একটা রাস্তার
ধারে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। তখন ঝড় আর সন্ধে সবে আসবে আসবে করছে। হাওয়া দিচ্ছে। আমি
ভাবছিলাম, এই যে বেঁচে থাকা, এর মানে কী? কেনই-বা নিরন্তর নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার
অদম্য স্রোত খোঁজার প্রয়াস? মানুষ কী চায় গোটা একটা জীবনে? ভাবতে ভাবতেই সময় যে
কখন পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। বিকেল নামক একটা ধাঁধাঁ আমাকে ছুঁতে চেয়ে সেই কবে
হারিয়ে গেছে বন্ধুত্বের ওপাশে। কিছু বন্ধু থাকে জীবনে, যারা থেকে যায় আমৃত্যু।
আমার তেমনই দুজন বন্ধুর নাম অনিমিখ পাত্র এবং সঙ্ঘমিত্রা হালদার। হুগলি নদীকে
সীমানা ধরলে অনায়াসে বলা যায়, ওরা থাকে ওধারে। একটা নদীর এক পাশে আমি, অন্য পাশে
ওদের সীমানা। বসবাস। তাও, নদীটাকে সাক্ষী রেখে বাজি ধরা যায় বন্ধুত্বের নামে?
কিন্তু কীসের বাজি? বেঁচে থাকার বাজি। কীভাবে? এখানেই আছে এক চূড়ান্ত মজা। বন্ধু
তো সেইই হয়, যার যাপনে নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। যার লেখায় নিজের বলতে না পারা
অঞ্চলগুলো কথা বলে ওঠে। যা ভাবতে ভাবতে ভাবনা হয়ে উঠেছে মৃত্যু, সেই ছায়াতে দেখি
বৃষ্টির জল পড়ছে। অনিমিখ লিখেছে, “ভাবি যেন কিচ্ছু হয়নি। কিচ্ছু হয়নি ভাবি।/একটি
রঙিন পাখি দৃষ্টিসীমার বাইরে উড়ে যেতে যেতে/ তার ছায়াকে কুড়িয়ে নিয়ে গেছে” আমি
মগ্ন হয়ে যাই। মাটি ভিজছে, ছায়া ভিজছে তার নগ্ন শরীর নিয়ে। এই রঙিন পাখি, এ তবে
কীসের প্রতীক? জীবনের? আর এই উড়ে যাওয়া? মৃত্যু? যখন মৃত্যু আসে, ছায়াটুকুও নিয়ে
যায়। কোথায় যায়? আমরা যারা উড়ে যেতে পারিনি এখনও তারা কী পাই? আমি দেখতে পাই
সঙ্ঘমিত্রা লিখেছে, “আলো-সরীসৃপ কোনও এক উলটো পথে রওনা দিল/ ঘুরে তাকালাম, যতটুকু
আমাকে বিশ্বাস করা যায়/ আমার ফেলে যাওয়া বয়সের ওপ্রান্ত থেকে কালো কালো পিঁপড়ে/
দেখি ম-ম করছে।” আমি বোকার মতো একলা হয়ে যাই এই লাইন পড়ে। বয়সের ওপ্রান্ত থেকে
কালো কালো পিঁপড়ে! এমন এক অদ্ভুত মনকেমন করা দৃশ্যকল্প গুম গুম করে ওঠে মনে। আর এই
যে ‘ম-ম’ করছে, মানে তো ছেয়ে আছে। মনের ভিতর সারিবদ্ধ ভাবে হেসে ওঠে হিংসে আমার।
কেন এলো না এমন দৃশ্যকল্প আমার মাথায়? “ধরে নেওয়া যায় এর ঠিক পক্ষকাল পরে পৃথিবীর
ঈর্ষা পূর্ণ হবে।” সঙ্ঘমিত্রার এই লাইনটা পড়ে দেখি, কবিতার নাম ‘যাহা কিছু ঘটে
আছে’। আমি লক্ষ্য করি, সঙ্ঘমিত্রা লেখেনি ‘ঘটে থাকে’, লিখেছে ‘ঘটে আছে’। মানে
