পরিচয়ের আড়ালে ঘটনার সত্যরূপ দেখবার মানসে, হৃদয়ে মাছরাঙার ধ্যান নিয়ে, বেদনাতীত হয়ে ও আনন্দের চিরজল মেখে কবির যাত্রা--আপন বিশ্ব তৈয়ারের উদ্দেশ্যে।
কবি মণিশংকর বিশ্বাস এর প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'চন্দনপিঁড়ি' প্রকাশ পায় ২০১৫ সালে, সপ্তর্ষি প্রকাশনী থেকে।
আমার এই সামান্য লেখাটি কবিতার বইটির সঙ্গে কিছুকাল কাটাবার অভিজ্ঞতা, এ কোনওভাবেই যথাবিধি পাঠপ্রতিক্রিয়া নয়। যেন নিরালায় এসে দাঁড়িয়েছি একটি মন্দিরে, তাকে দেখছি রৌদ্রে-ভরা বাদলে, তার রূপ প্রত্যেকবারের দেখায় পৃথক, অনন্য বোধের দুয়ার খুলে দেয়।
কাব্যগ্রন্থটির নাম বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার মতো, চন্দনকাঠ অবশ্যই দুর্মূল্য। সাজে,
প্রকরণে নয় নিশ্চয়ই, তার মূল্য ঘ্রাণে। পিঁড়ি, যা গ্রামবাঙলার এক নিত্য ব্যাবহারের জিনিস ছিল, অধুনা আমাদের অনেকেরই জীবন থেকে বিদায় নিয়েছে। দুর্মূল্য, সুরভিত অতীতের কাছে কি নিজে ফিরে যাব, একা?
নাস্তিকের ঈশ্বর কোজাগরী রাতে দেখা দেন। ছেঁড়া জামা থেকে দেখা যায় তাঁর চকচকে কাঁধ। আর মণিশংকর তখন লিখছেন--
'পৃথিবীর আলো কমে আসে
দূরে শশাক্ষেতের 'পরে একটি বা দু'টি প্রজাপতি--
ত্রিকোণ হলুদ। আর মেঘের আড়ালে বৃষ্টি।
ঘোর চঞ্চলতা।
শুধু নিজের নিজের কাছে ফিরে যেতে গিয়ে দেখি
বিকল ঘড়ির মতো বিঁধে আছি কবেকার সময়বিন্দুতে
তুমি হাসো
আলো কমে আসে পৃথিবীর।'
(চাঁদ-এক/পৃঃ-৪)
এই কবিতাটির sublimity বা উদাত্ত সুরে যে বরদাদক্ষিণ আছে অপার কল্পনার, অলৌকিক মরমী সৌন্দর্য দেখতে পারবার মতো চোখ, তা স্তব্ধ করে। কোন কল্পনায় এই দৃশ্য ভেসে আসে? কে আসে, কে দাঁড়ায়, মলিন করে দেয় আর সবকিছুর প্রতি টান! আজীবন পাঠশালায় যা শিখেছি, দেখেছি জ্যোৎস্না উঠলে ভুলে যাই। চাঁদ এবং ভালোবাসার জন সম্পর্কিত কল্পনা থেকে এ পৃথিবীর জ্যোৎস্নাকামী মানুষ কতশত কিছুই না ভেবেছেন। তবু হয়তো এরকম একটি লাইন লেখা হবে না আর...
'তুমি হাসো
আলো কমে আসে পৃথিবীর।'
কী শান্ত, আক্ষেপবিহীন এই উচ্চারণ!
'স্বাভাবিকতার বশে ব্যর্থ ক'রে দিলে অই দুটি হাত
একদা আমার ছিল।'
(চাঁদ-২/পৃঃ-৪)
বহু-বিভিন্নমাত্রিক দর্পণে--একটিই শাশ্বত মুখ--যে রূপময়তায় আভাসিত হয়ে ওঠে, তার যন্ত্রণায়, বিরহে, আক্ষেপানুরাগে-- যা উঁকি দেয়, প্রমাণ করে, সে অভিন্ন...
'এখন ঘাসের 'পরে টুকরো টুকরো কাচ
ঝুঁকে পড়ে মুখ দেখি। মনে হয়
প্রতিটি আমার মুখ, তোমার...'
