Tuesday, April 9, 2019

‘কী পড়ব কত পড়ব’- রণজিৎ অধিকারী







এই বইমেলায় হল কী, রবিবার তখনও ভিড় জমে ওঠেনি তেমন, রোদের তেজ আছে বেশ , আমি অনুষ্টুপের স্টলে দাঁড়িয়েই পড়ে ফেললাম চাবুকের মতো একটি নিবন্ধ-“কী পড়ব কত পড়ব রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে বস্তুবাদ, চার্বাকদর্শন, লোকায়ত দর্শন নিয়ে লিখে চলেছেন আর আমাদের মতো  স্থবির অপরিচ্ছন্ন চিন্তার মানুষদের কামারেরঘা দিয়েই যাচ্ছেন কিন্তু হায় আমাদের অন্যমনস্কতা! তাকে ঠিকভাবে পড়ে উঠতে পারিনি এখনো অনুষ্টুপ থেকে প্রকাশিত তাঁরই  নির্বাচিত নিবন্ধ’-এর প্রথম নিবন্ধেই আমাদের ভাবতে বললেন, আমরা কত পড়ব তর্ক করার প্রয়োজনে পল্লবগ্রাহীর মতো হাতের সামনে যা পাব তাই পড়ব? নাকি কোনো নির্দিষ্ট বিষয়েই গভীর মনোযোগ দেব?
 লেখক লিখেছেন-“…যেকোনো জিজ্ঞাসুকেই একটা দার্শনিক অবস্থান ঠিক করতে হয়
বহুগ্রাহিতা বা এক্লেক্টিসিজম নিয়ে যায় পল্লবগ্রাহিতা বা অগভীর জ্ঞানের দিকে কোনো বিষয়ই ভালো করে জানা হয়না
তাঁর চাঁচাছোলা ভাষায় এই ধরনের বেশ কিছু নিবন্ধ নিয়েই এই সংকলন
এখানেকবিতা বোঝা আর ভালো লাগানিবন্ধটিতে রবীন্দ্রনাথের অর্থ না বুঝে সংস্কৃত কুমারসম্ভব ভালো লাগার প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন যেখানে কবি নিজেই বলেছেন, শ্লোকটির অর্থ বোঝার পর আর তত ভালো লাগেনি তাহলে প্রাবন্ধিকের প্রশ্ন –“পুরোপুরি না-বুঝেও এক ধরণের ভালো লাগার ব্যাপার নিশ্চয়ই ঘটে অল্প বয়সে তো বটেই, মাতৃভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় কবিতা পড়তে গিয়ে সব বয়সেই এমন হয় সে আনন্দ ফেলনা নয় প্রশ্ন হলো: কবিতার ক্ষেত্রে তেমন আনন্দই কি শেষ কথা?” এমন মেধাবী যুক্তির ওপরে নির্ভর করে লেখা বইটির প্রতিটি প্রবন্ধ। বইটি আমার এক উজ্জ্বল সংগ্রহ।

মার্কসবাদী চিন্তা ও দর্শন নিয়ে সারা পৃথিবীতে চর্চা চলছে। পক্ষে বিপক্ষে, পক্ষের আবার নানা শ্রেণি। বিশ শতকেই ইউরোপে মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিকদের মধ্যে লড়াই আমাদের অজানা নয়। শিবনারায়ণ রায়ের প্রবন্ধে তা অল্পস্বল্প জেনেছি। এই বিষয়ে বিস্তৃতভাবে বলবার যোগ্য লেখক শোভনলাল দত্তগুপ্ত।
তাঁরমার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তাবইটির প্রথম সংস্করণ হয় ১৯৮৪ সালে এবার পরিবর্ধিত চতুর্থ সংস্করণের চতুর্থ মুদ্রণ প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ আমাদের মতো  সাধারণ পাঠক এই বইতে সহজেই জেনে নিতে পারবেন, ইউটোপীয় সমাজচিন্তার ইতিহাসটি এমনই স্বাদু ও সুপাঠ্য লেখকের গদ্য যে, মার্কসীয় জটিল চিন্তাগুলিও অনুধাবন করতে অসুবিধে হয়না তার সঙ্গে পাঠকের বাড়তি পাওনা হিসেবে যোগ হয়েছেমাও সে তুং-এর রাষ্ট্রচিন্তাএবং পরিশিষ্টে মার্কসবাদী ধারাগুলির মধ্যে পারস্পরিক বিরোধের কথা সোভিয়েতপন্থী তাত্ত্বিকদের সঙ্গে ইতালির কমিউনিস্ট তাত্ত্বিক আনতোনিও গ্রামসি, হাঙ্গেরীয় তাত্ত্বিক গেয়র্গ লুকাচ কিংবা ফ্রাঙ্কফুর্ট গোষ্ঠীর বিরোধ কোথায় তা সংক্ষেপে জেনে নেওয়ার জন্য শোভনলালবাবুর  এই বইটি অবশ্যপাঠ্য

