ঐতিহাসিক
থ্রিলার ঘরানার গল্প বাংলা সাহিত্যে বোধহয় খুব বেশী নেই। এই গোত্রের উপন্যাসের
প্রধান ভিত্তি হল ইতিহাস এবং রহস্যের মতো দুই বিপরীত মেরুতে অবস্থিত দুটি বিষয়ের
রসঘন মেলবন্ধন। কিন্তু এই অভিনব বিষয়বস্তুর সাথে যদি সেই গল্পে থাকে সুচারু গবেষণা,
সূক্ষ্ম রসবোধ, পরিণত মাত্রাজ্ঞান,
স্বচ্ছন্দ ভাষা ও কাহিনীর দক্ষ উপস্থাপনা তাহলে অনিবার্য ভাবেই
সেই উপন্যাস অন্য মাত্রা ধারণ করে। পাঠকের কাছে তখন সেই মনোগ্রাহী রচনার আকর্ষণ
হয়ে ওঠে দুর্বার। লেখক প্রীতম বসুর লেখা "চৌথুপীর চর্যাপদ" আর
"পাঁচমুড়োর পঞ্চানন মঙ্গল"- বই দুটিতে অসামান্য ভাবেই ঐতিহাসিক
থ্রিলারের উপরোক্ত সবকটি গুণ বর্তমান আছে। লেখক প্রীতম বসু দীর্ঘকাল ধরেই প্রবাসী।
শিবপুর বিই কলেজ থেকে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনে
দীর্ঘদিন কাজ করেছেন উনি। তারপর এম এস করতে ইউ এসে চলে যান এবং বর্তমানে উনি
জিই-তে উচ্চ পদে আছেন। লেখকের বাংলা ভাষা আর সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা উপন্যাস
দুটির প্রতিটি ছত্রে ফুটে উঠেছে। কতটা গভীর গবেষণা আর অক্লান্ত পরিশ্রমে লেখক এই
বই দুটিকে নির্মাণ করেছেন তা বাস্তবিকই বিস্ময়ের উদ্রেক করে। দুটি বইএর পিছনে থাকা
গ্রন্থপঞ্জি দেখলে এই বিপুল কর্মকাণ্ডের কিছুটা অনুমান করা যায় মাত্র। এই দুটি বই
এর মাধ্যমে বাংলা ভাষার দুটি যুগ এবং সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যের স্বর্ণ ভাণ্ডারকে
চেনার সুযোগ পাবেন পাঠককুল। নিচে এই বইদুটি নিয়েই সামান্য আলোচনা করার চেষ্টা
করলাম।
চৌথুপীর
চর্যাপদ -
"কাআ তরুবর পঞ্চ বি ডাল।
চঞ্চল চীএ
পৈঠা কাল ।।
দিঢ় করিঅ
মহাসূহ পরিমাণ
লুই ভণই গুরু
পুচ্ছিঅ জাণ॥"
উপরের এই
চারটে লাইন যে কি ভাষায় লেখা সেটা অনেকের কাছেই হয়তো অপরিচিত। এটি লুই পাদ রচিত
চর্যা ভাষায় একটি পদ বা গান। চর্যাপদ বাংলা দেশের সুপ্রাচীন সাহিত্যের অন্যতম
নিদর্শন । এই পদ রচনার সময় কাল নিয়ে ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। হরপ্রসাদ
শাস্ত্রীর মতে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান তিব্বত যাত্রার পূর্বেই (১০৩০ খ্রিস্টাব্দ)
লুইপাদের "অভিসময়বিহঙ্গ" রচনায় সাহায্য করেছিলেন। একথা সত্য হলে
লুইপাদ দশম শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান থাকবেন।অন্য দিকে তিনিই সিদ্ধাচার্যদের
আদিগুরু; অর্থাৎ, চর্যার সময়কালও দশম শতাব্দীর পূর্বে হতে পারে না। অন্যদিকে কেমব্রিজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে "হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা" নামে এক
বৌদ্ধতান্ত্রিক পুঁথির সন্ধান পাওয়া যায় যেটির রচনাকাল শেষ পালরাজা গোবিন্দপালের
(১১৫৫ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকাল। বিশেষজ্ঞদের মতে এই পুঁথির রচয়িতা শ্রীকৃষ্ণাচার্যই
প্রকৃতপক্ষে চর্যার কাহ্নপাদ বা চর্যা-টীকার কৃষ্ণাচার্য। নাথ সাহিত্য অনুযায়ী
কাহ্নপাদের গুরু জালন্ধরিপাদ বা হাড়িপা, যিনি
গোরক্ষনাথের শিষ্য ছিলেন। আবার মারাঠি গ্রন্থ জ্ঞানেশ্বরী (রচনাকাল আনুমানিক ১২৯০
খ্রিস্টাব্দ) থেকে জানা যায় উক্ত গ্রন্থের রচয়িতা জ্ঞানদেব দীক্ষালাভ করেন