(আরশিনগর/পৃঃ-২)
আমরা চাই, মিলিত হতে। রবীন্দ্রনাথ বললেন, 'আমরা যাহার সহিত মিলিত হইতে চাহি সে আপনার মানস সরোবরের অগম তীরে বাস করিতেছে। সেখানে কেবল কল্পনাকে পাঠানো যায়। সেখানে সশরীরে উপনীত হইবার কোনো পথ নাই।'
'তোমার স্নিগ্ধ রূপ একদিন আমি হেসেখেলে পার ক'রে যাব
তবু তার আগে আচমকা মরসুমি ফুলের বাগান থেকে
উধাও কুয়াশা, আর ভোরে শীতের রোদের মধ্যে
বহুদূর থেকে দেখা যায়, কচি ডাবের খোলার 'পরে
লাফ মারে ছাগশিশু--এই আলো,
এই টান, এই ছিঁড়ে আসা -- যেন মায়া লাগে
যেন জন্মাবার ক্লেশ পুনরায় ফিরে পেতে ইচ্ছে করে
তাই হাওয়ায় প্রতিহত পাতার মতন শূন্যে কিছুক্ষণ
স্থির থেকে, ক্রমে পরিণত শিহরণে
আমিও নেমেছি ধীরে, শান্ত পুকুরের পাড়ে
তোমাকে সংক্ষেপে জল বলে জানি
ভাবি একদিন পার ক'রে যাবো।
(তৃষ্ণা/পৃঃ-৩০)
মনে হয় জীবনতৃষিত কবি এক অলৌকিক ইচ্ছেসম্পন্ন মানুষ, তিনি জীবনের এক চরম আনন্দকে স্বীকার করতে গিয়ে, পরম যন্ত্রণাকে আবাহন জানিয়েছেন। অর্থাৎ বলার কথা শুধুমাত্র এইটুকুই ছিল, আমি আমার বোধের জগতে যে আনন্দ সম্ভোগ করি, তাকে আমি এতটাই সেই গোলাপফুলটির মতো ভালোবাসি, যে তার কাঁটাকে বাদ দেওয়া সম্ভব হয় না। আর তাই
'যেন
জন্মাবার ক্লেশ পুনরায় ফিরে পেতে ইচ্ছে করে'...
মণিশংকরের কবিতায় চিরবিরহ, মাথুরের গান শুনি, আমরা জানি, বিরহের বেদনার মধ্যেই প্রেমের অসীম ব্যাপ্তি। যত দূর,
তত মধুর।
'সংগমবিরহবিকল্পে বরমিহ বিরহো না সংগমস্তস্যাঃ।
সঙ্গে সৈব তথৈকা ত্রিভুবনমপি তন্ময়ং বিরহে।।'
আমাদের জীবনে, যা কিছু প্রয়োজন, আমরা পেতে সচেষ্ট হই সাধারণভাবে। যাকে সেভাবে যায় না পাওয়া, তার হাওয়া গায়ে লাগলে আমাদের আরও কিছু দিতে হয়, চাওয়ার অতিরিক্ত এক মনঃসংযোগ, আরতি।
'যদি এ-রকম কোনোদিন তুমি
ভোরে এসে দাঁড়িয়ে 'রয়েছো দরজায়
আর আমি ঘুম -- একটি মাছের ধারণাতে
যে রকম বিদ্ধ হ'য়ে থাকে মানুষ, জলের প্রান্তে--
প্রচণ্ড ধ্যানের মতো সমাহিত ছিপ, যদি কেঁপে ওঠে
ভাসমান সোলা, খণ্ডঈশ্বরের ছোঁয়া লেগে...'
(দশক/পৃঃ-৩১)
আসলে যাব ভাবলেই যাওয়া শুরু হয়। মানুষ যখন প্রার্থিত কিছুর প্রতি নিবিষ্টচিত্ত হয়ে পড়ে, তখন, প্রিয়বস্তু লাভ করার আগেই সে তার ভাবনার পৃথিবীতে তাকে পেয়ে বসে।
কবি তাঁর আত্মরক্ষার প্রয়োজনেই বস্তুত নির্জন জন। নিজের সুকুমার সত্তাকে অন্তরালে তাই তিনি লালন করেন। মণিশংকরের কবিতায় বিষাদ-বেদনার কোনও অস্পষ্টতা নেই।
শেলী অনুভব করেছিলেন--
"Our
sweetest songs are those that tell of saddest thought."
মণিশংকর লিখছেন--
'এই বৃষ্টিদিন তোমাকে চেনে
তুমি পাখির আকাশ, বৃষ্টির আগে, জলে ভরা...
