Tuesday, April 9, 2019

কল্পনা, উত্তরণ এবং... সোহম দাস





শূন্যদশক শৈশবের দশক। অন্তত সেসময়টাও শৈশবের লাগামগুলো চুটিয়ে উপভোগ করা যেত। ভয়মিশ্রিত নিয়মভাঙার গল্প। মাঠ থেকে ফেরার পথে স্ট্রিটলাইট জ্বলে গেলে নিজের বাড়িতেই চোরের মতো ঢুকে আসার আবদার। নিজের কাছেই। দরজা দিয়ে ঢুকে এসে রান্নাঘরে রাতের তরকারি-কোটা ঘর্মাক্ত মায়ের পিঠ আড়াল করে সটান বাথরুম, তারপর পড়ার ঘরের তাক। পরেরদিন সিড়িভাঙা অঙ্কের হোমওয়ার্ক। আর এসবকে ঠাকুমার ছানিপড়া চোখের থেকেও তীক্ষ্ণতর বেড়ালচোখ দিয়ে নজর করত একটা সবুজ রঙের পৃথিবী। অথবা চাঁদ। তার নাম কি ‘ক্যাম্বিসের চাঁদ’ হতে পারে?
তরুণ গদ্যকার রোহণ ভট্টাচার্য অবশ্য একবাক্যে বলবেন, হতে পারে। শুধু বলেই ক্ষান্ত থাকবেন না, এই নাম দিয়ে তিনি লিখেও ফেলবেন আস্ত একখানা বই। যার প্রচ্ছদে কালো ব্যাকগ্রাউন্ডের ওপর সম্বিত বসুর ক্যালিগ্রাফিতে ফুটে উঠবে অদ্ভুত সারল্যের পারিপাট্য। চাঁদ আর চন্দ্রবিন্দু-এই দুইয়ের মধ্যেকার যে প্রণয়ের সম্পর্ক, সেই প্রেমকে সম্বিত ফুটিয়ে তুলছেন ওই সবুজ গোয়েন্দার চরিত্র-চিত্রায়নের মাধ্যমে। এজন্য সম্বিতের আলাদা করে কৃতিত্ব অবশ্যই প্রাপ্য। অবশ্য সেই কৃতিত্বে ভাগ বসাতে চাইতেই পারে ধানসিড়ি প্রকাশন।

ব্যক্তিগত গদ্যের আঙ্গিকে কখনও বৈঠকী আড্ডার আমেজ, কখনও সাইকোথ্রিলার ছবির প্লট, কখনও সার্থক ছোটগল্পের গন্ধ। তবে রোহণ গল্পগুলোকে সাজিয়েছেন এমন নৈপুণ্যে, যে সেখানে ওই শূন্য দশকী বড় হয়ে ওঠার উপলব্ধির স্পষ্ট মুখচ্ছবি। ছোট্ট ঘুপচি দোকানঘর। সব পেয়েছি-র এলডোরাডো। কাগজের প্রায়-বিলুপ্ত সংখ্যার খোঁজে বিশ্ব তোলপাড় করার ফ্যান্টাসি। কল্যাণকাকু। রোহণের ‘বইকাকু’। বিক্রেতা, পাঠক, শিক্ষক-এই তিন সত্তার মিশেলে তৈরি মানুষটি, যাঁর সামনে ‘সিগারেট ধরালে, আনন্দমেলার সংখ্যাগুলো অভিশাপ দেবে’। এই গদ্যটির কথা বিশেষভাবে বলতে ইচ্ছে করে, কারণ এখানে পরিণত উৎকর্ষের বদলে কৈশোরের সারল্য রয়েছে। ‘বইকাকু’ আসলে বাবার সরল বোকাসোকা ছেলে, যার প্রতি সহজাত স্নেহমিশ্রিত দুর্বলতা থাকবে। ওইখান থেকে আরেকটু এগিয়ে রোহণ যখন বয়ঃসন্ধিতে পড়ছেন, যেসময় পাশের বাড়ির ‘চান্দ কা টুকরা’কে গলির নীচ থেকে ছক্কা হাঁকানোর চিঠি পাঠানোর দুর্লভ আইডিয়া। বলের গায়ে লেখা আই লভ ইউ তখন ক্রমাগত ব্যাটের ঘায়ে আবছা হয়ে আসত। রোদ্দুর-অনার্স। আর থেকে থেকে ক্রিকেট-নষ্ট করা বৃষ্টি-বিকেলকে কট বাহাইন্ড করে একটা ছেলে চেঁচিয়ে উঠত-‘আউট আউট, মেঘলা বিকেল আউট।’