নিবৃত্তিনাথের কাছ থেকে, যিনি গোরক্ষনাথের শিষ্য গেইনীনাথ
বা গোয়নীনাথের থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত। সেই হিসাবেও কাহ্নপাদকে দ্বাদশ শতাব্দীর মানুষ
বলে মনে হয়। সব মিলিয়ে পদ গুলি দশম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে রচনা করা হয়েছিল বলে
অনুমান করা যায়। তবে তার পরেও দু-তিনশো বছর ধরে গোপনে চর্যাগীতি রচিত হয়েছিল।
চর্যাপদ গুলোর ভিতরে রয়েছে নানা ধরণের দুর্বোধ্য ভাব। এর আক্ষরিক অর্থে সাথে ভাবগত
অর্থের ব্যাপক ব্যবধান আছে । ফলে এই পদগুলোতে বোঝা না বোঝার দ্বন্দ্ব রয়ে যায় ।
সেই কারণে চর্যায় ব্যবহৃত ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন সন্ধ্যাভাষা। ব্জ্রযানী
ও সহজযানী গ্রন্থকাররাও একে 'সন্ধ্যাভাষয়া বোদ্ধব্যম'
বলে এক রহস্যের ইঙ্গিত দিতেন। ব্জ্রযানী গ্রন্থগুলিতে 'সন্ধ্যাভাষা' শব্দটি বহুলভাবে ব্যবহার করা
হয়েছে । চর্যাপদের কবি বা সিদ্ধাচার্যরা চর্যাপদগুলি রচনা করেছিলেন। সাধারণত
বজ্রযানী ও সহজযানী আচার্যগণই সিদ্ধাচার্য নামে অভিহিত হতেন। তিব্বতি ও ভারতীয়
কিংবদন্তিতে এঁরাই 'চৌরাশি সিদ্ধা' নামে পরিচিত। আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে ৫০টি চর্যায় মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের
নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন: লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল,
ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা,
সরহ, শবর, আজদেব,
ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ,
জঅনন্দি, ধাম, তান্তী
পা, লাড়ীডোম্বী।
লেখক প্রীতম
বসু কালের গর্ভে চলে যাওয়া এই বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া ভাষাকে নতুন করে শুধু মনে করিয়েই
দেন নি , উপরন্তু একে নিয়ে "চৌথুপীর
চর্যাপদ" নামের একটি অসাধারন একটি থ্রিলার ও রচনা করেছেন। এর পরতে পরতে ছড়িয়ে
থাকা রহস্য এবং একটি নারীর জীবনকথন মিলেমিশে খুব সহজেই আমাদের সেই চর্যাপদের সেই
প্রাচীন সময়কালে নিয়ে পৌঁছে দেয় যেখানে আমরা খুঁজে পাই এক বিদূষী নারীকে যারা নাম
"আগুনপাখি গন্ধকালী"। একসাথে দু’খানা কাহিনীর
বুনোট সমান্তরালে চালিয়ে লেখা উপন্যাস আমরা আগেও পড়েছি। এই উপন্যাসটির একদিকে আমরা
দেখি একটি পুঁথিকে কেন্দ্র করে হাফি হাবিলদার, মামাজী,
বিমলা, লামা, ছেত্রী,
অর্জুন এবং যোজনগন্ধার তীব্র অনুসন্ধান অন্যদিকে প্রায় আটশো বছর
আগের গন্ধকালী, শ্রীধর আচার্য, খু-স্তোনদের
আগলে রাখা পুঁথি এবং তুরস্কদের কাহিনী। এই দুটো কাহিনীর সমান্তরাল সজ্জাতেই এ
উপন্যাস এগিয়ে চলে।। উপন্যাসের শুরুতেই আমরা দেখি আর্কিওলজিস্ট যোজনগন্ধা
চ্যাটার্জী খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারেন চৌথুপীর ভূগর্ভে একটি দ্বাদশভুজ
অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি পাওয়া গেছে যার পৃষ্ঠপটে চর্যাভাষায় লেখা আছে ,
"গঅণ পদুমা রঅণ আঠাশ পাখুরী
দিবস ন দিঠঠে
অচ্ছই অন্ধারি
নিসিঅ
উদ্ধমেরু ণিচল পেখই
পরিমানহ থাব
গন্ধকালী ভণই "
চমকে উঠলেন
যোজনগন্ধা ,সত্যিই কি গন্ধকালী বলে কেউ আছে
? যাকে খুঁজতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছিলেন যোজনগন্ধার বাবা !
