‘সিস্কেপের কম্পোজিশন বজায় রেখে মাস্তুলের ডগায় চাঁদ উঠল’
‘অক্ষয় মালবেরি’ ছিল তাঁর না সুখী, না দুঃখী, ফেলা আসা একাকী জীবনের সংকলন। যেখানে
প্রতিটা দুঃখের এবং বয়সের আলাদা আলাদা রূপ। আর জীবনের শেষপ্রান্তে অসম্ভব শারীরিক
কষ্ট নিয়ে রোগশয্যায় লেখা তাঁর শেষ উপন্যাস নেংটি কি তাহলে অন্য একটা প্যারালাল
জীবনের কথা? যে জীবনের শুরু ‘সেই বাঁশবনের এপারে, সন্ধ্যায়, বাংলাদেশে,...’। যার
সময়কাল ১৯২৪ সালের একুশে নভেম্বর যখন বুয়েনস এয়ার্সে বসে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ
‘বেণুবনছায়াঘন সন্ধ্যা’-র ছবি আঁকছেন কবিতায়। বাংলার গ্রামদেশে অজস্র শিশুরা হয়ত
একলা চিত হয়ে শুয়ে হাত পা ছুঁড়ছে, সেইরকমই কোথাও মণীন্দ্র গুপ্ত পাঠককে খুঁজে নিতে
বলেন উপন্যাসের নাম চরিত্র নেংটি মোহনদাসকে।
‘ইহজগৎও স্থির পরজগৎও স্থির, মাঝখানে শুধু আমিই কাঁপি’। ‘অক্ষয় মালবেরি’-র
স্রষ্টা ‘নেংটি’ উপন্যাসে একথাই বলে গেছেন। সন্ধেবেলাকার সূর্যকিরণের চাপা গন্ধ
অথবা বন্যপ্রাণীদের মতো কান্না অথবা সিস্কেপের কম্পোজিশন বজায় রেখে মাস্তুলের ডগায়
ওঠা চাঁদ। যেন বানজারাদের মতো যত্নহীন শৈশবজীবন থেকে নারকেল তেলের গন্ধমাখা মাংসল
স্নেহস্পর্শ। আবারও পরিত্যক্তবোধ কিন্তু এ বোধে ‘অক্ষয় মালবেরি’-র মতো কোনও অসহায়
ক্রোধ নেই। ‘অক্ষয় মালবেরি’ ছিল ‘দশদিক অসীম শূন্য এবং চিররহস্য’ জগতের ওপর নেমে
আসা শান্তি। মণীন্দ্র গুপ্ত সেই শান্তিকে বলেছেন ‘সময়ের শান্তি, ক্ষয়ের শান্তি’। তাই
অক্ষয় মালবেরি গাছের তলায় ঘুরতে ঘুরতে আমরা পেয়ে যাই সেই কিশোরী ও যুবতী মেয়েদের।
যারা ‘খুব চ্যাপ্টা করে মস্ত খোঁপা বেঁধে তাতে গোছা গোছা ঝুমকো ঝোলানো কাঁটা গুঁজে
বিকেলে সাজ করত, পাছাপেড়ে শাড়ি আর ভারী ভারী গোট মল অনন্ত পরে ঝমর ঝমর করে এ ঘর ও
ঘর করত, বিনাবাতাসে হেলেদুলে খালের ঘাটে এসে পোষা হাঁসেদের ডাকত- চৈ চৈ চৈ চৈ!’