মোরিৎস ভিনটারনিৎস  (জন্ম ২৩ ডিসেম্বর ১৮৬৩, মৃত্যু ৯ জানুয়ারি ১৯৩৭) জন্মসূত্রে জার্মান, জার্মান ভাষায় লেখা তিনখণ্ডে ভারতীর সাহিত্যের ইতিহাস তাঁর এক অমর কাজ
তিনি ১৯২২-২৩ সালে শান্তিনিকেতনে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেছেন তিনি ভারতবন্ধু ছিলেন এবং গান্ধি ও রবীন্দ্রনাথ দুজনের সঙ্গেই হৃদয়ের যোগ ছিল গান্ধি নিয়ে জার্মান ভাষায় লেখা তাঁর মূল্যবান পাঁচটি প্রবন্ধের অনুবাদ নিয়ে এই বইমেলায় এম. সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রকাশ করেছেগান্ধী পরিক্রমার দ্বিতীয় সংস্করণ অনুবাদ করেছেন জার্মান ভাষাবিদ দেবব্রত চক্রবর্তী আশ্চর্যের বিষয় ভিনটারনিৎস গান্ধির সম্পূর্ণ জীবন দেখার সুযোগ পাননি অথচ তাঁর সঠিক মূল্যায়ন করে গেছেন তিনিমহাত্মা গান্ধীপ্রবন্ধে বলেছেন, --”কিন্তু রাজনীতিতে গান্ধীজীর সমস্ত রকম ভুল ভ্রান্তি সত্ত্বেও তাঁর নিঃসংশয় সাফল্য এইখানেই নিহিত যে একমাত্র তিনিই তাঁর দেশবাসীর মধ্যে আত্মিক ও নৈতিক শক্তি জাগিয়ে তুলতে পেরেছিলেন, অন্য আর কেউ যা পারেননিএই অসাধারণ গ্রন্থটি পড়তে পাওয়ার জন্য প্রকাশক ও অনুবাদককে ধন্যবাদ জানাই

