Sunday, April 14, 2019

লুপ্তপ্রায় ইতিহাসের যত্নবান সংরক্ষণ - সর্বজিৎ সরকার







নদীটি ফল্গু। জল নিচে বয়। ওপরে বালির চরা। কোথাও যদি জল দেখাও যায়, সেও বেশিরভাগ সোঁতা, ঢেউ নেই, প্রবাহ কম। তবু জলের টান বালির গভীরে। তেমন নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল জনপদ। তার চারপাশে প্রকৃতি আদিম। মাটি লাল ল্যাটেরাইট। প্রায় অনুর্বর। বৃষ্টি মুহূর্তবন্দী। হয় কী হয় না। কখনো হয় যদি, তবু, এ অঞ্চলে বেশিভাগ ঋতুই রৌদ্রজ্বলা, ক্ষর। গ্রীষ্মে প্রখর। শীতে নির্মম। মানচিত্র মোতাবেক এই অঞ্চলের নাম ছোটনাগপুর মালভূমি তার একদিকে বাংলা, অন্য দুই দিকে, ঝাড়খণ্ড আর ওড়িসা একদিকে ঘন অরণ্য। অন্যদিকে রুক্ষ মালভূমি। মাঝখান দিয়ে যে নদী বয়ে গেছে তার জলের ভাষায় এ জায়গার কঠোর, নির্মম জীবন যাপনের ব্যথা আর বেদনা লুকিয়ে থাকে, ভাষা পায়না। সে ফল্গু। সুপ্ত নদী। প্রকাশে তার বেদনা কোন সুরে জাগবে সে যেন নিজেও জানেনা।

তিন রাজ্যের সীমানায় বাঁধা হলেও তার জনবসতির মধ্যে কোথায় যেন এক আশ্চর্য সুরসঙ্গতি আছে। কেমন একটা মিল। যেন সে একই সুরে, একই প্রকৃতিতে বাঁচে। প্রকৃতি তার আবহের মাঝে ডেকে নেয় সেইসব মানুষদের। তার নিজের সুপ্ত সুর তখন তাদের ভাষায়, তাদের কথায়, তাদের কণ্ঠে গান হয়ে ওঠে। তাদের পুরুষদের কণ্ঠে নয়। সে অঞ্চলের মেয়েদের কণ্ঠে। মেয়েদের যে মায়া বেশি। সেখানকার পুরুষেরা দিনভর প্রতিকূলতা আর রূঢ়তার সাথে যুদ্ধ করতে করতে নিজেরাও যেন তেমনি রুক্ষ আর রূঢ়। কিন্তু মেয়েরা, তাদের যে মন কাঁদে। ব্যথা পেলে, আঘাতে আর অপমানে, বঞ্চনা আর একাকীত্বে, তারা কোথায় প্রকাশ করবে নিজেকে? তখন তারা গান বাঁধে। সে গান মেয়ের নিজের বেদনা আর নদী প্রকৃতির লুকিয়ে রাখা বেদনাকে কিভাবে যেন এক সুরে বেঁধে দেয়।
আর এমনিভাবেই জন্ম নেয় ‘কাঁদনাগীত’

গবেষক নিজে কবি হলে, এবং সত্যিকার অনুভবী ও মরমী কবি হলে, একটি গবেষণা গ্রন্থ কোন উচ্চতায় যেতে পারে এই বইটি তার প্রমাণ।

বেবী সাউ আমার নিজের অত্যন্ত প্রিয় কবি, কিন্তু সেটা এক্ষেত্রে কথা নয়। যেটা গুরুত্বপূর্ণ যে এই বইটি পড়তে গিয়ে বারবার অনুভব করেছি যে বিষয়ের প্রতি কী অপরিসীম ভালোবাসা আর আন্তরিকতা থাকলে তবে এমন একটা বই লেখা যায়।

