Thursday, April 11, 2019

পাঠকের চোখ দিয়ে : এলা বসু







কবি রুদ্রশংকর এই সময়ের একজন সাহসী ও সৎ কবি যিনি অবলীলায় নিজের জীবন, উপলব্ধি ও দর্শন কবিতায় উন্মোচিত  করেন নির্দ্বিধায়  .....সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ তাঁর লেখনীতে যেমন জীবনের নানান  গল্প ফুটে  ওঠে অক্লেশে তেমনই নাগরিক  জীবনের নানান দিক ফুটিয়ে  তোলেন  সহজাত দক্ষতায় , নাগরিক জীবনের কোলাহল  পেরিয়ে  তাঁর কবিতার হাত ধরে অনায়াসে পৌঁছে যাই জীবনের বিভিন্ন আনাচে  কানাচে  যেসব  জায়গায় আমরা না চাইতেও পৌঁছে যাই  আবার ছুঁতে চেয়েও ছুঁতে পারি না সবটুকু  .....সমাজ , প্রেম , যৌনতা ও ধর্ম সম্পর্কে তাঁর নিজস্ব ধারণা ও বিশ্বাস খুব স্পষ্ট ও বলিষ্ঠ ....কবিতায় তাঁর এই নির্ভীকতা এই সময়ের নর নারী কে স্পর্শ করতে বাধ্য ....

কয়েকদিন আগে আমার প্রিয় লেখক শীর্ষেন্দু বলেছিলেন  একটি অনুষ্ঠানে যে জীবনকথা  আলাদা  করে লেখার দরকার পড়েনা  কারণ লেখকের  নিজের লেখাতেই তাঁর জীবন উঠে আসে ...কবিদের ক্ষেত্রেও  তা সত্য ...আমরা কবিতার সাথে সাথে বহুলাংশে কবিকেও পাঠ করি ....সুদূর  আটলান্টা  নিবাসী  বিজ্ঞানী তথা  কবি  রুদ্রশংকর এর কবিতার মধ্যে  তাঁর শৈশব , সংগ্রাম , প্রেম , যৌনতা , বিচ্ছেদ , অপূর্ণতা সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত স্বাধীন জীবনের ঘ্রাণ পাওয়া যায় পরতে পরতে ..."  প্রেম থেকে উঠে আসে ইতিহাসের অল্প  বয়েসী  ঠোঁট / এইভাবে  বহু জল ঘেঁটে  , বহু ঠোঁট ঘুরে /  সমস্ত ভূগোলে আমাদের প্রেমিক -  জন্ম হয় " কখনো সে প্রেম স্নিগ্ধ  শান্ত .."পাগলা করা প্রেম লিখেছি, পাগলা করা যৌনতা /  পাতা  উড়ছে  মাথার   পর , যেমন তোমার মৌনতা  /  কবির হাতের স্পর্শ মেখে  কোথায় যাবে তোর্সা নদী ?/  তোমার জন্য তোলা আছে মায়ের দেওয়া বেনারসী"  অথবা  চাঁদের আলোয় নেমে আসে এক প্রেমের  অনন্য অনুভূতি "  ওই চোখে যুদ্ধ প্রলয়  /  ওই চোখে ডুবছে  সাগর  /  ভেসে আর কোথায় যাব ? /  যদি থাকি তোমার ভেতর ! /  তাহলে জড়িয়ে একমাথা  চাঁদের আলোয় /  আমাদের মৃত্যুগুলো /  থেকে যাক জন্মমুঠোয়  !  "  জীবন , প্রেম , কবিতা কখনো একে  ওপরের  থেকে বিচ্ছিন্ন  হয়নি , তাই তাঁর কামনা "  তিল  তিল করে বয়স বেড়েছে ভাতে  /  বলা যায়না , কখন কী বলে লোক ! /  আমাদের খুশি জেগে থাক দিনরাতে /  সব প্রেম থেকে প্রেমের কবিতা হোক "  না চাইতেও যেমন আমরা প্রেমের অমোঘ আকর্ষণে  কোনো অনিশ্চিত  রাস্তায়  ঝুঁকে পড়ি, সেই চেতনা থেকে উঠে আসে  "  কয়েকবার  তোমার ইতস্তত আকর্ষণ  ছেড়ে ফিরে যাব ভেবেছি /  অথচ নিজের নির্জন ঠিকানায় /  কিঞ্চিৎ  ভালোবাসা এখনো অবশিষ্ট  আছে বলে /  এক ভয়াবহ  চৈতন্যের  অসুখ  প্রতিবার  তোমার কাছে ফেরায়  " কবিরা আবার লুকাতে  চাইলেও  যে সবসময় পেরে  ওঠেন , তাও তো নয় , "  লুকোতে  জানি না , তাই ধরা পড়ি অসংখ্য প্রতীকে /  ভালোবেসে যেখানেই  থাকি ;  দিনরাত  বৃষ্টি হয় বুকে " আবার বিচ্ছেদের বিষন্নতা  যখন সমস্ত সত্তা কাঁপিয়ে দিয়ে যায় , কবি লিখে ফেলেন  "  হাইওয়েতে তখন পুরোনো হাড়পোড়া সকালের অন্ধকার /  তার দু এক ছত্র লিখলে  কলম থেকে উড়ে যায় স্নায়ু  /  আজ যত ইচ্ছে মানুষের কাছে আসি /  যত ইচ্ছে চামড়ার  রং বদলে  যায় /  আমি সেই থেকে প্রেমে  পড়া আলসে  বোকা মানুষ /  প্রতি সন্ধ্যায় অজানা  কোনো স্টেশনে  থামি  /  মন খারাপে আরো এক মৃত্যু আসে অন্য জন্মের  কাছে "  আবার অবসরে তিনি অন্ধকারে নিমজ্জিত  হয়ে লিখে ফেলেন "  এসো অন্ধকার , আবিষ্কার  করি অফুরন্ত  উল্লাসের  সফর  /  ঠিক পাগলের  মতো দেদার  খরচ করি তোমাকে " আবার নারী ও পুরুষের স্বভাবের অন্ধকার দিকটিও দৃপ্ত ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলেন ..." কিন্তু সেই অরুণিমা রায়, 
যার কাছে অসংখ্য অবশ হৃৎপিণ্ড জমা ছিল 
তাকে কি লক্ষী বলা যায়?
মা বলেছিল "লক্ষী চঞ্চলা"
লক্ষী শুধু চঞ্চলা নয়, ব্যাধির মতো হিংসাও ছিল তার "
অথবা 
" যত ক্ষয়, তত তাণ্ডব লিখি প্রতিদিন
ছিন্নমস্তার মতো রক্ত খাই
র্ত খেয়ে চলি
সঙ্গে চে হাজার বছরের বয়স্ক হঠকািতা
ঠিক যতখানি হঠকারী হলে 
নিজেকে পুরুষ বলা যায় !"