ক্যান্সার আক্রান্ত অসুস্থ শরীরেই যোজনগন্ধা রওনা দেয় চৌথুপীর উদ্দেশ্যে। এই
চৌথুপীর সংঘারাম স্থাপিত হয়েছিল পালরাজা মহেন্দ্রপালের মহাসেনাপতি ব্জ্রদেব
দ্বারা। চৌথুপীর লোককথা বলে আগুন পাখি গন্ধকালী নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছিলো।
আগুনপাখিকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা অনেক খুঁজেছে, কিন্তু কেউ
খুঁজে পায়নি। আগুনপাখির ঢিপি খুঁড়তে শুরু করলেই মজুরদের কারো না কারো মৃত্যু হতো।
যোজনগন্ধার বাবা অন্য জায়গা থেকে মজুর এনে খোঁড়াখুড়ি শুরু করেছিলেন কিন্তু আচমকাই তিনি
নিখোঁজ হয়ে যান। চৌথুপী পৌঁছে যোজনগন্ধা জানতে পারে যে ওখানে একটা মার্ডার হয়েছে
এবং সেই মার্ডারটি হয়েছে মূর্তিটি যেখানে পাওয়া গেছে সেই গর্তের পাশে। মার্ডার
হয়েছে কিড়াজড়ির চোরাচালানকারী মাফিয়া ডন অজাত শত্রুর ছেলের। পুলিশের কড়াকড়ির
মধ্যেই যোজনগন্ধার পরিচয় হয় অ্যাসিসটেন্ট সুপারিন্টেনডেন্ট আর্কিওলজিস্ট ডক্টর
নলিনী রক্ষিতের সাথে। ডক্টর রক্ষিত, যোজনগন্ধাকে জানান যে
যোজনগন্ধার বাবা ডক্টর বুধাদিত্য চ্যাটারজী একটি পুঁথি পেয়েছিলেন যার নাম
"গন্ধকালী জ্ঞান ডাকিনী গুহ্যচর্যা "। শিহরিত যোজনগন্ধা পুঁথিটির পাতায়
পাতায় খুঁজতে শুরু করল গন্ধকালীর অতীতকে এবং ধীরে ধীরে সে হারিয়ে গেলো গন্ধকালীর
ইতিহাসে। কৈবর্তের মেয়ে গন্ধকালীর জীবন শুরু হয়েছিলো আর পাঁচটা জেলের মেয়ের মতোই।
তার জীবনে পরিবর্তন আসে যখন শিলাদিত্য সঙ্ঘারামের অধ্যক্ষ শ্রীধর আচার্য তার
শিক্ষাভার গ্রহণ করেন। যদিও এই কারণের জন্য শ্রীধর আচার্যকে বিস্তর বাধা এবং
লাঞ্ছনার সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। তালপাটক গ্রামের সমগ্র ব্রাহ্মণ সমাজ এর
বিরুদ্ধাচরণ করে। একটি জেলের মেয়ে বাকি উচ্চবর্ণের ছাত্রদের মধ্যে শিক্ষা পাবে তা
তারা মেনে নিতে পারে নি। কিন্তু শ্রীধর আচার্য তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন এবং
গন্ধকালী তার কাছে শিক্ষা গ্রহণ করতে থাকে। কিন্তু আচমকা তাদের গ্রামে তুরুস্কুদের
আক্রমণ হয়। তাদের আচমকা আক্রমণে গন্ধকালীর বাবা চন্দর মাঝি নিখোঁজ হয়ে যায়। এদিকে
গ্রামের কিছু লোক আক্রমন করে শ্রীধর আচার্য আর গন্ধকালীকে।অসুস্থ শ্রীধর আচার্য
পালাতে অসমর্থ হন। আতঙ্কিত গন্ধকালী রাতের অন্ধকারে নদী সাঁতরে পালিয়ে আশ্রয় নেয় চৌথুপীর
দিবাকর নামের এক রাজকর্মচারী আর তার স্ত্রী গোপার কাছে। গোপার কাছ থেকে দিবাকরের
পুজোর কথা জানতে পেরে কৌতূহলী গন্ধকালী দিবাকরের পুজোর ঘরে লুকিয়ে প্রবেশ করে।
সেখানে সে ভীষণদর্শন কিছু দেব দেবীর মূর্তি দেখতে পায়।
সে জানতে পারে
এই সব দেবদেবী ব্জ্রযানের দেবদেবী এবং দিবাকর ব্জ্রযান তন্ত্র মতে সাধনা করে। এক
রাতে দিবাকর কে অনুসরণ করে সে পৌঁছায় দিবাকরের তন্ত্র সাধনা স্থলে। সেখানে মৈথুনভঙ্গিতে নর
নারীর তন্ত্র সাধনা দেখে মানব মানবীর চিরাচরিত জীবন সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ গন্ধকালী
সিদ্ধান্ত নেয় ভিক্ষুণী হওয়ার। সেই মতো সে মহাপ্রজাপতি সঙ্ঘারাম থেকে প্রব্রজ্যা
