Thursday, April 11, 2019

একটি অন্তর্ঘাতী রূপকথা- শৌভিক গুহ সরকার





কেমন আছি আমরা? ভালো না মন্দ? সত্যে না মিথ্যায়? আপোষে না স্বাধীনতায়? নিখিল বিশ্ব পালটে যাচ্ছে, কিন্তু আমরা? বাইরে থেকে পালটে যাওয়া আছে, কিন্তু ভেতরে? এই সমাজ আজও কতটা মুক্ত? আজও কতটা সাম্যে রয়েছে? আদও রয়েছে কি? যদি আমরা একটা বিকল্প খুঁজতে চাই, তাহলে কোথায় খুঁজব আমরা? সেই বিকল্প খোঁজার অধিকার কি আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের রয়েছে? এইসব বোধের কিনার ছুঁয়ে বয়ে গেছে হিন্দোল ভট্টচার্যের প্রথম উপন্যাস-নাশকতার বারান্দা এতদুপরি, এই উপন্যাস দুটি সমান্তরাল সময়বৃত্তের একত্রে উপস্থিতির কথা তুলে ধরছেএই দুই কালচক্র যেন অনন্তে ঘুরতে ঘুরতে এসে পাশাপাশি এসে দাঁড়িয়েছেদুটোই সত্য, দুটোই রয়েছে। ঠিক এখানেই লেখক বলিষ্ঠ আঘাত হানছেন পাঠকের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত সমন্বিত প্রবহমান সময়চেতনার মূলে। আর খুব আশ্চর্যভাবে বইটি পড়ার কয়েকদিন পর আমার হাতে এসে পৌঁছয় একটি সাম্প্রতিক বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব—‘ব্লক ইউনিভার্স’, যে তত্ত্ব বিশ্বাস করেছেন বিজ্ঞানমহলের একাংশ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ একই সঙ্গে ক্রিয়াশীলতারা কো-এক্সিস্ট করছে কারণ সময়ের যাত্রাপথ সরলরৈখিক নয়। পালটে যাচ্ছে সময়ের প্রচলিত সংজ্ঞা, পালটে যাচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের মানে আর ঠিক এই জায়গায় ‘নাশকতার বারান্দা’ উপন্যাসটি আমাদের এক জটিল, অন্ধাকারাচ্ছন্ন ও রক্তাক্ত প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, ঠেলে দিচ্ছে গভীরতর আত্মসমীক্ষার দিকে।

বিষয়বস্তু
নাশকতার বারান্দা যে মৃত্তিকার ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, তা মূলত রাজনৈতিক এবং তার ওপর ডায়লেক্টিক্সের ছায়া গভীর। প্রথম কয়েকটি অধ্যায়ে (ষষ্ঠ অধ্যায় পর্যন্ত) লেখক আমাদের চারপাশ, সময়, ঘেঁটে-যাওয়া-রাজনৈতিক মতাদর্শ, গণচেতনার অচলায়তনের কথা বলছেনকিছুই যেন নড়ছে না – জীবন, ধারণা, বেঁচে-থাকার-লড়াই—শুধু তার রূপটুকু পালটে যাচ্ছে। অতি মোক্ষমভাবে তিনি প্রথম অধ্যায়তেই লিখছেন,

ইংরেজরা নেই। তাদের দেওয়া নামও নেই। দমদম রোড এখন উমাকান্ত সেন লেন। কিন্তু সাধারণ মানুষের কাছে, ঔপনিবেশিকদের মতোই রাস্তার নাম বদলায়নি। হয়ে আছে দমদম রোড। যতই নতুন নতুন নাম দেওয়া হোক না কেন, যদি একবার এক নামে অভ্যেস হয়ে যায় জাতির, তবে সেই নাম পালটানো খুব মুশকিলের। আসলে নাম তো নয়, একটা ধারণা মনের মধ্যে বসে গেলে, তার সঙ্গে জীবন যাপন সহজ হয়ে এলে, তার সেই ধারণাটিকে পালটানো সহজ কাজ নয়।

এইখানে লেখকের থিসিস। আমাদের জীবনযাত্রা পাল্টাচ্ছে, উঁচু ফ্ল্যাট উঠছে, কফিশপ তৈরি হচ্ছে, কিন্তু শ্রেণী বৈষম্য কমছে কী? আমাদের সমাজের পোশাক পাল্টাচ্ছে, কিন্তু নড়ছে কী? সমান্তরাল রেখায় লেখক তুলে আনছেন নকশালদের কথা। তিনি দেখাতে চাইছেন যে, সেই সময়ে সমাজ নড়েছিল আমূল। নকশাল আন্দোলন সফল না হলেও তার মধ্যে ছিল ‘দম’। প্রকৃতভাবে পালটে দেবার ইচ্ছা।