এইবার একটা রাস্তা তৈরি হবে। একটা নয়, একজন রাস্তা। সে এখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, যে ‘হয় বেরোনোর না-হয় ফিরে আসার’। এই রাস্তা নিঃসঙ্গ আরশোলার আশ্রয়দাত্রী। এই রাস্তা কাঁচা ছেলেমানুষির গন্ধ নিয়ে আসে। যেখানে একটা গোটা বাদামকে দুটো আধখানা বাদামের আলিঙ্গন ভেবে নেয় কৈশোর। তাদেরকে একবার আলাদা করে দিলে আর তাদের পরিণয় ঘটানো অসম্ভব। সেই আজীবন ছাড়াছাড়ির বিষণ্ণতা-মাখানো পৃথিবী। তেলেভাজার ঠোঙার মধ্যে ততক্ষণে তেল চুপচুপে হয়ে এসেছে আত্মহত্যার খবর। এই রাস্তাতেই আবার বি আর চোপড়ার মহাভারতে জেগে ওঠে অ্যান্টেনা-প্রেম। ‘কে যেন ছাদের ওপর থেকে, সুরকি খসা দেয়ালের ভেতর থেকে বলে ওঠে ‘ম্যায় সময় হুঁ’।’ যে মহাভারতের কর্ণকে মনে করা যেতে পারে পেসবোলার, যাকে অর্জুনের মতো রানার নেওয়া ব্যাটসম্যানের সামলাতে কষ্ট হতো। তাই সেই বোলার যখন জুতোর ফিতে বাঁধছে বসে, অন্যমনষ্ক, তখন, হঠাৎ... এত সবকিছু একদিনে বলা যায় না, তাই ‘দেখা হবে রাস্তায় আবার।’
ক্রিকেটের ক্যালেইডোস্কোপে বিভোর রোহণ এইবার আঁকতে শুরু করলেন জিগশ পাজলের মতো টুকরো গল্পের স্কেচ। যেখানে ‘ডানা ঝাপটানো তাকে ফেডেরারের ব্যাকহ্যান্ড মনে পড়ায়।’ রাজকীয় ফেডেক্সের ফোরহ্যান্ডটার প্রত্যুত্তর দিতে পারে একমাত্র চোট-জর্জরিত আগুনপাখি নাদাল, যে প্রত্যুত্তরে টেকনিকের সাথে শ্রদ্ধা-মিশ্রিত এক অজেয় মনোভাবের অহংকার। এমন মনোভাবের জন্মবৃত্তান্ত খুঁজতে গিয়ে গদ্যকার বুঝে ফেলেছেন, আঙুলের চাপে প্রতিনিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হওয়া ফুচকার কাছেই রয়েছে আঘাত চেপে লড়াইয়ের সেই প্রকৌশল। আরও একজন শিল্পীর সাথে আমাদের পরিচয় হয়। ‘অন্তু সাইকেল চাপলে যমকেও ফাঁকি দিতে পারে।’ তাও শেষপর্যন্ত নাদালের হেরে যাওয়ার নিয়তি অন্তুকে মাঝরাস্তায় ছিটকে দিল। মালবাহী লরির চাকার ভালোবাসা নিয়ে রাজপথকে আঁকড়েঈ ঘুমিয়ে পড়ল সে। তুহিন কোন তুহিন মেরু পার হতে চলল কে জানে! দুর্নিবার গতি। কবি ততক্ষণে হাতে করে উড়িয়ে দিয়েছেন ‘কাগজের টুকরো’। স্বার্থান্বেষী সমাজযন্ত্রের কোলাজ। চার টুকরো কাগজের চক্রযান। বাবু, পুলিশ, চোর, ডাকাত, ওদের সাথে এসে যুক্ত হয়ে যান কবি, পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার তো বেশি দেরী নেই।

