Tuesday, April 9, 2019

আজ চিল উড়ে যায়- শতানীক রায়





কবিতা পড়ার সময় এরকম অনুভূতি হয়নি যতটা মাঝরাতে ঘুম ভেঙে অনুভব করলাম। অত্রি ভট্টাচার্যর "পরবপর্ব" কাব্যগ্রন্থটি ওঁর প্রথম কবিতার বই। এক ফর্মার পুস্তিকা। কী করে যে বলি! ভাষা তৈরির ঠিক মুহূর্তটুকু যেন এই বই। এবং স্তিমিত আবেগ। প্রবাহ তা আছে যার ভেতর থেকে গিয়ে কবিতার কাছে যাওয়ার চেষ্টা। প্রথম কবিতা 'ষোড়শজনপদ' অনেকটা শরীরী উজাগর অর্থাৎ ভাষা নির্মিত হচ্ছে এমন এক মুহূর্তে দুপুর নেই। এমনটাই স্বাভাবিক। 'তলানি' শব্দটা এসেছে পায়েশের পাত্রের তলানি থেকে। খাবারের উচ্ছ্বাস এবং মানুষের শরীরের ইঙ্গিতময় জারণ 'অক্লেশনূপুর'। কবিতার স্বতঃস্ফূর্ততা এখানেই। 'ছেলেবেলাটিকে মুড়িয়ে গোল ক'রি' এখানেই স্মৃতি থেকে উঠে আসা ব্যথা মেশানো ইঙ্গিত যার ভেতর সুখ যেমনটা আছে তেমনই নিপুণ দুর্ভোগ। 
       স্মৃতিরোমন্থন বারবার মহৎ সাহিত্যে ঘুরে ফিরে আসে। উৎপলকুমার বসুর একটি সাক্ষাৎকারেও একবার স্মৃতির প্রসঙ্গ এসেছিল। তখন তিনি গোটা দিন যা যা করছেন বা যা দেখছেন কবিতায় তা কোনোভাবে চলে আসার কথা বলেছিলেন। আমার নিজের একটা কথা খুব মনে হয় যে, সমস্ত কিছুর মধ্যে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা কবিকে নানান আকৃতি এবং বোধের মধ্য দিয়ে নিয়ে গিয়ে ফিরিয়ে আনে নিজের কাছাকাছি সেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কবিতাকে তৈরি করে নেয় অভিঘাত অথবা চলন যার উৎসটিই হল কবি কীভাবে বেঁচে আছেন, তার একটি পরোক্ষ প্রভাব তার কবিতায়। 'সায়ংপ্রবাসে' দ্বিতীয় কবিতার দ্বিতীয় লাইন: 'মাঝে মাঝে উল্টে যাচ্ছি নিজেকে-- বিশেষ সম্বন্ধ ও শিয়রবিলাপ'। 'উল্টে যাচ্ছি' যেন স্বাভাবিক কিছু ঘটছে না অস্বাভাবিকভাবে কবিতা গড়ে উঠছে। সাহিত্যের উপাদান তৈরি হওয়া উচিত অস্বাভাবিক কোনো চেতনা থেকে। যখন আমরা নিজের অস্বিত্বকে চরমভাবে কোণঠাসা বোধ করব আর ঠিক সেই সময় কবিতার গড়ে ওঠার ভাষা অনিবার্যভাবে ভাঙা অর্থে বিপরীত চিহ্ন বহন করবে সময়ের। 'বারবার চেতনায় বসে মরাল ধ'রি'...'বলার ভঙ্গিমা পাল্টাচ্ছে কিন্তু মুখ বদলাচ্ছে না।' এই বোধ তৈরিই হয় অভ্যাস থেকে, নিয়মিত একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে বেঁচে থেকে কোনো এক নির্দিষ্ট লক্ষের দিকে নিজেকে ঠেলে দেওয়া একটি ক্রিয়াও মাত্র। অত্রি ভট্টাচার্য্যের কবিতা ঠিক যেভাবে আমাকে মুখ দেখাতে চায় আমি তার অপর দিকে বসে তার অংশীদার হতে হতে হারিয়ে যাই। পাখি শব্দে যখন শূন্যতা আসে তখন 'ডানাসমেত' আসে। 'আমার বিমূর্তি' সিগনিফাই করে পরিবর্তনের প্রতিফলন। যার মধ্যে দাঁড়িয়ে একান্তই চূড়ান্তভাবে নিজের মূর্তিকে বিপন্ন এবং একা মনে হয়। 
          একটা সময় প্রুস্ত পড়তে পড়তে বুঝেছিলাম 'transvertebration' কী জিনিস। এই যে আমার তাৎক্ষণিক চেতনাকে তরল করে সমস্ত চারপাশে মিশিয়ে প্রত্যেক বস্তুর মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়া। এও এক মহৎ সাহিত্যের গুণ। 'পরবপর্ব-৩' কবিতার শেষ কয়েকটি পঙক্তি একটু পড়া যাক: 'আমির মুখ মিশছে দেওয়ালে।/ টুপির মুখ মিশছে দেওয়ালে।/ দেওয়াল মিশছে আমায়।/ আমি ফল ও আদর খুলে বসলেন।/ এবার আমি খাবেন। আমরা দেখব।' 'আমি'-কে যেভাবে পৃথক করে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে তা একটি উত্তরণের পথও বলা যেতে পারে। 'গোখরোর ঝাঁপি' এ বইয়ের উৎকৃষ্ট কবিতা। ডিসকোর্সের যে অভিঘাত থেকে কবিতাটি লেখা তা পড়লে বোঝা যায়। 'ক্ষ'-এর প্রয়োগ এখানে ভাষা দর্শন, চিত্রকল্প, অক্ষরের নন্দনতত্ত্ব গভীর ক্ষতকে সৃজনশীল করে তুলছে। ক্ষ-তে প্যাঁচ আছে তা তাৎক্ষণিকভাবে এলেও তার রূপান্তরিত অর্থ পুরো কবিতাটার সঙ্গে সংযোগ বজায় রেখেই কথা বলে চলে। এমনি বইটা ভালো লেগেছে তবে বানান এবং কিছু ব্যাকরণগত ট্রুটি ছাড়া বাকি সব ঠিক আছে। প্রচ্ছদে কবির নামের বানান আর টাইটেল পেজে যে বানানে কোনো অসামঞ্জস্য আছে। প্রচ্ছদ আরেকটু নান্দনিক হলে ভালো হতো। 

পরবপর্ব
অত্রি ভট্টাচার্য
নান্দীমুখ প্রকাশনী
মূল্য: ৩০ টাকা
প্রচ্ছদ: সাগরিকা বিশ্বাস

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমা...

পছন্দের ক্রম