নিজের মতন কে ঈশ্বরকে নিয়োঙ্গাগড়া করেছেন তাঁর েতনার রঙে 

"বহুকাল ধরে বহু ঈশ্বরের জন্ম দেখেছি আমি
মানুষের গাঢ় বিচ্ছিন্নতায়
বহু ঈশ্বরের মৃত্যুও দেখেছি সমানে ...
......
আমার জন্মের পরে যেমন এসেছিল
আমার মৃত্যুর পরে তেমনই নিশ্চিহ্ন ঈশ্বর "

কবি পারেন এক ঝাঁক উপেক্ষাকে অতল আনন্দে পান করতে 
" আমি কারোর প্রতিপক্ষ নই, হতেও চাইনা কখনো 
অতল আনন্দে এক ঝাঁক উপেক্ষা ও দূরত্ব পান করি শুধু 
এই আমার উড়ুক্কু মন, এই আমার নির্জনতা জানে
ভালবাসলে যে পতন হয় তার কোনও সীমা নেই
যে পোড়ায়, সেও একান্তে সবুজ তরঙ্গ নিয়ে পোড়ে। "

পরিশেষে বলি যে গ্রামের ছেলেটির তীব্র শিখর ছোঁয়ার আকাঙ্ক্ষা তাকে তাঁর বিজ্ঞানের গবেষণায় ৫ টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার এনে দিয়েছে, তিনি কিন্তু নিজেকে বেঁধে রেখেছেন শিকড়ে শিকড়ে সেই মাটির সজল মায়ায় 
" গ্রামের নাম আনন্দপুর, বাড়ির নাম খুশির ডিঙ্গা
সেখানেই তিমিরকান্তির তিন পুরুষের আধছেঁড়া সংসার
জাতে কায়স্থ , ভাতে গরিব ,
মাঝেমধ্যে খাবার জোটে,
মাঝেমধ্যে মহাশূন্যে উড়ে যায় দিন-রাতের জ্বলন্ত খিদে "

এই বইটি সব ধরণের পাঠকেরই মনোরঞ্জন করবে , তাই অবশ্যই সংগ্রহে রাখার মতন l কিছু কবিতা এমন ছন্দময় যাতে আবৃত্তির রসদ ও মেলে l এককথায় বলা যায় বইটিতে জীবন ও সমাজের নানান দিক উন্মোচিত হয়েছে কবির স্পষ্ট , সাহসী ও দৃপ্ত উচ্চারণে অথচ সহজ ভাষায় এবং সাবলীল প্রকাশভঙ্গিতে l

কাব্যগ্রন্থ  :  বাদামি  সবুজ  অক্ষরগুলো কবি -  রুদ্রশংকর  , পত্রভারতী প্রকাশনা মূল্য  -  ১৫০ / 

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমা...

পছন্দের ক্রম