[লেখকের প্রতি - এভাবে কোনো বইয়ের পাঠ প্রতিক্রিয়া দেওয়া যায় কি না, বা দেওয়া
উচিত কি না আমি জানি না। পাঠক হিসাবে আমার অপারগতা মাফ করবেন হাসনাত ভাই। অসংখ্য
রেটেড এই বইটি সম্বন্ধে আমি আর নতুন করে কি’ই বা বলব! যা কিছু বলা গেল, বললাম...
কিছু বলা গেল না, সেগুলোও বলব কখনও। ভাল থাকবেন, হাসনাত শোয়েব।]
তো, চর্বিতচর্বণ করা যাক। হাসনাত শোয়েবের “ক্ল্যাপস
ক্ল্যাপস” বইটি নিয়ে কলকাতা বইমেলা ২০১৯ এর অব্যবহিত আগে থেকে ঢাকার ২১শে বইমেলা
শেষ হবার পর এখনও পর্যন্ত যারপরনাই রিভিউ, পাঠ প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি প্রভৃতি হয়েছে।
সে ব্যাপারে দেখতে গেলে বইটির লেখা, তাহার চুল, দাড়ি, ত্বক, মায় অণ্ডকোষ নিয়েও
তুলে এধার ওধার করা হয়েছে। শোনা যায় যে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর তাঁর দাড়ি উপড়ে
নিয়েছিলেন কিছু অতি-উগ্র রাবীন্দ্রিক সমর্থক, সত্যি মিথ্যে অজানা। তবে ব্যাপারটা আমার কাছে খানিক রিলেটযোগ্য, তাই ওই প্রসঙ্গের অবতারণা। বইটি
নিয়ে কিছু না লিখলেও হত, মানে তাঁর লেখার যাবতীয় লেখনভঙ্গিমা, বচনস্টাইল,
বুননক্ষমতা এসব নিয়ে আমি কিছু বলব না আর, শুধু তাড়না থেকে লেখা, মানে লিখতে হচ্ছে।
চারফর্মা, পেপারব্যাক, শ্রী
রাজীব দত্তের প্রচ্ছদ। তাহাতে একটি ডাইনো, একটি কলাগাছ, একটি কাটা পা (যা শক্তি
চট্টোপাধ্যায়ের “যেতে পারি কিন্তু কেন যাবো” বইটির প্রচ্ছদের কথা মনে করায়) একটি
ন্যাংটো মানুষ, হাতে ফুল, ও হ্যাঁ, কলাগাছটিতেও ফুল – যথাযথ। কবিতার বই আলোচনায়
কেন যে কেউ প্রচ্ছদ শিল্পীর ভূমিকা নিয়ে কিছু বলেন না!
“আর কালো হ্যাট পরা ঘোড়াটি ভিজতে ভিজতে সন্ধ্যার দিকে
গড়িয়ে যায়” – উৎসর্গের দ্বিতীয় লাইন। ঘটনা হল, বইটি কোন দিকে যেতে চাইছে বা
কিভাবে আপনাকে হাসনাত সাহেব খুন করবেন, সেটা এখানেই তিনি স্পষ্ট আভাস দিয়ে রেখেছন।
বস্তুত জেনে যাওয়া গেল এক তুমুল ধ্বস্তাধস্তি হবেই। শব্দটব্দ এলোমেলো হবে, পিছনে
তীব্র স্যাক্সোফন বাজবে, একটা রুদ্ধশ্বাস ব্যাকগ্রাউণ্ডের সামনে দুজন লোক
চারফর্মার ভেতর খুন আর বাঁচার চেষ্টা করবে। বেসিক্যালি একটা বেশ ভালোরকম থ্রিলার। নেহাত
বাংলা বাজার বলে তাই, না হলে এ বই নিয়ে অনেক কিছু হতো, হতোই। বাংলা বাজারে এই
স্তরের থ্রিলার হজম করার লোক তেমন আছে কি! থাকলে হাত তুলবেন, কেমন?
সিন ১ – এখানে হাসনাত সাহেব
দশটি লেখায় কুড়িটি হাত এবং কুড়িটি তালি ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি তালির ডাকেই আছে
অন্ধকার ম্যানগ্রোভের ছবি। এক একটা জাম্পকাটে তিনি বাংলাদেশ থেকে জেরুজালেম
গিয়েছেন, পরের সিনে হাসপাতাল, পরের সিনে দুপুরের অন্ধকারে বিষণ্ণতা নিয়ে বসে থাকা
মেয়েটির বুকে ছুরিও ধরেছেন। ওঁর লেখায় একদম হোগলা ছাউনির ভেতর কাঠের উনুনে তৈরী
হওয়া একটা প্যানকেক দেখা যাচ্ছে বলে মনে হয়। মেয়েটি রাফালা হতে পারে অথবা আয়েষা,
তালির শব্দটি এক... কুড়িটি হাত একই মাংসে তৈরী, দশটি লেখা... ব্যস
সিন ২ – এখানে সাড়ে তিনশো স্কোয়ার ফুটের বিষণ্ণতা। এখানে
আপনাকে সেভাবে বসতে দেবেন না হাসনাত ভাই, যদিও খানিক বসতে ইচ্ছে আপনার করবে,
কিন্তু স্থান সঙ্কুলান হবে না কবির জন্যই। সামান্য সময়খানি তিনি আপনার মুখের ওপর
বালিশ চেপে ধরবেন, আপনার হাঁফ উঠলে, সরিয়েও নেবেন যথারীতি। এত সহজে মুক্তি কে’ই বা
পেয়েছে কবে!