এ ভাষা আমাদের শহুরে মানুষের কাছে অপরিচিত। লিখিত ভাষাও এ নয়। শুধু এই জনপদের মানুষের মুখের কথায় ছড়িয়ে আছে তার দৈনন্দিন লোকজীবনের আখ্যান। সে ভাষায় তার চারপাশের যে অনুষঙ্গ, দৈনন্দিনের চিত্রপট, প্রকৃতির কথা মিলেমিশে যায়। খুব সহজ আর খুব গভীর এক চেপে রাখা কান্না হঠাৎ কি করে যেন গান হয়ে উঠে আসে তাদের গলায়। সেই গান কেমন? দু একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

“উঠিলা সুয়ারি বসিলা নাই, মাগো
নদী পারাইবাকে দিশিলা নাই মাগো
কত যে আদর করথিল তুমি মাগো
ভাগ্যে মোর কী আছে না জানি মাগো”
বিয়ের পর শ্বশুরালয়ে যাওয়ার আগের আশঙ্কা, ভয়, আর মনখারাপ, সব একসাথে উঠে আসছে এই কাঁদনাগীতে। তেমনি করেই শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতিত হওয়ার জন্যে যে চেপে রাখা কান্না তাও বেরিয়ে আসছে অন্য গানে।

“তলার সাগরে দুধ পতরি মাগো
সে ঘরে জা যে মোহন পুরী মাগো
কথা কহি দিবে করাত ছুরি মাগো
করাত কাটনে দারু খসবে মাগো
পদে পদে কথা তনু খসবে মাগো
পতি উপরে পিয়াজ সাঁই মাগো
সে ঘরে জীবন রাখিমু নাই মাগো
পর্বত উপরে চাকি পাথর মাগো
তোর মাথা বাঁধা মোর খাতর মাগো”

মুখে মুখে বানানো একটা গান অথচ তারই মধ্যে এতগুলো ভিন্ন অনুভব ধরা পড়েছে এই গানে যা আমাকে বিস্মিত করে। শ্বশুরবাড়িতে জা এর সাথে ইর্ষাকাতর সম্পর্ক, স্বামীর উদাসীন অবহেলা ( পিয়াজ সাঁই – এই শব্দবন্ধটির অসাধারণ প্রয়োগ আমাদের শিক্ষিত কল্পনায় আসা অসম্ভব ছিল মনে হয়), এবং শেষ করার আগে মায়ের প্রতি যে মমতা প্রকাশ পায় এই কথায় যে, আমার জন্যেই আজ তোর মাথা বন্ধক দেওয়া, এককথায় অসাধারণ অভিব্যক্তি।

এ বইয়ের ভূমিকায় বেবী এক জায়গায় লিখছেন, কি ভাবে আর কেন কাঁদনাগীত সম্পর্কে তাঁর কৌতূহল জেগেছিল। জন্মসূত্রে এই ঐতিহ্যের সাথে তার আত্মীয়তা আজন্ম। ঠাকুমার কাছে শোনা উপকথা, রূপকথা আর পুরাণের গল্প শুনে। তাঁর ভাষায়, “ ঠাকুমা কারও মৃত্যুর খবর শুনে গুনগুন করে কাঁদতেন। তুলে আনতেন মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে তাঁর যাবতীয় অনুভব। প্রতিটা কথা স্পষ্ট বোঝা যেত না তখন; কিন্তু সুরটা ছিল করুণ। বুঝতে পারতাম কান্নাও আসলে সুরে মোড়া”

আড়ালে রাখা কান্না আর বিলাপ কে, লুকিয়ে রাখা ক্ষোভ আর বেদনা কে এমন গানের ভাষায় প্রকাশ করা যে সম্ভব শুধু সেটা শেখার জন্যেই কবি ও গবেষক বেবী সাউ এর এই বইটির কাছে আমাদের বারবার ফিরে আসতে হবে।

কাঁদনাগীত- সংগ্রহ ও ইতিবৃত্ত
বেবী সাউ
প্রকাশক-- সৃষ্টিসুখ
প্রচ্ছদ-- পার্থপ্রতীম দাস
২৯৯টাকা 




No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমা...

পছন্দের ক্রম