সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমালোচনা এবং সমালোচনার সাহিত্য দুটি পৃথক বস্তু বলেই আমার মনে হয়। পাশাপাশি এও মনে হয় জীবনানন্দের সমারূঢ় কবিতার সেই অধ্যাপকের মতো লিখনভঙ্গিমায় শেষ পর্যন্ত না হয় সাহিত্য না হয় সমালোচনা। সমালোচনার সাহিত্য বা সাহিত্যের সমালোচনার কথা দূরস্থান। তাহলে আমরা যেগুলো পড়ি সেগুলো কী? এককথায় শব্দের অপচয় এবং আপাতভাবে প্রাপ্ত জ্ঞানের বিস্ফোটক। দুঃখের বিষয় এই জ্ঞানের বিস্ফোটক এবং রসের অভাবে সমালোচনা সাহিত্য বাংলা থেকে লুপ্তপ্রায়। অনুগ্রহ করে রে রে করে তেড়ে আসবেন না!
এই যে দুটি ক্ষেত্র এলো, সাহিত্যের সমালোচনা এবং সমালোচনার সাহিত্য... এগুলো কী? প্রবন্ধ লিখতে বসেছি যখন তখন উদাহরণ দিয়েই বলা যাক। প্রথমে একটি রূপকে যাই। ধরুন, আপনি আম দেখলেন। হাতে নিলেন। তারপর আপনাকে জিজ্ঞেস করা হলো এই যে আম দেখছেন এটি দেখেই কী আপনার আম গাছ ভেসে এলো মনের মধ্যে? সত্যি কী আম দেখলে আমাদের মনে আম গাছ ভাসে না আম গাছ দেখলে আমাদের মনে আম উদয় হয়? আমার মনে হয় দ্বিতীয়টাই হয়। ম্যাঙ্গো জুস খেতে গেলে কিন্তু আমাদের মনে আমটাই ভাসে আগে। তাহলে আমগাছ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আমাকে তাকে বলা উচিত আমের গাছ। একে বলে সাহিত্যের সমালোচনা, যেখানে সাহিত্যের রসটাই প্রধান। যে সমালোচনায় বিশেষ কোনো সাহিত্যই প্রধান। অর্থাৎ সেই সমালোচনাটি লেখা হচ্ছে সেই বিশেষ লেখা বা লেখকের বিশেষ কোনো বই বা লেখা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। এই ধরনের বেশিরভাগ লেখায় যেটি হয়, তাহলো, কোনো বিশেষ লেখা নিয়ে বিশেষ আলোচনা। সেই লেখাটির ছোট ছোট ক্লিপিংস। এর বেশি কিছু না। সেখানে সমালোচকের মনকে পাওয়া যায় না। একজন বস্নার্ব লেখক বা বিজ্ঞাপনের লেখকের থেকে তার কৃতিত্ব খুব বেশি কিছু না। তিনি যদি মনপ্রাণ দিয়ে লেখকের প্রশংসা করেন, তাহলেও না, যদি লেখককে গালমন্দ করেন, তাহলেও না। কারণ তার সমালোচনা থেকে কোনোকিছু সৃষ্টি হলো না। তার সমালোচনা সমালোচনাই থাকল। এখানে বিতর্কের বিষয়টি হলো-যে সমালোচনা বিশেষ এক লেখকের সৃষ্টিকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরতে পারে, তা-ই আসল সমালোচনা। কারণ সেখানে সমালোচক নিজেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত রেখে লেখকের লেখা নিয়ে আলোচনা করে লেখাটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি পাঠ্য থেকে বেরিয়ে নিজস্ব পাঠ দিয়ে ঢেকে দেননি সাহিত্যকে। অন্য কোনো পাঠ তৈরি হয়নি। খারাপ হোক, ভালো হোক, লেখকের লেখা সম্পর্কেই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু আমার মতে এই ধরনের লেখা ক্ষণস্থায়ী। না আছে এর আগা না আছে গোড়া। না আছে প্রভাব, আছে