গ্রহণ করে। তার নতুন নাম হয় উপাচার্যা সঞ্জীবনী। সঞ্জীবনী চৌথুপীর দ্বারপণ্ডিত
জ্যোতির্বিদ আচার্য শান্তভদ্রকে তর্ক যুদ্ধে আহ্বান করে। তর্কযুদ্ধে সঞ্জীবনী
আচার্য শান্তভদ্রকে জ্যোতির্বিদ্যার ভিত্তিতে গণনা করে মহাভারতের যুদ্ধের সময়
জানতে চায়। শান্তভদ্র তার অক্ষমতা স্বীকার করলে সঞ্জীবনী নক্ষ্ত্রের গণনার মাধ্যমে
সঠিক সময় অনুধাবন করতে সমর্থ হয়। আচার্য শান্তভদ্র হার স্বীকার করেন থেরি
সঞ্জীবনীর কাছে। ইতিমধ্যে সুদূর তিব্বতের খাম্বার রাজার ছেলে খু-স্তোন ভারতে আসে
নিজের কুষ্ঠ রোগের নিরাময় খুঁজতে। থেরি সঞ্জীবনীর চিকিৎসা বিদ্যার সুনাম শুনে
খু-স্তোন চৌথুপীর সঙ্ঘারামে আসে। কিন্তু আচমকা তুরুস্কু সেনারা চৌথুপী আক্রমণ করে।
এই আক্রমণে আচার্য শান্তভদ্র আর আচার্য তোন পার মৃত্যু হয়। সঞ্জীবনী আর খু-স্তোন
কোনরকমে পালাতে সমর্থ হয়। পালানোর সময় তারা অতি কষ্টে কিছু পুঁথি নিয়ে পালাতে
সক্ষম হয় এবং নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত তিব্বতে পৌঁছাতে পারে
এবংহয়ত সেই সঙ্গেই আগুনপাখি খুঁজে পায় তার আশ্রয় এবং প্রেমিককে।
গন্ধকালীর এই
কাহিনীর সমান্তরালে আরকিওলজিস্ট যোজনগন্ধার কাহিনীও এগিয়ে চলে। যোজনগন্ধা এবং তার
সঙ্গে থাকা হাফি হাবিলদারকে কিডন্যাপ করে মামাজি নামের এক দুষ্কৄতি। এই মামাজির
দাবি তিনি মুক্তিপণ হিসেবে ২ কোটি টাকা সরকারের কাছ থেকে আদায় করবেন। কিন্তু
বাস্তবে দেখা যায় চৌথুপিতে একটা আন্তর্জাতিক চোরাচালান চক্র আছে যার সঙ্গে যুক্ত
আছে পুলিশের লোক এবং অ্যাসিসটেন্ট সুপারিন্টেনডেন্ট আর্কিওলজিস্ট ডক্টর নলিনী
রক্ষিত। সুদূর তিব্বত থেকে আসা এক লামা লবসাঙ চোগিয়্যালও জড়িয়ে পড়ে পুরো ঘটনার
সঙ্গে। হাফি হাবিলদারের তৎপরতায় ধরা পড়ে নলিনী রক্ষিত আর পুলিশের দারোগা এবং উদ্ধার হয়
অবলোকিতেশ্বরের মূর্তি। গন্ধকালী প্রার্থনা করেছিলো আকাশগঙ্গার দেবী অরুন্ধতীর
কাছে যেন প্রতি জন্মে সে খু-স্তোনকে পায়। এই যুগের আগুনপাখি কি শেষ পর্যন্ত খুঁজে
পাবে তার খু-স্তোনকে? সেই প্রশ্নের উত্তর কাহিনীর মধ্যেই
খুঁজে পাবেন পাঠক।
“চৌথুপীর চর্যাপদ” একটি সম্পূর্ণ রূপে গবেষণামূলক কাহিনী,যার পরতে
পরতে আছে অসংখ্য তথ্য, এই বিপুল তথ্যসাগরে ভাসতে ভাসতেই
পাঠক কখন যে সমান্তরালে চলতে থাকা দুটো কাহিনীর অন্দরমহলের প্রতিটি চরিত্রের সাথে
পরিচয় সেরে নেবে, তা অনুমেয় নয়। লেখক অত্যন্ত দক্ষতার
সঙ্গে সেইসময়ের বঙ্গ সমাজের চালচিত্রটি এঁকেছেন। নিম্নশ্রেণীর হিন্দুদের উপর
উচ্চশ্রেণীর হিন্দুদের অত্যাচার, বক্তিয়ার খিলজির বাংলা
আক্রমণ, হিন্দু ধর্মের লোকেদের জোর করে মুসলমান ধর্ম
গ্রহণ করতে বাধ্য করা, মহম্মদ ঘুরির তিব্বত আক্রমণ এবং
তারপর কাম্রুপের রাজার কাছে হার, ইতিহাসের এই সমস্ত
কাহিনী গুলিকে এক সুতোয় গেঁথেছেন লেখক প্রীতম বসু। তার সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছেন
এখনকার সমাজের দুর্নীতিপরায়ণ পুলিশ,স্মাগলার, কিডন্যাপ এবং তার থেকে উদ্ধার পাওয়ার গল্প। এ কাহিনীতে অ্যাডভেঞ্চার কম
নেই, আবার অতিশয় সিরিয়াস ইস্যুর মাঝে হাস্যরসের উপাদান