আমার মতো সংশয়বাদীও ঈশ্বরে বিশ্বাসী ধার্মিক দার্শনিক অরিন্দম চক্রবর্তীর যেকোনো বই পড়বার জন্য মুখিয়ে থাকি কেননা লেখার সময় ইনি তুখোড় যুক্তিবাদী ২০১৫ সালে দেওয়া তাঁরদেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় স্মারক বক্তৃতা “ এই বইমেলায় গ্রন্থাকারে প্রকাশ করল অনুষ্টুপ: শিরোনাম – “দেহ থেকে সন্দেহ”। বক্তৃতার শুরু থেকেই প্রশ্ন ছুঁড়েছেন প্রত্যক্ষৈকবাদী দেহবাদী চার্বাকদের দিকে। চৈতন্য বলে কিছু নেই? আতিথেয়তা? মানবতা? ... মানবিক তো হতেই হবে। প্রত্যক্ষের সঙ্গে এসে মিশবে অনুমান, বিশ্বাস ইত্যাদি। বুদ্ধি চেতনা ইত্যাদির নাগাল পাওয়া প্রত্যক্ষ জ্ঞানের দ্বারা সম্ভব নয়। বক্তৃতার শেষে মনে করিয়ে দিয়েছেন, কবি জীবনানন্দের সেই রোগীর পাশে থাকা কমলালেবুর কথা, সে কোন শুশ্রূষার বার্তা দিচ্ছে আমাদেরকে? সেই প্রসঙ্গে উৎপলকুমার বসুর আরেকটি কবিতা দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন, দেহই সব নয়। প্রত্যক্ষই একমাত্র প্রমান নয়, ইহজাগতিকতাই শেষ কথা নয় –“তোমার যে এই worldliness , এই যে জড়ত্ব, এটা হচ্ছে তুমি যতক্ষণ deterministic laws, physics-এর laws দিয়ে বুঝতে চাইলে , তুমি জড়, তুমি একটা সমষ্টি, একটা জড়পিণ্ড যেগুলো natural laws মেনে চলে কিন্তু তোমার মধ্যে এবং অন্য মানুষের মধ্যে যে ভালোবাসা আছে, যে চেতনা আছে…” এমন এক নিঃসীম জায়গায় দার্শনিক পৌঁছে দেন সেখান থেকে ফেরার পথ পাইনা


বইমেলার পর প্রায় এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম  একটি উপন্যাসযীশু খৃষ্টের একান্ত সুসমাচার
আমার প্রিয় কয়েকজন বিদেশি ঔপন্যাসিকদের মধ্যে অন্যতম হোসে সারামাগো আর বিদেশি উপন্যাস পড়ার  জন্য যাঁদের অনুবাদকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকি -জি এইচ হাবীব, আবীর হাসান -তাঁরা সবাই ওপার বাংলার প্রসঙ্গত জানাই যীশুকে নিয়ে বইটি লেখার জন্য লেখককে দেশান্তরী হতে হয়; কেননা ক্যাথলিকদের ধর্মীয় অনুভূতিতে বইটি আঘাত হেনেছিল আশ্চর্য এই কাহিনির বুননে সারামাগো  দেখাতে চেয়েছেন, যীশুও এক সাধারণ শিশুর মতো মেরীর গর্ভে জন্মেছিলেন উপন্যাসটি দারুণ আকর্ষনীয় হয়ে ওঠে যখন যীশুর সঙ্গে ম্যাগদালেনার সাক্ষাৎ হয় পাঠকের দম বন্ধ হয়ে আসে এমন বর্ণনায়
পায়ের ক্ষত থেকে রক্ত বের হতে থাকলে যীশু আর হাঁটতে না পেরে ম্যাগদালার দরজায় এসে কড়া নাড়ল
সে এক দেহোপজীবিনী কিন্তু সে মায়াবী শুশ্রূষায় সুস্থ করে তুলল যীশুকে সে তার পায়ের পুঁজ বের করে দিল, স্নান করাল যত্নে; -“খুলে দিল তার জোব্বা, নিজেই তাকে স্নান করিয়ে দিতে লাগল, আদর করতে লাগল সারা শরীরে, কোথাও নখ ফুটিয়ে দিতে লাগল, চুমো খেতে লাগল বুকে ও উরুতে …. যীসাস শিউরে শিউরে উঠতে লাগলএইভাবে যীশুর কৌমার্য হরণ করল ম্যাগদালা কী রমণীয় ভঙ্গিতে আর কী সুপাঠ্য গদ্য পড়া শুরু হলে থামা যায়নাএক আশ্চর্য সৃষ্টি
তবে উপন্যাসটি যেভাবে শেষ করেছেন লেখক আর যে ভাষায় --তাতে গোঁড়া ক্যাথলিকদের খেপে যাওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে –“যীসাস মরছে, ধীরে ধীরে, জীবন একটু একটু করে ত্যাগ করছে
সে সময়ে হঠাৎ তার মাথার ওপর স্বর্গ নেমে এল এবং ঈশ্বর আসলেন সেই বেশে -…… যীসাস বুঝল,কি চালাকিটা করা হয়েছে,…… হত্যাকাণ্ডটা পরিকল্পিত এক সাজানো ঘটনা“ ---এতে অবশ্য রসজ্ঞ পাঠকের কোনো আক্ষেপ নেই কেননা পাঠককে গোঁড়া হতে নেই