শুধুই অভাব। কিন্তু কীসের অভাব? লেখক এবং পাঠকের মধ্যে যে যোগাযোগটি তৈরি হয়, তার মধ্যে থাকে লেখকের নিজস্ব অভিযাত্রার মধ্যে পাঠকের অভিযাত্রাও। যে কারণে পাঠকের পাঠ-ও সেই লেখাকে সমৃদ্ধ করে। সমালোচক যখন সেই পাঠকের পাঠকে লেখেন, অর্থাৎ নিজের অভিযাত্রাকে লেখেন, তখন সমালোচনা সেই পাঠককেও সমৃদ্ধ করে। কিন্তু সাহিত্যের সমালোচনায় এই পাঠ গুরুত্ব পায় না, বা কোথাও লুকিয়ে পড়ে।
উল্টো দিকে কোনো একটা লেখা বা কোনো একটা বই পড়ে পাঠকের নিজস্ব পাঠ যদি তাকে দিয়ে লিখেয়ে নেয় নিজস্ব অভিযাত্রার সংলাপ, তাহলে তা হয়ে ওঠে সমালোচনার সাহিত্য। কারণ সেখানে যেমন সেই পাঠ্য-এর পাঠ সেই পাঠকের মনে যে নিজস্ব অভিযাত্রার জন্ম দিল, তার ইতিবৃত্তান্ত। দুয়ে মিলে জন্ম নেয় সমালোচনা, যা সাহিত্য। সেখানে জ্ঞান থাকে না, রস ও জ্ঞানের এক পারস্পরিক ফিউশন থাকে। এ ধরনের লেখায় সেই পাঠ হয়ে ওঠে সময়ের কাছে এক বন্ধুর মতো সহবাসী। সমস্যার কথা হলো এই যে এই ধরনের লেখা এখনো পর্যন্ত আমাদের উপমহাদেশের সাহিত্যের সমালোচনা হিসেবে গণ্য নয়। কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে ইন্টার-টেঙ্চুয়ালিটি এবং পাঠ্য-এর নিজস্ব আত্মীয়করণ-ই কোনো না কোনো বইকে, সৃষ্টিকে আরো নতুন নতুনভাবে আমাদের আবিষ্কার করতে শেখায়। আমাদের জীবনের মধ্যে বই বা সেই সাহিত্যটি ঢুকে যায়। আমাদের অবচেতনে সেই সাহিত্য তৈরি করে এক আবহমানতা।
যে সমালোচনা সাহিত্য এই আবহমানতা তৈরি করতে সক্ষম, সেই সমালোচনা সাহিত্য, সাহিত্যের পক্ষেও প্রয়োজনীয় এবং সমালোচনা নামক বিশেষ বিষয়টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও দরকারি। কারণ ক্রমশ পৃথকভাবে কোনো না কোনো বিশেষ ব্যক্তির কোনো না কোনো সাহিত্য বা শিল্পকে সমালোচনা করার অধিকার ফুরিয়ে আসছে। যেভাবে পাঠ আমাদের কাছে যুগের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনশীল, সেভাবে তার সমালোচনাও পরিবর্তনশীল। তাহলে বিশেষ কোনো এক সময়ে কোনো এক সমালোচকের সমালোচনা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে কেন? সমালোচনা সাহিত্যকে পরিবর্তন কোনো এক জীবিত মাধ্যম না করে রাখলে এই মাধ্যম ক্রমশ আমাদের কাছে ক্ষণস্থায়ী।
সমালোচনার সাহিত্য বা সাহিত্যের সমালোচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার প্রথম জীবনে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে যা লিখেছিলেন, পরবর্তীকালে তা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও সাহিত্যিক তার প্রাচীন সাহিত্যে ইতিহাস থেকে আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে লেখা পর্যন্ত অনেক লেখায় নিজের অনুভূতিমালার বিস্তার ঘটিয়েছেন এমনই মুন্সীয়ানায়, যে সেই সব লেখা হয়ে উঠেছে