আগের সংখ্যাগুলি

Thursday, April 11, 2019

আলফোনসো কুয়ারোন আর অদ্রীশ বিশ্বাসের সাদাকালো গল্পের প্লট- শ্রীজাতা গুপ্ত





লীলাবতী' প্রবাহমানের অনুষঙ্গে প্রকাশিত স্থিরতার গল্প অথবা, নিশ্চলতার মুখোমুখি ভেসে ওঠা গতি 'লীলাবতী' উপন্যাস পড়াকালীন বারবার ঢুকে পড়েছি আলফোনসো কুয়ারোনের সাদাকালো 'রোমা'-জগতে নির্মেঘ আকাশের নীচে থমকে থাকা ক্লেওর গতানুগতিক দিন, জাগতিক অশান্তির মধ্যে চরম নির্লিপ্তিতে গাছের মত ধ্যানমগ্ন হওয়ার অনুশীলন- এইসবের বিপরীতে কুয়ারোন উড়িয়েছেন ধাতব বিমান ব্যাকগ্রাউন্ডে  যার চলে যাওয়াটুকুই আটকে পড়া মানুষগুলোর করুণ আয়রনি৷  শ্বাসরুদ্ধ ক্যামেরা প্যান করে অবিচলিত ড্রয়িং রুম, তার মধ্যেই দেখেছি আমি, মেহিকোর ক্লেওর পাশে ছায়ার মত ঘুরে বেরিয়েছে মাহেশের লীলাবতী তার উঠোনের সামনে দিয়ে চলে গেছে যে গ্র্যান্ডট্রাঙ্ক রোড, যার নিজস্ব কোনও চলাচল নেই, তবু, অভিমানের দিনে সেই পথই লীলাবতীকে পৌঁছিয়ে দেবে অদ্ভূত ইয়ুটোপিয়ায় এই সমীকরণে ক্লেও আর লীলাবতীর নিঃসঙ্গ উচ্চারণে আমার মনে এক হয়ে যায় আলফোনসো কুয়ারোন আর অদ্রীশ বিশ্বাসের সাদাকালো গল্পের প্লট

'লীলাবতী' লীলাবতীর গল্প দেশ হারানো একটি মেয়ের নতুন দেশে এসে নিজেকে খোঁজার গল্প এই উপন্যাসের সমস্ত চরিত্র অকল্পিত, সমস্ত ঘটনা বাস্তব অদ্রীশ বিশ্বাসের উপর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের প্রভাব অজানা নয় এই উপন্যাসেও মাঝেমধ্যে ঝিলিক দিয়ে যায় সন্দীপনীয় গদ্যরীতি বাস্তবের চরিত্রদের সঙ্গে 'লীলাবতী' চরিত্রদের নাম থাকে অপরিবর্তিত  যেমন ছিল সন্দীপনের 'জঙ্গলের দিনরাত্রি' উপন্যাসে হঠাৎ দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর, সময়ের ক্রোনোলজি না মেনে প্রসঙ্গান্তর, এইসব সাদৃশ্য অন্বেষণ হয়ত পাঠক মনের প্যাটার্ন খুঁজতে চাওয়ার ত্রুটি তবে, অদ্রীশের উপন্যাস নারী-এম্পাওয়ারমেন্টের সাবলীল দলিল যদিও এমন বাক্য চলে আসেই, যে, নিজের মনের মত করে মধুসূদন গড়ে নেবে লীলাবতীকে, বাস্তবে দেখি লীলাবতী নিজেই গড়ে তুলছে নিজেকে বইয়ের জগৎ অথবা রাজনীতি, ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা অপশানের মধ্যে থেকে লীলাবতী বেছে নিচ্ছে তার নিজস্বতা এই তার আত্মানুসন্ধান এইখানেই সন্দীপনের থেকে অদ্রীশের প্রস্থান

'লীলাবতী' অসমাপ্ত গল্প টানটান সাংবাদিকসুলভ বিবরণ বয়ে চলে সমগ্র উপন্যাসে৷ এক এক বাক্যে অনেক তথ্য, তাদের বিস্তারে মন নেই লেখকের এই ধারাবিবরনী থেকে বেরিয়ে আর একটু তলিয়ে শুনতে ইচ্ছা হয় একটু একটু করে কী ভাবে বানানো হল লীলাবতী-মধুসূদনের বাড়ি? তাদের কথোপকথনের গভীরতা ধরতে চেয়েও কেন ধরা হলনা সম্পূর্ণ? যে একেরপরএক চাকরির দরখাস্ত করছিল লীলাবতী, তার কী হল? নকশাল বড় ছেলের উপর অত্যাচার, যা চন্দ্রাহত করল লীলাবতীকে, সেই সময়ের বিবরণ কেবল এক ছাদ থেকে অন্য ছাদ হয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতই অসময়ে মিলিয়ে যায় তাই, ডকুমেন্টারির মত চিলতে ঘটনাবলীর সাক্ষী হয়ে লীলাবতী ফিচারের পূর্ণতা থেকে বঞ্চিত রাখল পাঠককে যা নেই, তা বুঝে নেওয়ার কিছু দায় তবে পাঠকের?