শিল্পী হিরণ মিত্র একাই যেন একটি গোটা সংস্কৃতিকে ধারণ করে আছেন। চিত্রকলা, নাটক, চলচ্চিত্র, গদ্যসাহিত্য এবং কবিতাও। কোন ক্ষেত্রে না তাঁর সচ্ছল যাতায়াত! আমরা তাঁর একটা ফেলে দেওয়া রেখাতেও বিদ্ধ হতে পারি। এমনই শক্তিশালী তাঁর রঙ ও রেখা; চিত্রপটে আলগোছে পড়ে যাওয়া একটু লালও যে এত যৌনতা এনে দিতে পারে হিরণদার চিত্র না দেখলে টের পেতাম না। আর তাঁর যখন কবিতার বই বেরোয় আমরা হাপিত্যেশ করে বসে থাকি । এবার সপ্তর্ষি প্রকাশন বের করেছে তাঁর প্রথম পূর্ণাঙ্গ কবিতার বই
হিরণ মিত্র সংখ্যা প্রকাশ করার সময় ‘পূর্ব’ও কিছু কবিতা ছেপেছিল মনে পড়ছে।
তাঁর কবিতা যেন চিত্রেরই সমান্তরাল একটা পাঠ। দেখুন কেমন লেখা-

শরীর ছুঁতে/ আঙুল ছুঁতে/ স্তন ছুঁতে/ স্পর্শ তাকিয়ে আছে!

স্তনের মতো/ তাকিয়ে আছে!......
ঘুম ভেঙে স্পর্শ কথা বলাবলি করে”
আহা কী চমৎকার দৃশ্য- স্তনের মতো তাকানো কিংবা স্পর্শের কথা বলাবলি। কখনো কবি লেখেন “দুঃখ জানতো না তার পাশে দুঃখ বসে আছে!”
কিন্তু সপ্তর্ষির বাঁধাই এত খারাপ কেন?

হর্হে লুই বর্হেস। এই লেখকের একটি বাক্যও যেন বাড়তি নয়। শব্দের গোলকধাঁধায় ঘুরিয়ে মারবেন পাঠককে। পাঠক নিরুপায়। এই লেখকের গল্প আমি গত কয়েকবছর ধরে তন্নতন্ন করে পড়েছি, বারবার। মেধাশক্তিকে এভাবে গল্পে চারিয়ে দেওয়া, তাঁকে না পড়লে বিশ্বাস হতনা। উপন্যাস লেখেননি, উপন্যাসের বিরুদ্ধতা করেছেন। তিনি মূলত গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। কিন্তু লেখক নিজে কী বলছেন? –“সর্বপ্রথমে আমি একজন পাঠক, তারপর একজন কবি তারপর একজন গদ্যলেখক।“ কবি
এ’কথাটি জানবার পর আমি খুঁজেই চলেছি তাঁর কবিতার অনুবাদ। পেলাম একটি পুরোনো বই-“পঞ্চাশটি নির্বাচিত কবিতা”; হর্হে লুই বর্হেস, পূর্বা প্রকাশনী। ভাষান্তর করেছেন প্রতিষ্ঠিত অনুবাদক মনোজ চাকলাদার। উপরি পাওনা অক্টাভিও পাজের ভূমিকা, “কালের গোলকধাঁধা”। এ-কদিন এই বইয়ের কবিতাগুলি পড়েই চলেছি, পড়ামাত্র বোধগম্য হবে তাঁর কবিতা তেমন নয়।
জাতির মৃত্যু, বন্দর নগরী, কবরখানা, গিটার বাজিয়ে মিলোঙ্গা গান ইত্যাদি বারবার এসেছে কবিতায়। কিন্তু তিনি জানান, “ একটি গোলাপের উদারতা তোমার সকল মার্বেলকে অতিক্রম করে।“ কবিতা আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে পারে, যখন ‘আমিই’ কবিতাটি পড়ি –“আমার নীরব বন্ধুরা, আমিই একজন/ জানি কেবলমাত্র বিস্মরণের চেয়ে কোথাও কোনো / ক্ষমা বা প্রতিশোধ নেই।“ তিনি আমাদের বলতে চান বুড়ো পশু বিক্রেতার হেঁটে চলার গল্প। তিনি রাতে চলে যেতে দেবেননা একটি নক্ষত্রকেও, এমনকি রাতকেও। গভীর এইসব কবিতা, তাঁর গল্প আমাদের চেতনাকে জ্যান্ত করে রাখে।

লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে অস্ট্রিকের টেবিলে পেলাম নিত্য মালাকারের শেষতম কাব্য “নিমব্রহ্ম সরস্বতী”। কবির জন্ম ১৯৪৭, মৃত্যু আমাদের যাবতীয় অন্যমনস্কতার আড়ালে ২০১৮র ১ আগস্ট। মণীন্দ্র গুপ্ত তাঁর সম্পর্কে লিখেছিলেন,”এই কবি লিখতে গিয়ে মমতাহীন, ছাপতে দেওয়ার আগে কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন এবং বইয়ের ব্যাপারে নির্বাচননিষ্ঠ।“ এই কবির কবিতা এখন আরো মনোযোগ দিয়ে পড়া  উচিত আমাদের
 প্রতিষ্ঠান ও কলকাতা শহর থেকে কয়েকশো কিমি দূরে বসে প্রান্তিক এই কবি লিখে গিয়েছেন অসামান্য কিছু কবিতা। মাত্র ছ’টি কাব্যগ্রন্থ তাঁর। কিন্তু কী সক্ষম এই কবি! “পক্ষীরাজ” কবিতায় লিখেছেন,--
নলিনাক্ষ চিৎপাত
শিথানে তার সংসারের/ পুঁজি-ঝোলা। ঘাসের জাজিম
ছেড়ে এবার সে/ পক্ষীরাজ, শাদা আকাশে সওয়ার।“
পড়তে পড়তে চমকে উঠি তাঁর এই সিদ্ধি দেখে ;”একটি প্রাচীন কবিতা” থেকে উদ্ধৃত করি –“কোনোদিনই আত্মহত্যা সম্ভব নয় আমাদের  আর / আমরা
ত্রিভূজে বা পরস্পর বিপরীত কোণে  সমুৎপন্ন ব্যথা-“
হায় আমাদের অবহেলাকে ধিক! নিত্য মালাকারের কবিতা কেন অনেক আগেই পড়িনি?

কবি বেবী সাউ খুব বেশিদিন লিখছেন না। কিন্তু এখনই কিছু কবিতায় তাঁর কাব্যসিদ্ধি দেখতে পাই। ২০১৮তে প্রকাশ পেল “ছয় মহলা বাড়ি” আর এই বইমেলাতে আদম থেকে নয়নলোভন কাব্যগ্রন্থ “একান্ন শরীরে ভাঙো”। চমৎকার প্রচ্ছদ শোভন পাত্রের। এই কবি আমার এত এত সিরিয়াস গ্রন্থপাঠের মধ্যেও তাঁর কবিতা পড়িয়ে নিতে পেরেছেন, এই তার কবিতার জোর। “জ্যোৎস্না আলোয় ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে শীতল ঘোড়াসমূহ” চমকে দেয় এই পংক্তি। কিংবা যখন লেখেন, --“ উনুনের ধারে উপুড় হয়ে আছে দীর্ঘ শীতকাল”। কীভাবে এমন চিত্রকল্প পান কবিরা? আমরা কেন পাইনা? এই কবির প্রথম দিকের কবিতায় আবেগের প্রাধান্য থাকলেও ধীরে ধীরে আঁটুনি শক্ত হচ্ছে । তার ফল এই বইয়ের কবিতাগুলি। একটি কবিতা তুলে দিই এখানে-
“জ্বরের শরীর এই। ধীরে ধীরে নিভে যাওয়া তুষের আগুন। খোঁচানোর কেউ/
নেই! শুধু হেতালের লাঠি মাঝে মাঝে প্রলাপে, চিৎকার জোড়ো ডিঙি ভেসে/
যায় দূরে। আরো দূরে নীলপথ। ...... শীত বাজে আগুনের অভিমানে। “
বোঝা যায় এই কবি অনেকদূর নিয়ে যাবেন আমাদের। সেইসঙ্গে চারপাশের সাহিত্যজগৎ সম্পর্কে সচেতনতা তাঁর কবিতাকে আরো বেদনশীল ও গ্রানিট পাথরের মতো আঁট করে তুলবে।