তোমাকে অপূর্ব লাগে
আর এই কষ্ট সহ্য হবার নয়।'
(যাত্রাবাড়ি-৪/পৃঃ-২৫)
মৃত্যু আমাদের শ্রেষ্ঠ ও চিরন্তন সম্বন্ধ জীবনের সঙ্গে। যা অকস্মাৎ নেই হয়ে গেল, ইন্দ্রিয়ের সীমায় আর যাকে ধরা গেল না, তা শোকের তো বটেই, বিস্ময়েরও সর্বপ্রথমে। মৃত্যুকে অস্বীকার করা কিমবা গৌরবান্বিত করা, এই দুই রকম ভাবনায় জারিত অনেক কবিতাই আমরা পড়েছি। মণিশংকর বলছেন--
'শাদা মেঘের মতো ফাঁকা করতল
জানি অদূরেই তুমি আছ।'
(শ্মশান/পৃঃ-১৭)
এ কিন্তু মৃত্যুপরবর্তী আত্মার অস্তিত্ব ইত্যাদি আশার কথা নয়, একরকম অনুভবে দৃঢ় হতে চাওয়া, যা যায়, তাকে অস্বীকার করা।
আরেকটি কবিতায় দেখি মৃত্যুকে personify করা, সম্বোধন করা...
'তুমি ঘন নীল অথবা সোনালী
অলৌকিকতা
এখনো শুয়ে আছো
ধাবমান কার্তুজের খোলে
পাখির ঝাঁকের প্রতি--
একটি পাখির টানে...'
('মরণ রে, তুঁহু মম'/পৃঃ-৪১)
যা অমোঘ, ধ্রুব, মনে হল কবি যেন তার বাণীমূর্তিতে তারই অনিবার্য চেহারাটি এঁকেছেন।
কয়েকটি শব্দ উল্লেখ করি কবিসৃষ্টঃ 'চার্চদিনে', 'শুদ্রফুল', 'বৃক্ষনর'...
কবিতাগুলির উপমা অসামান্য, বিশিষ্ট, তাদের সম্বন্ধে কোনও কথাই বলা যায় না, শুধু পড়া ব্যতীত--
'একদিন তোমাকেও নিয়ে যাবো সেইখানে
বালকের হাতে ধরা লাটাইয়ের মতো তাৎক্ষণিকতায়।'
(হাসি-মুখ বুদ্ধ/পৃঃ-৩৮)
বা,
'অল্প অল্প বৃষ্টি হচ্ছে, সরলাবালা বালিকা বিদ্যালয়ের মতো।'
(নক্ষত্র/পৃঃ-৪৩)
আসলেই বইটি পাঠকালে বারবার এই-ই মনে হয়, এ' এক ছবির বই, কবিতার ভাষায়। যা প্রথম পাঠে মনে হয়, ঠিক যেন তা-ই নয়, আরও কিছু আছে। কবিতার দ্বিতীয় ভুবন। তাই পুনঃপুনঃ পাঠ লাগে কবিতাগুলির অন্তরে প্রবিষ্ট হতে।
যা প্রায় রাজনৈতিক চিত্রকল্প, অথবা নিছক শব্দে, তা শব্দাতীত হয়ে ওঠে, কয়েকটি উদাহরণ রাখি--
'আমার নির্জনে বাঁশি বেজে ওঠে পুনর্বার।
এখন চাঁদের নীচে খুব খোলামেলা ছোটনাগপুর
দূরে বুদ্ধের মন্দির, শ্বেতলিলি সমিতির ইস্তাহার।'
(শিকল-১/পৃঃ-১৬)
রোম্যান্টিক কবিতার পরিচিত, সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমূহ থেকে দূরে গিয়ে বারবার মণিশংকরের কবিতায় এসেছে ভিন্নমাত্রিক ছবি।
'দীর্ঘ বাতাসের নীচে ছোট ছোট ফুল ফুটে আছে
যেন তোমার মুখের 'পরে আলো...