সমালোচনার সাহিত্য। রবীন্দ্র পরবর্তী সাহিত্যিকদের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী, সৈয়দ মুজতবা আলী, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশ গুপ্ত-এর কথাই মনে আসে এ প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা সাহিত্যের যে প্রাণবন্ত ধারাটি তৈরি করেছিলেন তার সার্থক বাহক আমার মতে বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।
রবীন্দ্রনাথের আলোচনার বিশ্বকে বুদ্ধদেব এগিয়ে নিয়ে গেলেন। রিলকে, হাইনে, বোদল্যের কবিতার অনুবাদের পাশাপাশি যে অনন্য ভূমিকা তিনি লিখতেন তা এক প্রকার সমালোচনা সাহিত্যই। কারণ সেই সব লেখাগুলোকে সেই সব কবিদের তিনি হাতে ধরে চিনিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাদের কবিতাই না, তাদের দর্শনবোধও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার লেখালেখির মাধ্যমে। অথচ বোঝাই যায়, কোথাও তিনি ঐতিহ্যের কাছে অবনত যেমন নন, যেমন নন নিজের পাঠের প্রতি তীব্র বিশ্বস্ত, তেমনই তিনি নিজেকে সেই লেখাগুলোর মধ্যে মিশিয়ে দিতেও কখনো বাধা দেননি। তাই বুদ্ধদেব বসু বাঙালিদের হাতে ধরে আন্তর্জাতিকার আঙ্গিনায় নিয়ে গেলেন। পাশপাশি বুদ্ধদেব বসু ছিলেন বলেও কবিতা পত্রিকার হাত ধরে আমরা পেয়েছিলাম কবি জীবনানন্দ দাশকে। এই অসামান্য কবিকে বুদ্ধদেব বসু ছাড়া বাকি সকলেই আক্রমণ করতেন। কিন্তু বুদ্ধদেব তার সমালোচনায়, তার কবিতা পত্রিকায় বার বার কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে এসেছেন। কোনো শক্তিমান কবিকে কেউ বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতিভাকে। এও সমালোচনা সাহিত্যের এক ইতিবাচক দিক। রবীন্দ্রনাথ তার প্রাচীন সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে যে কাজ শুরু করেছিলেন, বুদ্ধদেব তা-ই এগিয়ে নিয়ে গেলেন মেঘদূত, মহাভারতের কথা গ্রন্থগুলোতে। সমালোচনা যেখানে সাহিত্য, সেখানে বুদ্ধদেব বসু চিরকাল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক ল্যান্ডমার্ক হিসেবেই থাকবেন। জীবনানন্দ দাশ, কবি হিসেবে যদিও, বুদ্ধদেব বসু ছাড়াও যে জীবনানন্দই থাকতেন, সে বিষয়ে আমাদের কারো সন্দেহ নেই। এমনকী, বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে জীবনানন্দ দাশ যে কমফোর্ট জোন পেয়েছিলেন, তা তাঁর আদৌ দরকার ছিল কিনা, সে বিষয়ে অনেক মতপার্থক্য আছে।