কিন্তু বইমেলাতে কেনা আরো যে বইগুলি টেবিলে অপেক্ষমাণ, তাদের অভিমানী দৃষ্টি মাঝেমাঝেই আমাকে বিদ্ধ করে। আমার স্থির বিশ্বাস অপঠিত বই অপেক্ষমাণ নারীর মতোই অভিমানী, যক্ষপ্রিয়ার মতো কাতর। আবার শেষে প্রাবন্ধিক রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের সেই সাবধান বাণীও মনে পড়ে- কত পড়ব! হায় আমাদের কালচিহ্নিত দিনরাতবেষ্টিত জীবন যে বড়ো ক্ষণিক। “জীবন এত ছোট কেনে?” তবুও কালের  দাবিতে ‘আবহমান’-এর দাবিতে আমাদের সাড়া দিতেই হবে।

পঠিত বইগুলিঃ
১। নির্বাচিত নিবন্ধ; রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। অনুষ্টুপ। প্রচ্ছদ-রাতুল চন্দ রায়। মূল্য- ৩০০টাকা।
২। মার্কসীয় রাষ্ট্রচিন্তা; শোভনলাল দত্তগুপ্ত। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুস্তক পর্ষৎ
প্রচ্ছদ-সুব্রত মাজী। মূল্য- ১৫০টাকা।
৩। গান্ধী পরিক্রমা ; মোরিৎস ভিনটারনিৎস। অনুবাদ -দেবব্রত চক্রবর্তী। প্রচ্ছদ- ডি এইচ ফোলৎস(কাঠ খোদাই)। মূল্য- ৭০টাকা।
৪। দেহ থেকে সন্দেহ; অরিন্দম চক্রবর্তী। অনুষ্টুপ। প্রচ্ছদ; রাতুল চন্দ রায়। মূল্য -১৫০ টাকা।
৫। যীশু খৃষ্টের একান্ত সুসমাচার; হোসে সারামাগো। অনুবাদ- আবীর হাসান। বুক ক্লাব , বাংলাদেশ। প্রচ্ছদ-ধ্রুব এষ। মূল্য- ২৯৪টাকা।
৬। ছেঁড়া পাতা; হিরণ মিত্র। সপ্তর্ষি প্রকাশন। প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ- হিরণ মিত্র। মূল্য- ১২৫টাকা।
৭। নির্বাচিত কবিতা; হর্হে লুই বর্হেস। অনুবাদ- মনোজ চাকলাদার। পূর্বা। মূল্য- ৫০টাকা।
৮। নিমব্রহ্ম সরস্বতী; নিত্য মালাকার। অহিরা। প্রচ্ছদ-পার্থপ্রতিম দাস। মূল্য-৫০ টাকা

৯। একান্ন শরীরে ভাঙো; বেবী সাউ। আদম। প্রচ্ছদ- শোভন পাত্র। মূল্য- ১২৫টাকা।

No comments:

Post a Comment

একনজরে

সম্পাদকীয়

সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমা...

পছন্দের ক্রম