'লীলাবতী' চিৎকারের গল্প উপন্যাসের শেষে এক অভিনব খেলা শুরু হয় যা সবচেয়ে অস্থির করে তোলে আমায় দীর্ঘ সাড়ে এগারো পাতা ধরে একটি- বাক্য বারবার লেখা হয়, যার ফন্ট সাইজ ক্রমবর্ধমান যার অভিঘাত লীলাবতীর জীবনের পরবর্তী  স্বরহীন অধ্যায় এই সাত পাতা জুড়ে একটি ভিস্যুয়াল মাধ্যমকে অদ্রীশ করে তোলেন অসম্ভব অডিও-ভিস্যুয়াল  একটি বাক্য থেকে অন্যটিতে উত্তরণে অসহ্য হয়ে ওঠে লীলাবতীর আর্তনাদ৷ শব্দের অনুপস্থতিতে এমন কান ঝালাপালা করা চিৎকার ছাপার অক্ষরে আমার পড়া এই প্রথম একবার ক্লাসে পড়াতে পড়াতে অদ্রীশ তাঁর ছাত্রীকে বলেছিলেন, "ঋতুপর্ণ- 'উৎসব' ছবিটা মনে কর্ পুরো ছবিটায় একটাও আউটডোর শট নেই, তবু আউটডোর রচনা হয়েচে কেবল আবহ সঙ্গীতে যা নেই, তাকে দেখানোর ব্যবস্থা করা যায় নানান উপায়ে" এইভাবেই, লীলাবতীর নকশীকাঁথার ফোঁড়ে ফুটে ওঠে পাবনার গ্রামবাংলার ছবি, যার কোনও সরাসরি উল্লেখ থাকে না লেখায় এইভাবেই, 'লীলাবতী' পাঠ আমার কাছে হয়ে ওঠে চূড়ান্ত ব্যক্তিগত

'লীলাবতী' আইডেনটিটির গল্প দেশ মাটি হারিয়ে ফেলার চেয়েও ভয়ঙ্কর নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলা যার তাড়নায় সযত্নে বর্ডার পার হয়ে আসে পূর্ববঙ্গের আম-আঁটি উঠোন বদল হয়,  শেকড়ের লোভে লোভে লিলাবতীর  আমগাছ বেড়ে ওঠে পশ্চিমের মাটিতে পাতায়, মুকুলে একে একে বিকশিত হয় লীলাবতীর অতীত, গাছের মত স্থিরতায় এগিয়ে চলে ইতিহাস ডালপালায় ভর করে একই সঙ্গে দোল খায় লীলাবতীর ভবিষ্যৎ একটি লাইব্রেরির মৃত্যুদিনে, অথবা, পরিচিত জনের অপরিচিত আচরণের আকস্মিকতায় নিজস্বতা হারয়ে ফেলার অভিঘাত অসহনীয়৷ কথা বলতে জানলেও, হঠাৎ নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার গল্প লীলাবতীর যেমন, সাঁতার না জেনেও সমুদ্রে ঝাঁপ দেওয়ার গল্প একান্তই ক্লেওর

উপন্যাস: লীলাবতী
লেখক: অদ্রীশ বিশ্বাস
প্রথম মুদ্রণ: বর্ণনা প্রকাশনী, ২০১৭
দ্বিতীয় মুদ্রণ: ৯ঋকাল বুকস, ২০১৯

2 comments:

  1. অসংখ্য ধন্যবাদ আবহমানকে এই রিভিউটি ছাপাবার জন্য। আমার কাছে লীলাবতীর এই রিভিউটি খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটি কারনে, প্রথমটি হল শ্রীজাতা যিনি ইএম রিভিউয়ের লেখির অদ্রীশের অন্যতম প্রিয় ছাত্রী আর দ্বিতীয়টি হল অদ্রীশ চেয়েছিল মেয়েরা লীলাবতী নিয়ে লিখুক, চচা করুক অনেক বন্ধুরা পড়েছে কিন্তু লেখেন নি, যেটি আবাহমান করতে পারল। লেখার দাপটেই বইয়ের রিভিউ হলেও এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমরা সকলে চাই তুমিও আবহমানে লেখ।
      আমি তো চাই-ই।
      সেই কবেকার কথা......সব মনে পড়ে...

      Delete