আমি এইসব গেঁথে নিতে চাই।
অস্থি-বিশারদ যে রকম একটি হাড়ের থেকে
পূর্ণ কঙ্কালের বিবরণ পেশ করে।'
(সূত্র-২ সংখ্যক কবিতা/পৃঃ-১৫)
শেষ দুটি লাইন অনিবার্য কাঁপিয়ে দেয়, আবার পড়তে হয় পুরো কবিতাটি।
'এখানে তোমার কথা বলে না কেউ।
বনের ভিতর গ্রীষ্ম-ছাউনির খুঁটি
সংঘর্ষময় বুনোফুল চেপে ধরে আপ্রাণ;
অখিল গুপ্ত সমিতির কেউ একজন মনে হয় নিজেকে।
পশুর জল খাবার শব্দে কিছুদূর উড়ে একটি চিল
আবার স্থির হয়ে বসে, ঝুঁকে পড়া গাছের ডালে'
(তোমাকে/পৃঃ-১)
প্রথম পংক্তির এই নম্র আত্মসমর্পণ বা ঘোষণা যা-ই বলুন না কেন, তার মারাত্মক অভিঘাতে বিমূঢ় করে রাখে।
যে জায়গায় কবি আছেন, তা নির্জন। কীভাবে নির্জন? 'এখানে তোমার কথা বলে না কেউ'... তিনি একা, যেরকম একা একটি খুঁটি, গ্রীষ্ম-ছাউনির, প্রখর দাবদাহে। যেখানে প্রার্থিতের নাম উচ্চারণ করে না কেউ।
'অখিল
গুপ্ত সমিতির কেউ একজন মনে হয় নিজেকে'-- যেরকম গোষ্ঠীর কথা আমরা জানি, যাদের প্রধান কাজ ছিল কেবলই, ক্রমাগত স্থানবদল করা, আরও আরও নির্জনাভিমুখে। পরের লাইনেই দেখা যাচ্ছে ভীত চিল, পশুর জল খাবার শব্দে উড়ে গিয়ে ফের কিছুদূরে বসেছে। মণিশংকর কতখানি মেধাবী কবি, তার স্বাক্ষর প্রতিটি কবিতা জানে। কিন্তু আরামের কথা প্রাণের কাছে এই, মেধার প্রখর চ্ছটায় আমাদের চোখ অন্ধ হয় না। বরং এক শান্তি ধীরে ধীরে আপনাকে রম্য বেদনা ও আনন্দের কষ্টের কাছে নিয়ে যাবে, হে প্রিয় পাঠক।
কমলার ত্বক ফেটে যে রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ে শীতদ্বিপ্রহরে, মণিশংকর বিশ্বাসের 'চন্দনপিঁড়ি' সেইভাবে আলোময় একা। যা পড়ে এই প্রতীতি জন্মে, একদিন আবারও নদী হবে, ঝরণা হবেই। শ্বাসকষ্টের কাছে ঝরে যাবেনাকো জারবেরা ফুল। আরকী!
কবির বিশ্বে যাওয়া যাক... যে বিশ্বে দেখলাম, বলা থেমে যাবার পর আসল কথা শুরু হয়, আর সেই বিশ্বের পথ সম্ভবত মণিশংকর স্বয়ং এঁকে দিতে পারেন--
'
ফসলের অন্তে সোনার খনির মতো চাঁদ
আর এই পথ চলে গেছে
কাঠবাদাম জঙ্গল পার করে
টিলার উপরে, নীল...
তুমি জানো এইসব পৌঁছানো
তোমার কাছে... '
(শাশ্বতী/পৃঃ-৩)
এই বইটির কবিতাগুলি ছোটো ছোটো ঢিল নয়, শান্ত মনে আলোড়ন ফেলে মিলিয়ে যাবার নয়, চরম নির্জনতায় আত্মার সঙ্গে স্বগত কথোপকথনে ত্রস্ত, ব্যথিত, মূক হয়ে উঠবেন কবিতাপায়ী যে কোনও পাঠক-ই।
মনোলোভা সাজবিহীন, আড়ম্বরহীন, নম্র, সততই আপনার সঙ্গে আপনার দেখা করিয়ে দেয়।
কবিতা লিখবার জন্য যে আত্মমগ্নতা সাধনের, অতি উৎসবের হতশ্রী কাঙখা হতে দূরে থাকবার, চমকে দেওয়ার প্রবণতা থেকে হাত গুটিয়ে রাখবার বিষয়গুলি অভ্যাস করতে হয়, মণিশংকর বিশ্বাস তাতে সিদ্ধ হয়েছেন।
এই কাব্যগ্রন্থটি আরও আগ্রাসী পাঠকের হাতে পড়ুক, এই প্রার্থনায়, নিজেকে অযোগ্য জেনেও, বইটি পড়তে বসে যা ভেবেছি, ভেবে চলেছি, তা-ই ভাগ করে নিলাম মাত্র।
অলমিতি।
বইটা পড়ার লোভ জেগে গেল
ReplyDeleteরিভিউ টা খুবই যত্ন করে লেখা। মর্মে গভীর উপলিব্ধি বেশ আকর্ষণ করলো আমাকে।
ReplyDeleteবইটা পছন্দের। আর আলোচনা দুর্দান্ত হয়েছে। গড়পড়তা রিভিউ নয়।
ReplyDeleteকবিতাবইটি পড়তে ইচ্ছে করছে। পর্যালোচনাটিতে যত্নচিহ্ন স্পষ্ট। জীবনানন্দ যেন অন্যভাবে খানিক, এইমতো লাগছে। রম্য বেদনার প্রতি আমার নিজের ভালোবাসা আছে।
ReplyDelete