একেকটা বই থাকে, পড়ার
আগেই পড়া হয়ে যায়। মানে বিষয়ের ভালোবাসায়, পড়ার আগেই কেমন
যেন ভেসে ওঠে বইটি। "মুক্ত নিকারাগুয়া" তেমন এক বই। যেন, আমার আরণ্যক। যা প্রথম হারাতে শিখিয়েছিল। বলেছিল, কোথায় আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা! জাগিয়েছিল, রক্তে বিপ্লব। বলেছিল, চুপি চুপি কানে কানে,
বেরোও। বেরিয়ে পড়ো।
রাসেল বলেছিলেন, ২৫
অব্দি পড়াশোনা শেষ করে বেরিয়ে পড়তে। মুক্ত নিকারাগুয়া সে কথাই বলেছিল কানে কানে।
তাই কলেজে পড়তে এ বই খুজে পেয়েছিলাম রামকৃষ্ণ মিশন লাইব্রেরিতে। সে কথা লেখক কবীর
সুমনকে জানিয়েও ছিলাম। সেটা ছিল ১০ বছর আগে। তখন নন্দীগ্রাম সিঙ্গুর। উত্তাল
বাংলা। কবীর আমাদের আত্মার প্রতিনিধি। বিবেক। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড। আর,
সেই স্বপ্নের নায়ককেই আমি খুজে পেলাম লাইব্রেরিতে। খুজে পেলাম,
মুক্ত নিকারাগুয়ায়।
বিপ্লব নিয়ে আর ৫ জন বাঙালির মত আমার
রোমান্টিসিজম কম ছিল না! এ বই তাই চাগিয়ে দিয়েছে আরো। নিকারাগুয়ার মাইন বিছানো
রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন সুমন! স্বয়ং পিট সিগার তাকে চিঠি লিখে অনুমতির ব্যবস্থা
করে দিয়েছেন! ওদিকে আর্নেস্তো কার্দেনাল সুমনকে আতিথেয়তার ব্যবস্থা করেছেন। সবটা, এই
সবটা শুনতে শুনতে কেমন আচ্ছন্ন হয়ে আসত মন! ইচ্ছে হত, এমন
এক সাংবাদিক হতে। হারিয়ে যেতে। চিরকালের মত। আর না ফিরে আসতে ঘরে! কোনোদিন..
কবীর সুমন আজ কাল্ট। বরাবরই জীবন ও
শিল্পকে আড়ভাবুকের মত প্রশ্ন করে যাওয়া, নেগেশান অফ নেগেশানে
বিশ্বাসী তিনি। আজও। কিন্তু লেখক সুমন? তার গদ্য নিয়ে
কতটা কথা হয়েছে? আজ এই ডিজিটাল উত্তর আধুনিক সময়, যখন লেট ক্যাপিটালিজম গ্রাস করেছে বিশ্বায়িত পুজি দিয়ে আমায়, যখন আদর্শ নামের কোনও শব্দই আর বেচে নেই, যখন
ডিপ্রেশান আর সেপারেশান আমাদের নিয়তি, তখন কীভাবে ব্যখ্যা
করব লেখক কবীরের এ সব জাদু-শব্দ? বড্ড এলিয়েনেটেড লাগছে
তাই আজ এ বই নিয়ে লিখতে, বরং খুলে দেখি আরেকবার সে বই,
গন্ধ নিই আরেকবার..
মানাগুয়ার রাস্তায় লেখক, ম্যলকম
আর স্টেসির সাথে লেখক, দিনলিপির ধরনে লিখে যাওয়া এ বই যেন
বা টেনে নিয়ে দেখায় সে সব বিপ্লবের দিনরাত। মানাগুয়ায় জলসার প্রস্তুতিও তার সাথে।
দেখায়, ওয়াশিংটনের বিলাসবহুল চাকরি ছেড়ে বিপ্লব প্রত্যক্ষ
করতে বেরিয়ে পড়া এক সাংবাদিককে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য,
অর্থনীতি সব নিয়েই যেন-বা কৌতুহল তার। গায়ে কাটা দেয়, সেই বিবরণ পড়ে আজও, যেখানে, রাস্তার মাঝে সুবিশাল জারে রাখা মায়ের দুধের কথা। যাতে, যুদ্ধরত মায়েদের সন্তানরা দুধ খেতে পারেন। প্রাণ যেন থাকে তাদেরও। এত
নিবেদন! কান্না পায় সহসা! দেশ, মা, যুদ্ধ ও ভালোবাসার এ সব দিনরাত্রি শুনে বিস্ময় লাগে! রাজনীতি আর সততা
শব্দটা একে অপরের বিপরীত আজ। কিন্তু এ বই সংশোধন করে সে ধারণা আরেকবার। বলে,
জীবন জীবিতের!
সত্তর দশকের মিথের সাথে আজ কতগুলো নাম পর
পর জড়িয়ে যায়! ভিয়েতনাম,
নকশালবাড়ি, নাপাম, তার আগে ফ্রান্স-৬৮, পরপর দুনিয়া কাপানো কত
নাম! নিকারাগুয়া বললে আজ ক জনের চোখ ঝলসে উঠবে? জানা নেই।
তাই এ বই সে ইতিহাসকে আরেকবার জাগিয়ে দেয়। দেখায় আলোর অপেরা। যেন একটা জ্যান্ত
তথ্যচিত্র। যেমন, এই লেখকের আরেকটি বই, আদার আমেরিকা! যে আমেরিকা মিথ্যা যুদ্ধ করে না কেবল ছোট ছোট এ সব দেশের
ওপর। সেই মুক্তচিন্তার জ্যান্ত দলিল এ বইও। বাংলা ভাষায় আন্তর্জাতিক এমন কাজ কমই
আছে। সশরীরে যুদ্ধ দেখা ও লিখে রাখা। এম এন রায়ের নাম মনে পড়ছে। মনে পড়ছে, আরো কিছু নাম। কিন্তু যতটা সমাদর এ বইয়ের মেলার কথা ছিল, তা পেল কি! নিকারাগুয়ার বিপ্লবের মতোই কি তা অবহেলায় থেকে গেল?
আজ মুক্ত অর্থনীতির এই জ্যান্ত ক্লীব সময়ে
এ কথাই বারবার মনে পড়ছে..
No comments:
Post a Comment