নেহাত কম নেই, গুলি-বোমা-বারুদের গন্ধে মাখা বাতাস আছে,
ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া একটা জাতির অত্যাচার আছে।
থ্রিলার আর অ্যাডভেঞ্চারের যুগলবন্দী, তার ওপর অসাধারণ সব
তথ্য, যা জানলে রীতিমতো অবাক হয়ে যেতে হয়। তবে সবগুলো
এমনভাবে মিলেমিশে গেছে যে পড়তো পড়তেই এক অন্যরকম মায়াজালে জড়িয়ে যেতে হয়।
পাঁচমুড়োর
পঞ্চানন মঙ্গল -
লেখক প্রীতম
বসুর আরেকটি অসামান্য বই হল "পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল"। নামটা শুনলেই
আমাদের স্কুলজীবনে পড়া মঙ্গলকাব্যগুলোর নাম মাথায় ভেসে ওঠে। যাঁরা মঙ্গলকাব্য
জিনিসটা কি সেটা জানেন না তাদের এই বেলা মঙ্গলকাব্য সম্পর্কে দুচার কথা জানিয়ে
রাখলাম । বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে সমাজের বিভিন্ন স্তরে নানান দেবদেবীর পূজা
প্রবর্তনের ও তাদের লীলা মাহাত্ম্য প্রচারের উদ্দেশ্যে যে আখ্যানধর্মী কাব্যগুলিকে
রচনা করা হয়েছিল, সেই কাব্যগুলিকে মঙ্গলকাব্য
বলে। বলা হয়ে থাকে, যে কাব্যে দেবতার আরাধনা, মাহাত্ম্য-কীর্তন করা হয়, যে কাব্য শ্রবণেও
মঙ্গল হয় এবং বিপরীতে হয় অমঙ্গল; যে কাব্য মঙ্গলাধার,
এমন কি, যে কাব্য ঘরে রাখলেও মঙ্গল হয়
তাই হল মঙ্গলকাব্য। মঙ্গল কাব্যের সময়কাল আনুমানিক খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দী থেকে
শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দী বলে ধরা হয়। মঙ্গলকাব্যগুলি বাংলাদেশের একটি বিশেষ সময়ের
সাহিত্য সাধনার ফসল। এগুলিতে শুধু দেবদেবীর মাহাত্ম্যই বর্ণনা করা হয় নি, তার সাথে তৎকালীন বাঙালি জীবনের খুঁটিনাটির বিশদ বিবরণও পাওয়া যায়। কোনো বিশেষ ধর্মমত নয়, বিভিন্ন
সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের
সংস্কৃতি এবং ধর্ম বিশ্বাসের সংমিশ্রনই মধ্যযুগে মঙ্গলকাব্যগুলি র জন্ম দিয়েছিল।
প্রতিটি মঙ্গলকাব্যে একেকজন দেবতার মাহাত্ম্য বর্ণিত হয়েছে। এঁরা লৌকিক দেবতার
সঙ্গে পৌরাণিক দেবতার সংমিশ্রণে সৃষ্ট বাঙালির নিজস্ব দেবতা। বহিরাগত আর্যদেবতাদের
বিরুদ্ধে অনেক সংগ্রাম করে এঁদেরকে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হয়েছে। আর্যদেবতাদের
বিরুদ্ধে এই বিজয়ের কারণে মঙ্গলকাব্যের ‘মঙ্গল’ শব্দটি ‘বিজয়’ অর্থেও
গ্রহণ করা হয়। এমনকি কোনো কোনো মঙ্গলকাব্যের নামের সঙ্গে ‘বিজয়’ শব্দটি সংযুক্তও হয়েছে, যেমন বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসাবিজয়। মঙ্গলকাব্যের প্রধান দেবতারা
হচ্ছেন মনসা, চন্ডী ও ধর্মঠাকুর। এঁদের মধ্যে মনসা ও চন্ডী এই দুই স্ত্রীদেবতার প্রাধান্য বেশি। এই
তিনজনকে কেন্দ্র করে মঙ্গলকাব্যের প্রধান তিনটি ধারা গড়ে উঠেছে মনসামঙ্গল,
চন্ডীমঙ্গল ও ধর্মমঙ্গল। কালক্রমে শিবঠাকুরও মঙ্গলকাব্যের বিষয়
হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন এবং তৎকেন্দ্রিক কাব্যধারার নাম শিবায়ন বা শিবমঙ্গল।
মঙ্গলকাব্যের বিষয়বস্তু প্রধানত চারটি অংশে বিভক্ত। প্রথম অংশ বন্দনা। এখানে
বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা করা হয়। শুধু তাই নয়, ধর্মবর্ণনির্বিশেষে
সকল শ্রেণীর উপাস্যদের প্রতিও এখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এটি মঙ্গলকাব্য
রচয়িতাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনা বা সর্বধর্মসমন্বয় চেষ্টার এক নিদর্শন। দ্বিতীয়
অংশে থাকে কবির আত্মপরিচয় এবং গ্রন্থ রচনার কারণ স্বপ্নাদেশ বা দৈবনির্দেশের
বর্ণনা। তৃতীয় অংশ দেবখন্ড। এর আলোচ্য বিষয় পৌরাণিক দেবতার সঙ্গে লৌকিক দেবতার
সম্বন্ধ স্থাপন। এ ক্ষেত্রে শিবের প্রাধান্য লক্ষণীয়। চতুর্থ অংশ নরখন্ড ও
আখ্যায়িকা। এ অংশের মুখ্য বিষয় পূজাপ্রচারের উদ্দেশ্যে শাপভ্রষ্ট কোনো দেবতা বা
স্বর্গবাসীর নরজীবন লাভ, নররূপে তাঁর কর্মকান্ড এবং অনেক
দ্বন্দ্ব-সঙ্ঘাতের পর মানব সমাজে তাঁর পূজা প্রতিষ্ঠা। এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক বিষয়
হিসেবে থাকে নায়িকাদের বারমাস্যা, চৌতিশা, সাজ-সজ্জা, রন্ধনপ্রণালী ইত্যাদির বর্ণনা।
এটিই মঙ্গলকাব্যের প্রধান অংশ।
লেখক প্রীতম
বসু অনবদ্য দক্ষতায় ১৪০০ শতকের ভাষায় এবং ভাঙ্গা পয়ারের ছন্দে প্রায় একটি
মঙ্গলকাব্য রচনা করেছেন এখানে। নাম "পঞ্চাননমঙ্গল"। বাংলা ভাষা আর লিপির
উপর কতটা দখল থাকলে এই ধরণের লেখা কেউ লিখতে পারে তা যারা বাংলা সাহিত্য নিয়ে
চর্চা করেন তারা অবশ্যই বুঝবেন। কাহিনীর শুরুতে দেখা যায় যে গৌড় থেকে এক সেনাপতি
সুলতানের আদেশে এক মন্দির ধ্বংস করতে এসে সেটা না পেয়ে তারপর পাশের এক বৌদ্ধ
বিহারের পুঁথি আগুনে পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলে। এরপর কাহিনী চলে আসে পাঁচমুড়ো গ্রামের
মহৎ কিন্তু ক্ষয়প্রাপ্ত জমিদারবংশের বর্তমান পুরুষ সদানন্দ ভট্টাচার্যের বাড়িতে।
তিনি আবার নিষ্ঠাবান ঐতিহাসিকও। বাংলা সাহিত্যের কালক্রান্তি তাঁর নখদর্পণে, পুরানো বাংলা পুঁথির বিশেষজ্ঞ বলে তাঁর পরিচিতি।
প্রাচীন পুঁথি যাচাই করাতে বিশিষ্ট ক্রেতারা আসেন তাঁর কাছে। তার কাছেই পুঁথি
দেখাতে আসে কালাচাঁদ। কালাচাঁদ পেশায় চোর। এখানে আর একটি উল্লেখযোগ্য চরিত্র হল
হরু ঠাকুর। হরু ঠাকুর ছন্দরসিক মানুষ। কিন্তু আসলে তাঁর পেশা নকলনবীশ তঞ্চকতা।
সোজা কথায় জালিয়াতি। তিনি পুরনো ঐতিহাসিক বাংলা পুঁথি জাল করেন, আর কালাচাঁদ সেই জালপুঁথি উপযুক্ত প্রত্নমূল্যে গ্রাহকের কাছে পাচার
করে। সদানন্দ খবর পান যে পাঁচমুড়োর চয়নবিল থেকে পাথরে খোদাই করা কিছু লিপি পাওয়া
গেছে। শিব বন্দনার সেই লিপি নকল করে কালাচাঁদ নিয়ে আসে হ্রু ঠাকুরের কাছে। হ্রু
ঠাকুরের ভাগ্নে বদন সেই শিব বন্দনার আড়ালে থাকা অঙ্কের সূত্রের পাঠোদ্ধার করে। বদন কম্পিউটার
সায়েন্স নিয়ে পড়াশোনা করেছে এবং অঙ্কে তার বুৎপত্তি অসাধারণ। সে ঐ শিলালিপির
ভাষ্যে আবিষ্কার করে শিববন্দনার আড়ালে লুকোনো গণিতের কিছু কূটতত্ত্ব ও এমন অনেক
সূত্র যা বর্তমান কালে বিদেশীদের নামাঙ্কিত। সদানন্দের বিশ্বাস এই লিপিই সেই
হারিয়ে যাওয়া পঞ্চাননমঙ্গল। ইতিমধ্যে এক আরব শেখের কানে পৌছায় পঞ্চানন মঙ্গলের
খবর। সে যেন তেন প্রকারনে এই পঞ্চানন মঙ্গল পেতে চায়। স্বদেশের সম্পদ রক্ষা করতে