চলমান ঘটনাপ্রবাহ। ঘটেই আছে। যেন ব্রহ্মাণ্ড, ঘটে আছে। যেন মুহূর্ত, ঘটে আছে। অতীত
আসে, বর্তমান আসে, ভবিষ্যত আসে। মুহূর্ত ঘটে আছে। হু হু করে হাওয়া দিচ্ছে সেই
মুহূর্তে। হু হু করে জলের ছাট এসে লাগছে নাকে-মুখে। উড়ছে মাথার ওপর পলিথিনের
ছাউনি। সবজি ঢাকছে ফুটপাথের দোকানী। আমি হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। ফিসফিস করে উচ্চারণ
করি অনিমিখের কবিতার লাইন, “আবহাওয়ার ভেতরে যে হাওয়া, তাতে সারাদিন অন্তর্ঘাত ওড়ে/
সারাদিন পথ বন্ধ। সারাদিন মৃদুমন্দ ক্ষয়/ গরমে ঘামের মতো সারাদিন লেপ্টে থাকে ভয়”
এই যে অনিমিখ লিখেছে, হাওয়ার ভিতরে অন্তর্ঘাত ওড়ে, এই গোপন নিয়ে আমার সারাজীবনের
বসবাস। কিন্তু কে অন্তর্ঘাত করছে আমার সঙ্গে? আমিই তো করছি। একটা আমি আঘাত করছে
আরও একটা আমিকে। ক্ষয় হচ্ছে। রক্ত পড়ছে। আবার শুকিয়েও যাচ্ছে। পরবর্তী কোনও এক
আঘাতের জন্য পুনরায় অপেক্ষা শুরু হয়। অপেক্ষার বয়স বেড়ে বিরক্ত হয়। একটা বয়সের পরে
মানুষ তখন সন্দেহ করতে শুরু করে। চারপাশকে। নিজের আঙুলকে। নিজের শরীরকে। নিজের
একান্ত ব্যক্তিগত সত্তাকেও। “ধন্দ লাগে, কে মাথা দোলাচ্ছে?/ হাওয়া না পাতা, নাকি
সে প্রায় ফুরনো আলো?/ মারের চোটে কোথায় জখম কেমন চোট/ দেখাতে গিয়ে উঁচু গাছও
নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না/ আবেগে তারও থোকা ফুল কেঁপে যাচ্ছে।” সঙ্ঘমিত্রার এই
লেখাটা আমি বারংবার পড়তে থাকি। ভাবি, যেটা ভাবছি সেটাই হয়তো লিখতে চেয়েছে ও। অথবা
অন্য কিছু ভেবেছে। অথবা কিছুই ভাবেনি। লিখে গেছে শুধু। ভাবছি আর মাথা দোলাচ্ছি
আমি। গাছের পাতার মতো। তাহলে মাথাটা নাড়ালো কে? আমার মাথা? নাকি আমার ভাবনা? নাকি
দুজনের যৌথযাপনেই এমন একটি দৃষ্টি রচিত হলো? একজন কবি সেখানেই অন্যদের থেকে আলাদা
হয়ে যান, যখন তিনি এই যৌথযাপনে নিজেকে সঁপে দেন। সঁপে দেন, অথচ মেনে নিতেও
অস্বীকার করেন। তখনই অনিমিখের কথা মতো অন্তর্ঘাত শুরু হয়। আর সেই মারের আঘাতে
চোট-জখম ঘটে আছে। উঁচু গাছ দূর থেকে দেখছে সব। এই উঁচু গাছ কে? অন্তর্ঘাত আর তার
প্রতিঘাতের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকা এই উঁচু গাছ আসলে স্বয়ং রাষ্ট্র। আবেগে তার
প্রতিশ্রুতির ফুল কাঁপছে। এবার আপনি ভাববেন, এখানে রাষ্ট্র কে? দল? সরকার? নাহ।
তারা কেউই নয়। এখানে রাষ্ট্র হলো- আমিবোধ। এই ইগোর এক অলিখিত মানচিত্র থাকে। সেই