উপন্যাসে দমদমের ছেলে রাজা গ্র্যাজুয়েশন করছেতার দিদি দেবযানী—মেধাবী ছাত্রী কিন্তু কিডনি ফেলিয়ারের কারণে শয্যাশায়ীতার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করতে লাগবে অনেক টাকা। কিন্তু সে টাকা আসবে কোথা থেকে? রাজার বাবা সুজয় একজন নিষ্ঠাবান ‘কমিউনিস্ট পার্টির ধার্মিক ক্যাডার’ তার কাকা সুবীর কবিতা লেখে এবং টিউশানি করে। তার মা সুরমা একজন সাধারণ গৃহবধূ। কী করে পারবে তারা এই টাকা জোগাড় করতে? রাজার সঙ্গে রতনদার বন্ধুত্বরতনদা একসময়ে গুণ্ডা ছিল, এখন প্রোমোটার এবং বিজনেসম্যান। রাজা ভেবে পায় না কী ভাবে তার দিদিকে বাঁচাবে? হতাশা ছড়িয়ে রয়েছে চারপাশে, কোথায় আলো? কোথায় মুক্তি?

গোটা পৃথিবীটাই মনে হয় মাঝে মাঝে কান্না দিয়ে তৈরি। আমাদের এই আদর্শ, এই বিপ্লবের রূপকথা, এই হিংসার কাহিনি, প্রতিহিংসার রূপকথা সমস্ত কিছুর মধ্যে গুনগুন করছে কান্না। কত শতাব্দীর কান্না, কত অন্ধকারের কান্না, কত আলোর কান্না। এভাবে মানুষের জন্ম নেবার কারণটাই বা কী? আর এভাবে একটা দুঃখের সমুদ্রের মধ্যে নিজেদের ভাসিয়ে দেবার কারণটাই বা কী?

ঠিক এই সময়ে লেখক অবতারণা করেন তাঁর অ্যান্টি-থিসিস। আমরা বাস্তব ছেড়ে ঢুকে পড়ি এক অধিবাস্তবের জগতে। উপন্যাসের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ ঘটে সুরেন্দ্রনাথের। যাঁর চেহারা রামমোহন রায়ের মতো। তিনি একজন বৈজ্ঞানিক, যাঁর নেতৃত্বে একটি তিরিশ জনের দল একটি টাইম মেশিনে করে উনিশ শতক থেকে একুশ শতকে এসে আত্মপ্রকাশ করল। তাঁর হাত ধরে শুরু হয় একটি উত্থানপতনময় ঘটনাপরম্পরাতাঁর হাত ধরে পালটে যায় রাজাদের জীবন। তিনি দমদমের একটি পরিত্যক্ত গ্যারেজে শুরু করেন জন-সংগঠন। তৈরি হয় এক বিকল্প পৃথিবীর ধারণা। তিনি বলেন,

আপনাদের সকলকে চাই, বাঙালির ইতিহাসকে বাঁচানোর জন্য। আর সেই কারণেই একটা বারান্দা দিয়ে আমরা হেঁটে চলে এসেছি এই সময়ে। একটা ছোটখাটো যুদ্ধ দরকার। কিন্তু সে যুদ্ধটা হবে একটা ভুলে যাওয়া ইতিহাসকে বাঁচিয়ে তোমার মাধ্যমে।

এরপর উপন্যাসের কেন্দ্রে চলে আসে সংঘাত—স্থবির ও জঙ্গমের, সাম্প্রতিক ও ইতিহাসের, বাস্তব ও অধিবাস্তবের, থিসিস এবং অ্যান্টি-থিসিসের। মুক্তাঞ্চল স্থাপন করার সংগ্রামের শেষে উপন্যাসের অন্তিমে থাকে সিন্থেসিসের ইশারা,

মানুষ ভেবে চলেছে কবে, ঠিক কবে, বারান্দা পেরিয়েই সে চলে যেতে পারে কোনো এক নিরুপদ্রব পৃথিবীর দিকে।  . . .  মানুষ অপেক্ষা করছে। বিপ্লব আসছে। আসবেই।

তবু, এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন যে, মূল কাঠামোর বাইরেও বহুকৌণিক এই উপন্যাসের মধ্যে বয়ে চলেছে অজস্র চোরাস্রোততর্ক-প্রতিতর্কের মধ্যে দিয়ে উঠে আসছে একের পর এক বিষয়— নকশাল আন্দোলন, মাওবাদ, ধর্ম, নিয়তি, ঈশ্বরবাদ, রাজনীতি, মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ নাশকতার বারান্দার বিষয়-চালচিত্র আমাদের গভীরতর ঐকান্তিক ভাবনার দিকে ঠেলে দেয়।