তবে এতসব গভীর ভাবনা ভাবার সময় নেই তাতাইয়ের। বোকা তাতাই, প্রেমে ব্যর্থ তাতাই, অসামাজিক তাতাই সময়কে চ্যালেঞ্জ জানাতে চায়। লৌকিকতার জাঁতাকল। একদলা ঘেন্নার থুতু ছুঁড়ে মারতে পারল না বদলে যাওয়া তাতাই? নাকি সে-ও সিস্টেমকে মেনে নিতে চাইছে, তাই কি ছাত্রকে সটান বলে দিল, “জল নয় এইচ টু ও। লেখো, না-হলে নম্বর পাবে না।” তাতাইয়ের নিরীহ হার দেখতে দেখতেই রোহণ পাঠককে টেনে-হিঁচড়ে বের করে আনছেন সৌন্দর্যের গণ্ডি থেকে। ‘পাশবালিশের খুনি’। লেখকের উত্তরণ তো এমন এক-একটা লেখাতেই নিশ্চিন্তে গুহানিদ্রা দেয়। যেখানে সামনের ল্যামপোস্ট পেরোলে ওভার বাউন্ডারি হওয়ার ফ্যান্টাসি নেই, আছে বিকৃত কামবোধের তীক্ষ্ণতা। সাইকোপ্যাথ। অদৃশ্য ‘সে’, যার কাছে রাস্তার বাম্পার গতিরোধকারী জড়বস্তু নয়, বরং তা সাকার, নড়েচড়ে বসা প্রাণহীন বৈপরীত্য। সেই রাস্তার ফুটপাথে পথশিশুদের মোচ্ছব হয়। একজন সেখানে কান ঠেকিয়ে ভেতরকার রহস্যটা বুঝতে চায়। কারণ ‘এই ভারতীয় ফুটপাথ ফুটো করে সোজা চলে গেলেই উলটোপিঠে আমেরিকা।’ কিন্তু শেষপর্যন্ত খুনিকেও ভয় পেতে শিখতে হয়। শব্দছকের ব্যর্থতার কাছে।

জানলার অস্ফুট নগ্নতা নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষায় একশোয় একশো পাবেন লেখক। জানলা দিয়ে কিছুটা দেখা যায়, কিন্তু পুরোটা নয়। পুরোটার জন্য জানলার সীমা পার করে যাওয়ার দরকার পড়ে। জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে অনুপ্রবেশকারী প্রতিটি চরিত্র। সকলের হাতেই বুঝি আত্মহত্যার শমন। যে আত্মহত্যার নির্বুদ্ধিতা কিনা প্রতিটি মুরগি-জন্মেই। মাইক দ্য হেডলেস চিকেন। এগারো মাস। ইতিহাসকে গর্ভে ধারণ করার এগারো মাস। জনপ্রিয়তা। এসবকে ছাপিয়ে রোহণ জেনে ফেলেছেন একটা গোপন বাস্তব-‘ওই এগারো মিনিটে মানুষ জন্মের দিকে আর মুরগিরা মৃত্যুর দিকে চলে যায়।’ কিন্তু বাজার-ক্লান্ত পাপাই কি জানতে পারল কোনোদিন?

কিংবা দোকান। পৃথিবীর মানুষের হয়ে কথা বলা চার দেওয়ালের ঘুপচি পৃথিবী। যে পৃথিবীকে মানচিত্রে চিনি সেই পৃথিবী নয়। অথচ, মানচিত্র মেপেই দ্বারে দ্বারে গল্প পৌঁছে দিত একজন পিয়োন। সেই গল্পগুলোয় একজন করে মানুষ থাকত। তাদের অভিশাপ থাকত। এইসব অভিশাপকে পসরার মতো সাজিয়ে রাখা হচ্ছে দোকানে। সে দোকানে চা আর গান একসাথে বিক্রি হয়। গানের সুরে গ্লাসে-গ্লাসে ঠোকাঠুকি লাগে। সেই সুযোগে নাবালক চা-ওয়ালারা ম্যাজিক পেন্সিলে চড়ে স্বপ্ন-পাড়ি দেয়। সত্যিকারের দোকান আঁকার মিছিমিছি-মিষ্টতায়, ঠাম্মার প্রেসক্রিপশনের পাতা থেকে ওষুধ খোঁজার দায়িত্বে তখন অল্প অল্প সমাজচেতনার ঝিলিক।

অবশেষে গভীর হয় শান্ত রাত। আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্যোৎস্না। কলঙ্ক মুছে ফেলে হাসতে থাকে চাঁদ। তার গায়ে অস্পষ্ট বয়ঃসন্ধির মার্কার।


No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমা...

পছন্দের ক্রম