মানচিত্রে কেউ ঢুকে পড়লে আর রক্ষে নেই। এমনকি নিজের সচেতন-সত্তাও যদি ঢুকে পড়ে
তাতেও রক্ষে নেই। আমাদের তখন আর কিছু করার থাকে না। নিজেদের খণ্ড খণ্ড সত্তা নিয়ে
তখন হেঁটে যাচ্ছে পথ। আর সেই তার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আমরা বৃষ্টি দেখি। অনিমিখ
লিখেছে, “পথও প্রণাম করে। মানুষের পায়ে পায়ে পড়ে থাকে উপুড়মুদ্রায়/ মানুষ পথের হয়ে
দেখেনি কখনও। আপন গৃহের ঘ্রাণে তাড়াতাড়ি সূর্য নিভিয়েছে/ সে ফিরতিপথের রাজা। কে
তাকে থামায়?” এই অবধি, জাস্ট এই অবধি পড়ে আমি ছিটকে যাই। দেখি, রাস্তার ভিজে যাওয়া
আলো আমার পাঞ্জাবিতে ছিটকে এসেছে। ‘আপন গৃহের ঘ্রাণে’ এই ভাবনার মধ্যে এক নিজেকে
খোঁজার সিগনাল আছে। সারাদিন যা হলুদ আলো জ্বেলে রাখে। এই আপন গৃহ কোথায় থাকে।
অজস্র পর-গৃহের মধ্যে। সেই পরগৃহগুলি আর কিছু না। ওই যে অন্তর্ঘাতের কথা হচ্ছিল,
যার আঘাতে নিজের অনেকগুলো সত্তা, সেগুলোই পরগৃহ, আবার সেগুলো আপনগৃহও। মানে নিজের
প্রতিটা টুকরো আসলে আপন এবং পর। সেইসব টুকরোরা “একবার এদিকে তো আবার ওদিকে/ ঢেউ এর
পরে ঢেউ এসে যায় ঢেউ এর পরে ঢেউ/ মন রে, কী করে আজ রক্ষা করি তোকে!” অনিমিখকে আমি
চিনি ২০০৫ সাল থেকে। দেখতে দেখতে ১৪ বছর পেরিয়ে গেল। দেড় যুগ কম নয়। প্রকাশ্যে
মিতভাষী, বন্ধুত্বের গোপনে রসিক এই কবি কিন্তু শুরু থেকেই নিজেকে নিয়ে খেলে চলেছে।
ওর প্রথম বই ‘যতদূর বৈধ বলি’ এই খেলা শুরু হয়েছে। একবার আলোয় আসে, নিজের কথাকে
হরির লুটের মতো ছুঁড়ে দিয়ে চলে যায়, আবার কখনও অন্ধকার রাজার মতো জেলখানার কোটর
থেকে নিজের সম্ভ্রান্ত হাত দেখায়। পুরোটা ও দেখাতে রাজি নয়। ওর নিজস্ব কিছু সংকেত
আছে। নিজস্ব কাব্যবোধ সেইসব সংকেতে ওঠানামা করে আবহমানের সিঁড়ির মতো। আমি ভাগ্যবান
আমি সেই সিঁড়ি দিয়ে হেঁটে গেছি বহুবার। বলা ভালো, সেই সিঁড়িই আমাকে বহুলাংশে
হাঁটতে শিখিয়েছে। দেখেছি এই সিঁড়ি ঝড়বৃষ্টিতে ভেজে আর রোদে পুড়ে যায়। এই সিঁড়ি
সকাল থেকে সন্ধের হেঁটে যাওয়া দ্যাখে, পৃথিবীর ঘুমিয়ে পড়া দ্যাখে। তবু ঘুমিয়ে পড়া
মানেই আবার কোথাও একটা খুলে যাবে দরজা। হয় বেরিয়ে যাবে কেউ, নয়তো ঢুকে পড়বে
সশব্দে। ঠিক যেমন ২০০৫ সাল নাগাদ বাংলা কবিতার বাজারে ঢুকে পড়েছিল সঙ্ঘমিত্রা।
সশব্দে। প্রথম থেকেই ও নিজস্বতায় ভরপুর। আমি আর ও একইসঙ্গে লিখতে এসেছি। প্রথম আর
দ্বিতীয় বইটাও একই বছরে। সে হোক। এসব স্মৃতির কথা। এমন বৃষ্টির দিনে চলমান সময়কেই