গিয়ে এই চারমূর্তি অজান্তেই এক আন্তর্জাতিক চক্রান্তে জড়িয়ে পড়ে। ঘটনার ঘনঘটায় সেই
অনাবিষ্কৃত পঞ্চাননমঙ্গল কাব্য কিভাবে 'উদ্ধার' হল বা আদৌ হল কিনা, তাই নিয়েই এই অনন্য
থ্রিলার।
এই উপন্যাসের
সব থেকে উল্লেখযোগ্য বস্তুটি হল, লেখক রচিত মঙ্গলকাব্যটি যেটি লেখক রচনা করেছেন চতুর্দশ শতাব্দীর বাংলা
ছন্দে এবং তার মধ্যে নিহিত আছে উচ্চ গণিতের বেশ কিছু তত্ত্ব। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি
লাইন এখানে তুলে দিলাম,
ত্রিদিবেশ
চন্দ্রচূড়
মহেশ্বর ধেআই চরণ।
চতুর্দ্দিশ
ভকতীএঁ ভরায়িলেঁ মন।।
ঈশর
ত্রিদশগণের শৈবলিনী মাথ।
পঞ্চানন
দেহযুতী দেব ভোলানাথ।।
গ্রহতারা ভজে
সহ্মে শিব শম্ভু দাতা।
হাথে বরাভয়
দেব জগদীশ ত্রাতা।।
প্রথম দর্শনে
একে প্রাচীন শিবস্তোত্র মনে হতেই পারে। কালাচাঁদ এবং হরু ঠাকুর তাই ধরে নিয়েছিল।
কিন্তু তুখোড় মস্তিষ্কের বদন এর রহস্য ভেদ করে ফেলে। শ্লোকের প্রতি পঙক্তির প্রথম
বর্ণ এক একটি সংখ্যার নির্দেশক! ত্রি(দিবেশ) - তিন, চন্দ্র - এক, চতু(র্দ্দিশ) - চার, ঈশর (ঈশ্বর) - এক, পঞ্চানন - পাঁচ, গ্রহ - নয়, হাথে (হাত) - দুই ইত্যাদি। এরপরের
পংক্তিগুলো একইরকম ভাবে পরপর ইঙ্গিত করে চলে ৬, ৫,
৩, ৫, ৮,
৯, ৭...। স্কুলগণিতের মাধ্যমিক স্তরে
যাঁরা পাই-এর সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা জানেন পাই-এর মান
৩.১৪১৫৯২৬৫৩৫৮৯৭...! আজকের কম্পিউটার যুগে দশমিকের পর কোটি কোটি ঘর পর্যন্ত এই মান
জানা হয়ে গেছে। কিন্তু যখন পাই আবিষ্কৃত হয়নি সেই সময়ের অজ্ঞাত কোনও ভারতীয়
গণিতজ্ঞ যদি যন্ত্রগণকের সাহায্য ব্যতিরেকে এই লিপি খোদাই করিয়ে থাকেন, তাহলে তা কি যথেষ্ট চাঞ্চল্যকর নয়? এরকম আরও
অনেক সূত্র ছড়িয়ে আছে গোটা উপন্যাসে। বইটি থেকে আরও জানা যায় যে আটশো শতকে ভারতীয়
পণ্ডিতের হাত ধরে সুপ্রাচীণ গণিতশাস্ত্রর উন্নতির কথা। সেই সূত্রেই পরবর্তীকালে
অল-খোয়ারিজমি ‘ভারতের সংখ্যা দিয়ে গণনাপদ্ধতি’ব্যবহার করে “অ্যালগরিদম”এর জনক হিসাবে পশ্চিমী দুনিয়ার কাছে পরিচিত হন (অল-খোয়ারিজম এর
অপভ্রংশই আজকের অ্যালগরিদম) আর তারপর বক্তিয়ার খিলজি ভারতের গর্ব নালন্দা
বিশ্ববিদ্যালয়কে আক্রমণ করেন এবং সুপরিকল্পিতভাবে তিন মাস ধরে পোড়ান হয় ভারতের
মহামূল্যবান পুঁথিসমূহকে, যাতে কিনা ভারতের একান্ত নিজস্ব
গণিতবিদ্যা আবিষ্কারের উজ্জ্বল ইতিহাস কালের গর্ভে চিরকালের মতো নিমজ্জিত হয়। আমরা
জানতে পারি যে তখনই আবিষ্কৃত হয়ে গেছিল আলোর গতিবেগের পরিমাপ, ‘পাই’-এর মান, অ্যালজেব্রা,
ত্রিকোণমিতি, দশমিকের ব্যবহার, পিথাগোরাসের থিওরেম -পিথাগোরাসের জন্মের দুশো বছর আগেই।
ইতিহাসের বেশ
কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও লেখক তার লেখার মধ্যে দিয়ে আমাদের অবগত করিয়েছেন। যেমন
ভারতবর্ষে বাবর প্রথম পানিপথের যুদ্ধে কামান ব্যবহার করার অনেক পূর্বেই চতুর্দশ
শতাব্দী থেকে ভারতে নানা যুদ্ধে কামান ব্যবহৃত হতো। যার উদাহরণ আমরা পাই স্বয়ং
বিদ্যাপতির লেখায়। পানিপথের যুদ্ধের অন্তত বেশ কয়েক বছর পূর্বেই পর্তুগিজ শাসক
