চুল' 'সুতরাং শান্ত স্নায়ু / গুনে গেঁথে বাঁচার লড়াই'-তে আমরা গড়ে তুলি নানা 'সত্যি-মিথ্যে গল্প' আর সেই গল্পের ব্যক্তিগত আমি-টি একসময়ে প্রসারিত হয়ে যায় পুরো 'ছায়াপথ'- চেতনায় নামে 'প্রথম বৃষ্টি' আর আমরা বিদ্রোহ ঘোষণা করি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে -- 'আগুন জ্বলে ওঠো / জ্বলে ওঠো ঈশ্বরের গায়ে' আমরা ভর করে থাকতে চাই 'প্রেম'- অথচ দেখি শুধু 'পাতায় পাতায় মূর্তিমান ভয়ের জন্ম হয়' কিন্তু 'ভীতুরা কি কবিতা লিখতে পারে'? এর উত্তর খুঁজতেই তো আমরা 'যাযাবর'-এর মতো 'গুপ্ত সংকেত-ভর্তি খাতা নিয়ে / ঘুরে বেড়াই পাহাড়ে পাহাড়ে' আর 'আমি আমার মতো পুড়ি / ছাইভস্ম কবিতায়' তারপর একদিন 'জাগতিক নিয়মেই / শুরু হয় সব শেষ হওয়া' তখন 'শিল্প'- চামড়া সরিয়ে উঁকি মারে মাংসের লাল বলতে হয় -- 'হে কাব্য ধ্বংস করো / গতজন্মে পাওয়া বর্ম আমার' নিজের জ্যান্ত লাশের দিকেই 'তর্জনী' তুলে তখন বলতে হয় -- 'অস্ফুটে বলে দাও / আত্মঘাতের মানে' কিন্তু 'দিনলিপি'- কি কখনও হয়ে উঠতে পারে না শিল্প? এই যাপনের নির্যাস যদি ধরে রাখে সেই দিনলিপি? তার উপরে ছাড়া, আর কার উপরেই বা নির্ভর করবো? তাই 'কালির আঁচড়েই দেখি / মুছে গেছে সব সন্দেহ' চেতনার নিরাশ্রয়তা যেন এই সমে এসে আবার তার ঘর পেয়ে যায়, পেয়ে যায় আশ্রয় কিন্তু যদি কোনো আশ্রয় না মেলে? যদি তাকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় কোনো কর্কটরেখা? এই কর্কটরেখাই কি ফুটে ওঠে দীপ্তিপ্রকাশের কবিতায়?
৪.
কাকে বলে কর্কটরেখা? সে কি শুধুই পৃথিবীর উপর দিয়ে চলে যাওয়া এক কাল্পনিক রেখা? এই পৃথিবীর উপর টিঁকে থাকা আমাদের এই যে জীবন, তার সঙ্গে নাড়ির যোগে জড়িয়ে থাকা কাউকে যদি ছিনিয়ে নেয় কর্কটরোগ, তাহলে জীবনের শোকের পাথর ফেটে বেরিয়ে আসা ক্ষরণ যেসব রেখা এঁকে দেয়, সে- কি কর্কটরেখাই নয়? হয়তো তার উপর দেখা যায় 'কর্কট গাছটি, তার পোকা লাগা নরম গোড়ায় / জল ওষুধ রেখে মিথ্যে বলি প্রতিবার -- ভালো হয়ে যাবে' তারপর একসময়ে মুখোমুখি হতে হয় সেই সত্যের, যার মুখোমুখি হতে চাই না কোনোভাবেই দেখি 'পৌষের মাঠ জুড়ে পড়ে আছে গলাকাটা ধান'দেখি 'হাওয়ায় মৃত্যুগন্ধ, সমবেত মুখ ঝুঁকে ক্যামেরার দিকে / ঘন ঘন আলো পড়ছে, ইশারায় সরে যাচ্ছে প্রতিটি আঙুল' আর তখন, শরীরের বদলে থাকে 'বোবা -শহরে শুধু স্মৃতির চাদর মেলে দেওয়া' তাই তার কথা বলতে গেলে আবার স্মৃতির বদলে ধারণ করতে হয় ভাষা, স্মৃতিকে বলতে হয় -- 'তুমিই শিখিয়ে দাও ভুলে থাকবার মতো ভাষা' কিন্তু ভুলে থাকতে চাইলেই কি ভোলা যায়? আসলে তো তুমি 'অজুহাত খুঁজে ফিরছ, যাকে তুমি দায়ী করে যাবে' কিন্তু ভাষা বা কথার ভিতর থেকেও কি আবার নতুন করে শুরু হয়ে যায় না আরেক রাস্তা? তখন মনে পড়ে কীভাবে 'তোমার সম্ভাব্য যাওয়া দু-হাতে আড়াল করি রোজ / থেরাপির প্রতি কোপে ধীরে ধীরে নিভে আসা দিন, / এই মায়া, এই ছোটো ছোটো লেখা আর শেষ বার / বলে নেওয়া কথার ভেতরে নেমে ইচ্ছে হয়, রাস্তা খুঁড়ে রাখি' কিন্তু, হে পাঠক, 'তুমি কি জানতে আগে, অপেক্ষাও রাস্তারই নাম?'
অপেক্ষা করতে করতেই একসময়ে টের পাওয়া যায়, 'ভিতরে যে বেড়ে উঠছে, সে তোমার অনাহূত প্রেম' এবং 'বস্তুত যেকোনো প্রেম এরকমই একরোখা, রাগী / এরকমই খুনে আর প্রমাণ লুকিয়ে রাখা স্বভাবপাগল'
আমি তো দেখেছি 'সমুদ্র দেখার খিদে তোমার দু-পায়ে লেগে আছে / মৃত সে-ইচ্ছে নিয়ে আমি তাই স্বপ্নের ভেতর / তোমাকে দিয়েছি ডাক একসঙ্গে স্নান করব বলে' হ্যাঁ, স্বপ্ন, 'কেননা জীবন আজও এরকমই, প্রতিটি প্রবেশ যার / ঘুমের বাঁশিটি হাতে ছুটে যায় আলোহীন প্রস্থানের দিকে' সেখানে 'সামান্য মাটির ঘরে শত শত অন্ধকার লিখে গেছ তুমি' তাই স্বপ্নই একমাত্র আশ্রয় স্বপ্নেই তো 'আমরা তোমাকে ছুঁয়ে ছোটো ছোটো গাছ হয়ে উঠি' হয়তো তা ভুল হতে পারে, হয়তো তা দোষের হতে পারে, কিন্তু 'সে-দোষের ক্ষমা নেই, সে-ক্ষমার দোষও নেই আর'

মগজে সামান্য মেদ – দেবর্ষি সরকার, শুধু বিঘে দুই, ৩৫ টাকা।
জ্বর-জ্বর ইচ্ছেগুলি – শ্রীদর্শিনী চক্রবর্তী, শুধু বিঘে দুই, ৩৫ টাকা।
হাঁটু মুড়ে বসে আছি গৃহদ্বারে – ঐত্রেয়ী সরকার, শুধু বিঘে দুই, ৩৫ টাকা।

কর্কটরেখা – দীপ্তিপ্রকাশ দে, শুধু বিঘে দুই, ৩৫ টাকা।    



No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমা...

পছন্দের ক্রম