Friday, April 12, 2019

শাহীন আখতারের ‘অসুখী দিন’ : একটি স্বপ্নিল বুদবুদের পুনরাবিষ্কার- হারুন রশীদ





দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, উদ্বাস্তু সমস্যা, আরোপিত দুর্ভিক্ষ, আজাদ হিন্দ ফৌজ, সুভাষ বসুর অন্তর্ধান, ইত্যাদি ইস্যু নিয়ে প্রচুর বইপত্র লেখালেখি হয়েছে উপমহাদেশে। তা সত্ত্বেও নতুন নতুন বাস্তবতার আবিষ্কারে চমকিত হয় পাঠক। সুলেখক শাহীন আখতারের 'অসুখী দিন' পড়ে  তেমন এক নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হলো। দেশভাগের প্রাক্কালে শিলং অঞ্চলে বাঙালী খাসিয়ার দ্বন্দ্বটি আঞ্চলিক বৈরী সম্পর্কের বিষয়টি অনেকেরই অজানা। এছাড়া এই উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়টি উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে শেকড় থেকে জড়িয়ে রেখেছে দুই দেশের দুটি সমান্তরাল চরিত্র রেখার অভূতপূর্ব এক বুননে।
উপন্যাসটির কাঠামো নির্মিত হয়েছে দুটি স্মৃতি কথা এবং ছোট্ট একটি ডায়েরীর যোগফল দিয়ে। পাঠক যাত্রা শুরু করবেন দুই স্মৃতিচারণের সমান্তরাল প্রবাহ দিয়ে। একই উপন্যাসে দুটি সমান্তরাল চরিত্রের বিবরণ যখন অব্যাহতভাবে চলতে থাকে তখন তার মধ্যে সংযোগ স্থাপনের জন্য পাঠকের পক্ষে একটা প্রবল তাগিদ থাকে। পড়তে পড়তে সেই তাগিদটা আমিও অনুভব করেছিলাম কিন্তু কখনো সেই সংযোগ রেখা স্পর্শ করতে পারছিলাম, কখনো আবার খেই হারিয়ে ফেলছিলাম।
এভাবে চলতে চলতে ঘটনা যখন বাড়ির উঠোন ছাড়িয়ে দেশের রাজনীতি পেরিয়ে মহাযুদ্ধের বিশাল ব্যাপ্তির মধ্যে হারিয়ে যেতে বসেছিল তখনই পাঠক কাঙ্খিত সংযোগটি পেয়ে যায়। যেখানে দুই স্মৃতিকথায় বর্ণিত দুই চরিত্রের যোগাযোগ ঘটে গেছে। তবে সেই সংযোগ ঠিকানাটি একটি জংশনের মতো। যেখানে দুজন যাত্রী দুই আলাদা ট্রেনে উঠে রওনা দেবে একই গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। একটি ট্রেনে বাংলাদেশের সাবিনা, যার পিতা সুভাস বোসের আজাদ হিন্দের সৈনিক ছিলেন। অন্য ট্রেনে অনিতা সেন, যার দাদা আজাদ হিন্দের হয়ে যুদ্ধে গিয়ে ফেরেননি।
সাবিনার পিতা এবং অনিতার ভ্রাতা যে আজাদ হিন্দ ফৌজের সহযোদ্ধা ছিলেন সেটা পাঠক বইয়ের ফ্ল্যাপেই জেনে যাবেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে সাবিনার বাবা ফিরে এলেও তাঁর সহযোদ্ধা নীরু ফেরেনি। কেন ফেরেনি সেই উত্তর অনিতা সেনের স্মৃতিকথায় নেই। সেই পরিণতিটার সন্ধান করে গেছেন সাবিনা। নীরুর শেষ পরিণতি জানতেন সাবিনার পিতা।