প্রতিনিধি জোআঁ-ডি-সিলভেরা চট্টগ্রামের উপকূলের কাছে চালে-বোঝাই নৌকা দখল করলে
তিনি চট্টগ্রামের শাসনকর্তা দ্বারা কামান দ্বারা প্রতিহত হন। বাবর তার আত্মজীবনী
"বাবরনামা তেই স্বীকার করে নিয়েছেন যে বাঙালিরা কামান দাগা এবং নৌ বিদ্যায়
এগিয়ে ছিল। বর্তমানের বাংলা লিপি যে দীর্ঘ বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজকের চেহারায়
পৌঁছেছে, কিংবা তার বর্ণ-বিন্যাস বা
লেখায় নির্দিষ্ট কিছু বর্ণের ব্যবহারের আধিক্য এসবই বিভিন্ন চরিত্রের কথোপকথনের
মধ্যে দিয়ে লেখক অনায়াসে ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পচ্ছলে। মঙ্গলকাব্যে দেবতার
স্থানমাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক নিজের বিজ্ঞানমনস্কতাকে বিসর্জন দেননি।
বদনের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন কিভাবে শিবলিঙ্গ ধোয়া জল খেয়ে গ্রামসুদ্ধ লোকের কালাজ্বর
সেরে যায়। আসলে তার পেছনে নালন্দায় পড়াশোনা করা পুরোহিত নন্দীধনের চীন দেশের
প্রাপ্ত এক ধাতব খণ্ডের কথা উল্লেখ করেছেন যা আসলে অ্যান্টিমনি। এই অ্যান্টিমনি বা
স্টিবিয়াম (ল্যাটিন) চীনেই পাওয়া যেত এবং তা এই কালাজ্বর এর প্রতিষেধক হিসেবে
ব্যবহার হত। এর সাথে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীর
ইউরিয়াস্টিবামিন নিয়ে রিসার্চের কথাও উল্লেখ করেছেন লেখক।
শুরুতেই লেখক
স্বীকার করে নিয়েছেন, এ নিছক কাল্পনিক কাহিনী,
তবু তা লক্ষ্য না করে পড়তে শুরু করলে কেউ হয়তো সত্যি বলে ভাবতেও
পারেন। “মঙ্গলকাব্য” শিরোনামে
রচিত হলেও টানটান রহস্য আর ফিকশনের মোড়কে এক অভূতপূর্ব আলেখ্য উপহার দিয়েছে শ্রী
প্রীতম বসু। তাই বাংলা সাহিত্যের দিকে বিশেষ ঝোঁক না থাকলেও যারা অ্যাডভেঞ্চার বা
রহস্য রোমাঞ্চ ভালোবাসেন, এ বই তাদের পিপাসও মেটাবে,
আশা রাখি। কখনো পাঁচমুড়োর পটভূমিকায় কালাচাঁদ, সদানন্দ ভটচায, হরু ঠাকুর, বদন, ধাড়া, শেখ
প্রভৃতিতে আবার মাঝে মাঝেই গল্পের ছলে কখন যে পাঁচশো বছর পিছিয়ে পাঠককে বেগবতীর
তীরে পঞ্চমুন্ড গ্রামে, যেখানে নন্দীধন, জটামদন, জালালউদ্দিন, ভানুমতী, বলরাম উপস্থিত। কিন্তু এই দুই ভিন্ন
সময় সারণীতে যাতায়াত করতে হলেও তা পাঠকের অসুবিধার সৃষ্টি করে না।
বলাই বাহুল্য
যে এই উপন্যাস লেখকের অধ্যয়ন, অধ্যবসায়, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ও কাব্যরসবোধের
এক অপূর্ব নিদর্শন।
দুটি বই এর
প্রচ্ছদই করেছেন শিল্পী দেবাশিষ রায়। উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সঙ্গে প্রকৃত সাযুজ্য
রেখেই অনবদ্য প্রচ্ছদ করেছেন শিল্পী। প্রথম দর্শনেই যা আপনার মন জয় করে নেবে।
সব শেষে একটা
কথা না বললেই নয়,বাঙালি স্বভাবতই আত্মবিস্মৃত
জাতি। এই আত্মবিস্মৃত বাঙালিজাতির মধ্যে থেকে যখন প্রীতমবাবুর মতো একজন উঠে
দাঁড়িয়ে প্রচুর সময় ও ধৈর্য সাপেক্ষ গবেষণার মাধ্যমে আমাদেরকে বাংলাভাষা এবং
বাংলার ও বাঙালির স্বরূপ দর্শন করান, তখন বাঙালি হিসাবে
আমাদেরও দায়িত্ব থেকে যায় এই প্রচেষ্টাকে আন্তরিক সাধুবাদ জানানোর।
No comments:
Post a Comment