কিন্তু ‘নেংটি’ ছিল তাঁর জীবনের শেষপ্রান্তে একেবারে মৃত্যুর মুখে লেখা। তাই
হয়ত এখানে অসম্পূর্ণ যা কিছু সবই রূপকথা। আর এই রূপকথার গায়ে কখনও এসে পড়েছে
অসংখ্য ‘অসংলগ্ন বালি’। কখনও ‘শিশির ফোঁটায় ফোঁটায়, দুব্বো ঘাসে ঘাসে, সাদা মেঘে
মেঘে পা ফেলে শরৎ ঋতু।’
একটা পালতোলা রাজকীয় জাহাজে চড়ে নেংটিমোহনের যাত্রা, অবসর পাওয়া কাপ্তেন
আলফ্রেড গোমেজ থেকে রাণি এলিজাবেথ, নেংটিমোহনের সঙ্গী দোয়েলপাখি, স্বাধীনভিখিরি
জীবনের প্রতি আস্থাশীল দাদু, মমতাময়ী কামিনীমা, তাঁর নিজের মৃত মা ঠাকুমা এবং এই
নিত্য মায়া আসক্তির সাথে অনিত্য প্রাণশক্তির বাইরের জগতের দ্বন্দ্ব যেন ভ্রাম্যমান
সর্বত্রগামী এক নিশ্চিত যাত্রা। এই যাত্রা পাঠকের হাত ধরে নিয়ে যায় এক চলন্ত
জাহাজের ডেকে। দূরগামী নয় সেই জাহাজ। যেন স্থির হয়ে রয়েছে। যেন সমুদ্রপথ নয় খুব
চেনা নদীটির দিকেই তার অভিমুখ।
একটু একটু করে সেই চেনা অভিমুখে এগোতে এগোতে সে চিনিয়ে দিয়ে যায় জল স্থল
অন্তরীক্ষ সর্বত্র অসংখ্য প্রাণের উপস্থিতি। ‘কোটি কোটি বছর ধরে যে যেখানে একটু
জায়গা করে নিতে পেরেছে সে সেখানেই মাটি আঁকড়ে বেঁচে আছে। বেঁচে আছে আনন্দে আর কষ্টে,
কিন্তু কদাপি দুঃখে না।’
‘দূরপরিত্যক্ত যৌবনের গন্ধ’, ‘দিগ্বলয়ে জলোচ্ছ্বাস’, ‘কুমারী পলাদের রক্তিম
অশান্তি’ ‘সমুদ্র সৈকতের পথে হেঁটে যাওয়া রাজদম্পতি ও তাঁদের ভিখারিভোজনের আয়োজন
এসবই যেন শোঁ শোঁ ঝুপঝুপ শব্দে গড়িয়ে আসা ঢেউ। ‘...ঢেউ আসে গড়াতে গড়াতে- সৈকতে যতদূর
পারে এসে বালিতে মিলিয়ে যায়, তারা হাওয়ায় শোঁ শোঁ শব্দ তোলে। আরেক রকম ঢেউ দোতলা
তিনতলা বাড়ির দেয়ালের মতো খাড়া এগিয়ে এসে জলেই ঝুপ করে ভেঙে পড়ে, সেখানেই যা-কিছু
ছিল সব নিয়ে মহাসমুদ্রে আবার ফিরে যায়। এইরকম মাসের পর মাস, বৎসরের পর বৎসর, যুগের
পর যুগ।’ আর আসা ও ফিরে যাওয়ার মধ্যে আনন্দের বদলে হয়ত অনেকটা কান্না মিশে থাকে।
‘অক্ষয় মালবেরি’-র ঝরে পড়া রাশি রাশি পাতার স্তূপে ‘পরিত্যক্ত থাকার কষ্ট এবং
অসহায় ক্রোধ’ বদলে যায় জ্যোৎস্নায় ও ঘুমে ঝিমঝিম সমুদ্র যাত্রায় ‘নেংটি’-র সন্ধ্যা
নদীর কাছে ফেলে আসা গৌরগ্রামের শৈশবে ফিরে যাওয়ায়। যে ফিরে যাওয়ায় হয়ত একটা নশ্বর
জীবনের অন্তিমের কথাই বলা আছে। যা তিনি হয়ত উপলব্ধি করে চলেছেন লেখার সময়। তাই
চেনা পরিচিত রাণী এলিজাবেথের মতোই আদর যত্নে
ও ভালবাসায় ঘিরে রাখা অতি প্রিয়জনকে ছেড়ে যাওয়ার দুঃখ ও দীর্ঘশ্বাস শুনতে
পায় পাঠক মন।
No comments:
Post a Comment