সিলেট থেকে ঢাকার ট্রেনে চড়ার পর সাবিনা যখন সময় কাটাবার জন্য ১০০ টাকায় কেনা পুরোনো বইটি পড়তে শুরু করেন তখনো কল্পনা করেননি এই বইয়ের সাথে তাঁর পিতার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়ের গভীরতম যোগাযোগ আছে যে অধ্যায় তাঁর জীবন থেকে বুদবুদের মতো উবে গিয়েছিল।
অনিতার স্মৃতিকথা পাঠ শেষে সাবিনার আসল কাজ শুরু হয়। সাবিনা তার মায়ের মাধ্যমে বাবার কাছ থেকে নীরুর পরিণতির কথা জানতে পারেন। এরপর সাবিনা সিদ্ধান্ত নেয় যে কোন উপায়ে অনিতা সেনের কাছে পৌঁছে দিতে হবে বাবার দেয়া নীরুর শেষ পরিণতির তথ্যটি।
কিন্তু এত বছর পর অনিতা সেনকে খুঁজে বের করা সম্ভব? হ্যাঁ- সেও সম্ভব হয়েছিল। সংবাদকর্মী সাবিনাকে তাঁর মেজভাই অনুরোধ করেছিল বাবার জীবনের হারিয়ে যাওয়া অধ্যায় নিয়ে তাদের পরিবারের সোনালী ইতিহাস লেখার জন্য। অনিতা সেনের স্মৃতিকথা তাঁকে সেই সেই পথটা সহজ করে দিয়েছিল অনেকটাই। সেই পথ ধরে এগিয়ে অনিতা সেনের ব্যাপারে খোঁজ নিতে সাবিনাকে কলকাতা যেতে হয় বইটির সুতর খুঁজতে। কলকাতায় গিয়ে যেসব সুতর মেলে তাতে জানা যায় অনিতা সেন এখনো জীবিত আছেন শিলং এর সেই পৈত্রিক বাড়িতে। সাবিনা তখনই সিদ্ধান্ত নেন শিলং গিয়ে অনিতা সেনের সাথে দেখা করবেন। তবে একটু বিলম্ব ঘটে গিয়েছিল মাঝপথে।
উপন্যাসের শেষ পর্বে শিলং পৌঁছে যাবার পর তাঁর জন্য অপেক্ষা করছিল অন্য এক বিস্ময়। সে বিস্ময় পাঠকের জন্য জমা থাকুক। আমরা বরং অন্য কিছু বিষয়ে দৃষ্টিপাত করি।
‘অসুখী দিন’ পড়তে গিয়ে পাঠমুগ্ধতার পাশাপাশি উপন্যাসে তিনটি তথ্যবিভ্রাট চোখে লেগেছে।
১. অনুমান করা হয়েছে সিলেট স্টেশন এড়িয়ে হিল সেকশন রেলওয়েতে করে শিলং থেকে চট্টগ্রাম এসেছিলেন মোয়াজ্জেম হক ও নীরদচন্দ্র সেন। কিন্তু শিলং থেকে চট্টগ্রামের কখনোই কোন রেল যোগাযোগ ছিল না।
২. হিরোশিমাকে একটি দ্বীপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু হিরোশিমা দ্বীপ নয়। উপকূলীয় শহর।
৩. মুক্তিযুদ্ধের আগেকার উত্তাল সময়ে জনপ্রিয় একটি শ্লোগান উল্লেখ হিসেবে করা হয়েছে 'সংগ্রাম সংগ্রাম ১১ দফার সংগ্রাম'কিন্তু এর চেয়ে 'জয় বাংলা' বা 'তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা' শ্লোগানটি বেশী জনপ্রিয় ছিল বলে মনে হয়।
আর দুটো বিষয়ে পাঠকের পর্যবেক্ষণ এরকম-
ক. শুধুমাত্র মাইজভাণ্ডারী গান শোনার অপরাধে কাশেম মিয়ার মতো অনাহারী পঙ্গু অথর্ব একটা মানুষকে হত্যা করাটা ঠিক বাস্তবসম্মত মনে হয়নিজঙ্গী ওহাবীরা হত্যার জন্য আরো ভালো টার্গেট বেছে নিতেই দেখা গেছে। কাশেম মিয়ার হত্যাকাণ্ডটি উপন্যাসের জন্য কেন প্রয়োজন ছিল সেটা বোঝা যায়নি।