বেশি উপভোগ করতে হয়। মনে পড়ে যায়, সঙ্ঘমিত্রা লিখেছে, “এরকম দিনে তুমি বসুমতি
স্মৃতি খুলে বসো/ বিরল হয়েছে জেনে ভাবো আশ্বত্থ ঠিক জুটে যাবে/ অথবা বট কোনও ছেড়ে
আসা বাঁকে” এই যে গাছের উল্লেখ এই গান হলো জ্ঞান। এই গাছই হলো বোধি। তাই এই গাছের
আরেক নাম আশ্রয়। স্বয়ং ক্লান্তি যেখানে দুদণ্ড বিশ্রাম নেয়। সঙ্ঘমিত্রা লিখেছে,
“লম্বা একটা দৌড় আর অনেকদিনের প্রস্তুতি নিয়ে/ এসেছি এ না-ফেরার জেদে/ সবাই বলছে-
ভালো হয়ে ওঠো” এই যে জায়গাটা সঙ্ঘমিত্রা লিখেছে, কাকে লিখেছে? নিজেকে। নিজেকেই।
অনেকদিনের প্রস্তুতি একজন প্রকৃত কবির থাকেই। হতে পারে সেটা নিজের অজান্তে। হতে
পারে জীবনের বহুমাত্রিকতায় ভেসে যেতে যেতে স্বয়ম্ভূ হয়ে ওঠা। সে যাই হোক, এত কিছুর
পরে ফেরা আর যায় না। আর প্রস্তুতি থাকলে কী হয়? সে তখন লেখে, “বানান করে ভেঙে পড়ছে
আলো, তার শাদা আবহে/ যুক্তাক্ষর ভেঙে পৌঁছে গেছ ফ্রকপরা কেউ/ একবারই ঘুরে তাকালে
যথেষ্ট মনে করে” আমি থম মেরে যাই। এসব কী লিখেছে সঙ্ঘমিত্রা? আবার পড়ি। বানান করে
ভেঙে পড়ল আলো। আবার পড়ি, বানান করে ভেঙে পড়ল আলো। এর মানে কী? বানান তো ব্যাকরণ
থেকেই এসেছে। ব্যাকরণ এসেছে নিয়ম থেকে। নিয়ম কোথা থেকে এসেছে? সমাজ থেকে। তো সেই
সমাজ থেকে উঠে আসা বানানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভেঙে পড়ল আলো। আলো এখানে আশা। আলো
এখানে ভালো থাকা। আর এই যুক্তাক্ষর সেটা কী? একটা বর্ণের সঙ্গে আরেকটা বর্ণের
মিলন। যেন মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। সেটি ভেঙে গেছে ফ্রকপরা মেয়েটির। মানে
তার অল্পবয়স। অর্থাৎ অল্প বয়সেই সে সম্পর্ক ভেঙে যেতে দেখেছে। তাই একবার ফিরে
তাকানোই তার কাছে যথেষ্ট। তাই তো ফিরে না যাওয়ার জেদ। এবার দুটো মেলানো যাচ্ছে?
মিলে যেতে দেখলে নিজেকে হালকা লাগে, তাই না? আমারও তাই লাগছে। প্রতিটা ভাবনা আমার
মাথার মধ্যে খেলে বেড়াচ্ছে এখন। রাস্তার ধারে বৃষ্টি পড়ছে। তাই প্রতিটা ভাবনা
বৃষ্টিতে ভিজছে এখন। আমাদের বেঁচে থাকা, আমাদের কবিতা লেখা, আমাদের মনখারাপ,
আমাদের অনিশ্চয়তার ভয় সব মিলেমিশে যায়। আমি বাড়ি ফেরার পথে হাঁটতে শুরু করি।
বৃষ্টির তেজ কমে এসেছে। সন্ধে নেমেছে। রাস্তার আলোয় আমাদের ছায়া লম্বা হচ্ছে।
আলো দেখার নেশা। অনিমিখ পাত্র। ধানসিড়ি। ৯৫ রুপি
একা এক উহ্য মুদ্রা। সঙ্ঘমিত্রা হালদার। সিগনেট প্রেস। ১০০
টাকা
No comments:
Post a Comment