“... হাঁসের ডানার নিচে কোলাহল করে তোমাদের মায়েরা। ইয়াবার
মৌসুম ফুরিয়ে গেলে তাদের কান্না পায়”
সিন ৩ – এবার, আপনি
বিধ্বস্ত বুঝতে পেরেই কবি সামান্য বৃষ্টি নামান, শমোসন। এখানে “একটি পাখি ইতিমধ্যে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে”। সুতরাং মৃত পাখিটির পাশে আপনি পর্দা নিয়ে অপেক্ষা করছেন। আপনি হত্যাদৃশ্যগুলি
পরপর রিওয়াইন্ড করে দেখছেন, মনে রাখছেন কিছু, মনে রাখছেন না এমন কিছুও ঘটে কিন্তু চলেছেই।
যেমন আপনি হয়তো খেয়ালই করলেন না “পাখিদের আত্মা নিয়ে
খেলে যাচ্ছে একজন প্রবীণ কয়েদি”। এক্ষেত্রে আপনি পিয়ানোটির নোট
শুনে থাকবেন। কবি আপনাকে বিভিন্ন ধরনের কান্না শোনাচ্ছেন, মানসিক ভাবে আপনাকে শেষ
করে দেবার জন্য উনত্রিশটি পেরেক নিয়ে তিনি এসেছেন। বৃষ্টি আপনাকে পর্যুদস্ত করে
ফেলেছে, আপনি নেতিয়ে পড়েছেন যেভাবে ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ, তীব্র পশুখামারের সামনে
নেতিয়ে পড়ে, অথচ এখানে হাসনাত সাহেবের কাছে সত্য দুটো’ই। ল্যাভেণ্ডারকে যেমন তিনি
অস্বীকার করছেন না, তেমন পশুখামারটিকেও নয়। তিনি বলছেন সন্ধ্যার কথা, যেভাবে উৎপল
তাঁর নিরক্ষর বেশ্যাদের চিঠিগুলি লিখে দিয়েছিলেন, তিনিও বলছেন – “সন্ধ্যার পর এই তল্লাটের ক্যাসিনোগুলো হয়ে ওঠে প্রাচীন
ধর্মশালা। দূর থেকে তুমি শুনতে পাবে প্রার্থনা সংগীত। ... জেরুজালেম শহর এরপর জেগে
উঠবে মনোহর কত্থকনৃত্যে”। এই বিস্তৃর্ণ সময়ের মধ্যে
আপনার মৃত্যু সংক্রান্ত যাবতীয় অর্গ্যাজম খতম করে নিন। হাসনাত সাহেব এই পেরেকগুলির
মাঝে সামান্য পজ দিয়ে সে সুযোগ আপনাকে করে দিয়েছেন। আসন্ন ভোরে আপনার মাথার
চুলগুলি অবিন্যস্ত হয়ে থাকবে। আপনি আয়না দেখার ক্ষমতা হারাবেন। শমোসন, আপনাকে ধার
দেওয়া দু’টো পা খুলে নেবার সময় কবি আপনাকে মাটির রক্ত দেখাতে বললে, আপনি পারবেন
তো?
সিন ৪ – শেষ অধ্যায়ে,
অনেকগুলি পাখি আপনার ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া গেল। প্রতিটি পাখির পাখা, চিঠির কাগজের
মতো ফড়ফড় করে আপনার ভেতর উড়ছে। আপনি নিশ্চয়ই দেখতে পাচ্ছেন, ঘুম ভেঙে উঠে একগাদা
ডালিমের সামনে বসে আছেন। ডালিমগুলো অন্ততপক্ষে সাড়ে সতেরো হাজার চোখে আপনাকে
দেখছে, আপনার শুশ্রুষা, ভ্রমণ, যন্ত্রণা এসব থেকে ইন্তেকাল আসন্ন। আপনার মন খারাপ
না করার জন্য হাসনাত সাহেব বলছেন – “ট্র্যাজেডির
দৃশ্য শেষ হলে আনাতোলিয়া ঘরে ফিরে আসবে। তাঁর কোলে থাকবে সাতটি ফুটফুটে ডুমুর...
সাতটি রজঃস্বলা ফুল”।
আপনি বইটি এবার বন্ধ করতে পারেন। আপনি সম্পূর্ণভাবে খুন
হয়েছেন। সন্ধ্যার রাস্তায় আপনার ভেতর আপনি শুয়ে আছেন আর দেখুন কি নিদারুণ বৃষ্টি
ফেলছেন হাসনাত ভাই, কি ক্যাটস অ্যাণ্ড ডগ বৃষ্টিতে “...কালো হ্যাট পরা ঘোড়াটি ভিজতে ভিজতে সন্ধ্যার দিকে
গড়িয়ে যায়”।
[ক্ল্যাপস ক্ল্যাপস – কবি হাসনাত শোয়েব
প্রচ্ছদ – রাজীব দত্ত
ঐহিক প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ – কলকাতা বইমেলা, জানুয়ারি ২০১৯
মূল্য – ৮০ টাকা ]
No comments:
Post a Comment