আঙ্গিক
নাশকতার বারান্দা উপন্যাসের আঙ্গিক আমাদের মনে করিয়ে দেবে মিলান কুন্দেরার উপন্যাসের আঙ্গিকগুলোকে। লেখক এখানে শুধুমাত্র একটি গল্প বলছেন না, একটি তত্ত্ব উপস্থাপন করছেন না, তিনি তাঁর উপলব্ধির কথা লিখছেন, তাঁর যন্ত্রণার কথা, তাঁর দর্শনের কথা। এ কথা কোনো চরিত্র বলছে না। এটা লেখক নিজে বলছেন। ঘটনা-পরম্পরার মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে সরাসরি কথা বলছেন পাঠকের সঙ্গে, যেমন ইটালো ক্যালভিনো বলেছেন তাঁর স্বগতোক্তি আমাদের দাঁড় করিয়ে রাখছে, ভাবাচ্ছে, আত্মসমীক্ষা করতে বাধ্য করছে,

পুরোটাই হল দমের খেলা। একটা মানুষ জানে, যে সে হেরে যাচ্ছে, সে হেরে যাবে, তবু সে লড়বে, লড়ছে। এটাই হল জীবন।  . . . কিন্তু বয়স যত বাড়ে, যত সময় কমতে থাকে, তত এই দম ফুরিয়ে যায়। তখন যে বলত ‘হবেই’ সে বলে ‘হতে পারে’, কে জানে! আবার না-ও হতে পারে। ধীরে ধীরে সে কথাটাও বদলে গিয়ে হয়—কিছুই হল না, ভাগ্য। সকলের ভাগ্য তো সমান থাকে না।
অথবা
রাতের বেলা কুকুরের অসহায় কান্না শুনলে যেমন মনের মধ্যে এক অজানা আশঙ্কা গুনগুন করে, ঠিক সেরকম হয়ে আছে আমাদের অস্তিত্ব। আমরা সেই অস্তিত্বের কার্যকারণ কিছু খুঁজে না পেয়ে ভাবতে বসে গেছি, আর কিছু হওয়ার নেই।

আবার একই সঙ্গে হিন্দোলবাবু মেশাচ্ছেন মার্কেসকে মেশাচ্ছেন অধিবাস্তবে। একুশ শতকে ফিরিয়ে আনছেন উনিশ শতক। মুছে দিচ্ছেন বাস্তব-অবাস্তবের ভেদরেখা। চমকে উঠতে হয়, যখন পড়ি,

‘. . . আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই একটা ভিন্ন সময়জোনে বাংলা জেগে উঠল। কিন্তু, এ খবর ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগল না যে, দেশ থেকে বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। স্যাটেলাইট ভিশনে সারা বিশ্ব এবং এই দেশ তখন দেখছিল কীভাবে বাংলা সময় ছাড়াই চলছে। কিন্তু কোনোরকম যোগাযোগ করা যাচ্ছে না কারোর সঙ্গে। সকলেই যেন খুব মুক্ত।

আবার একই সঙ্গে লেখক বারংবার তাঁর ন্যারেটিভের মধ্যে কবীর সুমনের মতো অবলীলায়, লুকোচুরি না করে, প্রকাশ্যে তুলে ধরছেন তাঁর ‘ইনফ্লুয়েন্সের’ কথা। তাঁর কাঙাল মালসাট প্রীতির কথা। তিনি লেখক হিসেবে অতি সচেতন এই প্রসঙ্গে এবং তাই, বলিষ্ঠভাবে প্রয়োগ করছেন ইন্টার-টেক্সচুয়ালিটি। কাঙাল মালসাট বুনে দিচ্ছেন তাঁর ন্যারেটিভের সঙ্গে। অদ্ভুত একটা চাপা কৌতুক ফুটে ওঠে তাঁর উপস্থাপনায় যখন তাঁর চরিত্রদের মুখে শুনতে পাই,

‘সেই তো ফ্যাতাড়ুর প্লট।  . . .  কিন্তু গল্পটা তো একই রকম হয়ে যাচ্ছে। যে লিখছে সে তো আর ফ্যাতাড়ু আর অন্তর্ঘাত ছেড়ে বেরতে পারছে না। এটা কি তাহলে একটা নতুন গল্প হল?’
একই সঙ্গে উপন্যাসের শেষে আমরা পাচ্ছি আমেরিকান থ্রিলারের গাঢ় ঘ্রাণ।

‘নাশকতার বারান্দা’, বাংলা উপন্যাসের জগতে একটি উজ্জ্বল প্রবেশ। উপন্যাসের বিষয়বস্তু, তার আঙ্গিক—এই দুয়ের অভিনবত্ব অনস্বীকার্য। এই উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে বিস্তর ভাংচুর, যা আমাদের ভাবতে বাধ্য করে, আত্মখননের ধারে নিয়ে গিয়ে দেখায়—সর্বগ্রাসী পরাজয়ের চোয়াল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে কীভাবে একদিন নতুন আকাশে উড়াল দেবে অপরাজেয় মাছমোরাল।


নাশকতার বারান্দা
হিন্দোল ভট্টাচার্য
প্রচ্ছদ- দেবাশিস সাহা
দাম-২০০টাকা

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমা...

পছন্দের ক্রম