খ. অনিতা সেনের ভাবনায় রাশিয়ার বিপ্লবী তানিয়ার আত্মাহুতি দেবার ছোট্ট ঘটনাটি কাজ করে, কিন্তু তানিয়ার ঘটনাটি সেই আমলে এত দ্রুত ভারতে পৌঁছে যাওয়াটা একটু অবিশ্বাস্য ঠেকেছে।
এমন ছোটখাটো দু’একটি অসঙ্গতি ছাড়া বইটি আনন্দের সাথে রোমাঞ্চের উপযোগ সহকারে পাঠ করা যায়। ‘ময়ূর সিংহাসনে’ যে শাহীন আখতারের সাথে পরিচয় ঘটেছিল, ‘অসুখী দিনে’ পরিচয় ঘটে নতুন এক লেখক সত্ত্বার যেটা পাঠককে নবরূপে বিমোহিত করতে সক্ষম হয়েছে।
সবশেষে উপন্যাসের একটি বিশিষ্টতার কথা না বললেই নয়। বস্তুত এই বিশিষ্টতার সাথে আমাদের পরিচয় ঘটানোর জন্যই লেখক এই উপন্যাসটি লিখেছেন বলে আমার ধারণা।
উপন্যাসটিতে সুভাস বসুর সৈনিক মোয়াজ্জেম হকের চরিত্রের মাধ্যমে দেশভাগের চেনা বেদনার অচেনা কিছু চিত্র আমরা পেয়ে যাই। আছে কিছু মর্মান্তিক সত্য, অপ্রিয় বাস্তবতা। চল্লিশের দশকে যারা ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিলেন সুভাষ বসুর নেতৃত্বে, সেই স্বপ্নবাজদের একদল ছিল ভারতীয়, আর ছোট্ট একটা দল ছিল অভারতীয়, সাবিনার বাবা মোয়াজ্জেম হক ছিলেন অভারতীয় দলেযার স্বপ্ন সফল কিংবা ব্যর্থ হয়েছিল কিনা সেটা ভাবার জন্য পাঠককে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকতে হবে। ইংরেজের হাত থেকে দেশ স্বাধীন হয়েছিল ঠিক, কিন্তু সেই দেশটি পাকিস্তান, যার সূচনাতেই হোঁচট খেয়ে পড়তে হয়েছিল মোয়াজ্জেম হককে। কেননা তাঁর নেতা পাকিস্তানের কেউ নন, পাকিস্তানে তিনি অবাঞ্ছিত। যেসব মানুষ স্বাধীন ভারতবর্ষ চেয়ে পাকিস্তানের নাগরিক হতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাদের সেই স্বপ্নগুলো বুদবুদের মতো মিলিয়ে গিয়েছিল। সেই মানুষগুলোকে আমাদের কারো মনে নেই। কেননা ওই স্বপ্নভঙ্গের পরপরই বাংলাদেশ পাকিস্তানের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে শুরু করে, বাহান্নর ভাষা আন্দোলন দিয়ে যাত্রা করে যার সমাপ্তি ঘটে আরো অনেক বেশী রক্তক্ষয়ী চেতনা সমৃদ্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের স্বাপ্নিকদের সামনে অপাংক্তেয় হয়ে পড়েন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের স্বাধীনতা সৈনিক মোয়াজ্জেম হক। তিনি এই প্রজন্মের কাছে অচেনা। এই অচেনা মানুষকে 'অসুখী দিনে'র মাধ্যমে আমাদের সামনে শাব্দিক চিত্রায়নে উপস্থাপন করে মোহিত করেছেন শাহীন আখতার।


No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমা...

পছন্দের ক্রম