বুদ্ধদেব বসু সমালোচনা সাহিত্যে যে উচ্চতা নির্মাণ করে গেলেন অনেকটা তার-ই ওপর কাজ করলেন শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। অবশ্যই বুদ্ধদেবের পথে না। কারণ একটি উচ্চতা এক নির্দিষ্ট পথে অতিক্রম করে তার প্রাথমিক বাধাগুলোকে। কিন্তু সেই উচ্চতাকে এক নির্দিষ্ট পথে অতিক্রম করে তার প্রাথমিক বাধাগুলোকে। কিন্তু সেই উচ্চতাকে অনুবর্তন না করে অন্য পথে স্পর্শ করতে গেলে প্রয়োজন ছিল এমন এক অভিনিবেশের, যা নিজস্ব ভাষায় এক সাহিত্য হয়ে ওঠে। শঙ্খ ঘোষের সমালোচনা সাহিত্যে সেই ঐতিহ্যের বিস্তার রয়েছে। অন্যদিকে অলোকরঞ্জনের রয়েছে একাডেমিক ভাবনার সঙ্গে রসবোধের এক অনন্য ভাষা। শঙ্খ ঘোষ যেখানে কথা বলেন অনেকটা বন্ধুর মতো, সেখানে অলোকরঞ্জন নিয়ে যান এক অনাস্বাদিত পূর্ব প্রত্নের জগতে। এই দুই কবি ও প্রাবন্ধিকের সমালোচনা সাহিত্য তাই আজও বাংলা সাহিত্যের সপ্তসিদ্ধু ও দশদিগন্ত।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কথা এখানে বলা যায়, যিনি সমালোচনা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু তাঁর তাঁর লেখা পড়ে অনেক সময়-ই লেখার গুণাগুণ বিচার করা যায় না। মনে হয় তাঁর লেখা বতাঁর নিজের গদ্যরীতির প্রতি একদেশদর্শী। সাম্প্রতিককালে একমাত্র জয় গোস্বামীর গোষাইবাগান সমালোচনা সাহিত্যে ধারায় এক অভিনব সংযোজন। কারণ তার লক্ষ্য থাকে না শুধু সমালোচনা করার। তার লক্ষ্য থাকে পাঠের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরার। এক্ষেত্রে কবি উৎপলকুমার বসুর কথা বলতেই হবে, বিশেষ করে তিনি যেভাবে একটি বিকল্প পাঠ করতেন এবং সমান্তরাল পাঠটিও সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে দিতেন।
লেখকের যখন মৃত্যু ঘটে যায়, তখন পাঠকের জন্ম হয়। আর পাঠক তাকে লেখেন। সমালোচক হলেন সেই পাঠক যিনি সেই লেখাকে আবার লিখছেন। নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে মিশিয়ে দিচ্ছেন পাঠের মধ্যে। লেখক হারিয়ে যাচ্ছেন না। আসলে তিনি আবিষ্কৃত হচ্ছেন। সমালোচনা সাহিত্যের কাজ এই আবিষ্কার-ই। এক সময় নিশ্চয় আসবে যখন সমালোচনা সাহিত্য এক স্বতন্ত্র সাহিত্য হিসেবেই তার সপ্তসিন্ধু ও দশদিগন্ত উন্মোচন করবে আমাদের কাছে।
তবে, যাই হোক, আসল কথা হল পড়া। তবে, সে কি আর কেউ আলোচনা করার জন্য করে? পড়া একপ্রকার সহবাস। সকলের সঙ্গে তো আর সকলের সহবাস হয় না।
নতুন বছরে সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। বাংলায় সহিষ্ণুতা আসুক। এবং সরাসরি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই ভারতবর্ষ যারা চালাচ্ছে এখন, তাদের দিন অবসান হোক। মুছে দিন ফ্যাসিস্ট ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে। এরা থাকলে কিন্তু আমি আপনি আমাদের ভাবনা কিছুই বাঁচবে না। সঠিক অবস্থান নেওয়া এখন জরুরি।
সম্পাদনা- বেবী সাউ হিন্দোল ভট্টাচার্য সন্দীপন চক্রবর্তী মণিশংকর বিশ্বাস শমীক ঘোষ
যোগাযোগ- abahaman.magazine@gmail.com
সম্পাদনা- বেবী সাউ হিন্দোল ভট্টাচার্য সন্দীপন চক্রবর্তী মণিশংকর বিশ্বাস শমীক ঘোষ
যোগাযোগ- abahaman.magazine@gmail.com