I
“In reading,
a lonely quiet concert is given to our minds; all our mental faculties will be
present in the symphonic exaltation.” – Stephanè Mallarmé
এদগার
দেগা,
ইম্প্রেশনিস্ট
ধারার অন্যতম স্থপতি, বন্ধুপ্রতিম মালার্মের কাছে আক্ষেপ করে
বলেছিলেন
– আমার
মাথাভর্তি অজস্র আইডিয়া, অথচ কবিতা লিখতে
পারিনা। মালার্মে প্রত্যুত্তর দেন –
কবিতা
কখনোই আইডিয়া দিয়ে তৈরি হয়না, শব্দ দিয়ে আঁকা
হয়।
কবি
শৌভ চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ ‘নিঃশব্দে অতিক্রম
করি’,
যা
বস্তুত তাঁর দিনানুদিনের সামান্য যাপনটুকুর উদযাপন, যেন এক
নিশ্চেতন স্নায়ুপরিধি বরাবর পাঠককে দাঁড় করায়।
শব্দের
ভিতর যে এক অবিনশ্বর আলো লুকিয়ে আছে, সময় ও দূরত্বের
এক দ্বৈত সহাবস্থান আছে, সেই শব্দ নিয়েই
কবির আত্মীয়তা এক নীরব বিভূতির সঙ্গে। একটি অদৃশ্য
মহাজাগতিক আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শৌভ নির্মাণ করেন রৌদ্রছায়ার সঞ্চার, অস্তিত্বের
অসহনীয় লঘুতা-
“যা-কিছু রয়েছে
সব এখানেই আছে
যা-কিছু কোথাও
নেই,
তারও
একটা না থাকা রয়েছে
এ
দুয়ের মাঝখানে,
ঘাসে
ঢাকা পথের রেখাটি
ক্ষীণ
হতে হতে,
শেষে, মিশে গেছে
ঘাসের শরীরে
শুধু
তার সম্ভাবনা,
দূরত্বকে
কিছুদূর আন্তরিক করে”
পাথরের
পাথরত্ব খুন করে মাইকেল এঞ্জেলো যেমন প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন ‘দাভিদ’ এর, ঠিক তেমনই
আপাত-নিষ্প্রাণ
এক একটি শব্দের মায়াবী বুননে শৌভ তার পাঠককে নিয়ে যান চেতনার এক নিভৃত স্থানাংকে। ইম্প্রেশনিস্ট চিত্রে ধৃত ক্ষুদ্রতম আলোছবির
মতো কবি জ্বেলে দেন এক অপার রহস্য-চিরাগ-
“একটু একটু
করে প্রতিদিন লিখি
একটু
একটু করে প্রতিদিন মেঘ
সরে
যায়। খাতার পাতায় অল্প
আলো
এসে পড়ে,
ছায়া
পড়ে
আমার
মুখের-
হাওয়ায়
অস্থির,
কাঁপা
যেভাবে
আমার মুখে ছায়া পড়ে
মেঘের, পাতার। যেভাবে, ঘুমের
মধ্যে,
প্রতিদিন
কেঁপে কেঁপে উঠি”
.
.
.
“স্বর্গীয়
পাখির ডিম সূর্য যেন সোনালী চুলের ধর্মযাজিকার চোখে;
গোধূম
ক্ষেতের ভিড়ে সাধারণ কৃষকের খেলার বিষয়...”
(নাবিক; সাতটি
তারার তিমির;
জীবনানন্দ
দাশ)
জীবনানন্দের ‘সাধারণ
কৃষক’ই যেন
স্বয়ং শৌভ,
সূর্যের
বিকল্পে শব্দ নিয়ে খেলা করেন। তবে এই
খেলা প্রাখর্যহীন, নিখুঁত সংযমে চালিত। শূন্যে ভাসমান এক উপবৃত্তের লোকাসে ধ্যানস্থ
কবি শুনতে থাকেন ঐ উপবৃত্তের দুই নাভি থেকে বেরনো করোগেটেড আর্তি, এক গাঢ়
স্বতোচ্চারণ-
“সরলতা,
ক্রমশ
জটিলভাবে ছড়িয়ে পড়েছে...
আলোকিত
বারান্দায়,
অন্ধকার
কোণে
সে
রয়েছে,
মাটি
ছুঁয়ে। পাতার ডগায়
কখনো
রোদ্দুর পড়লে,
মনে
হয়
সবুজ
উদ্যত ফণা-
নিঃশব্দে
ঘাতক এসেছে!”
অঁরি
মিশো কথাপ্রসঙ্গে লোকনাথ ভট্টাচার্যকে বলেছিলেন, একজন লেখকের
শ’পাঁচেক
পাঠক থাকাই প্রয়োজনের অধিক। তারপর
লোকনাথকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, একটা ডাবল ডেকার
বাসের লোকসংখ্যা সর্বাধিক কত হতে পারে। নিজেই
মনে মনে একটা সংখ্যা ভেবে নিয়ে, “একজন লেখকের জীবদ্দশায়
পাঠকসংখ্যা,
একটা
ডাবল ডেকার বাসের যাত্রীসংখ্যার সমান হওয়াই যথেষ্ট।”...
একটু
থেকে,
সামান্য
বিরতি নিয়ে বলেছিলেন, “একজন লেখকের শুধুমাত্র একজন সৎ পাঠকই যথেষ্ট
হতে পারে।”...তারপর কিছুক্ষণ
চুপ করে থেকে,
অনেকটা
স্বগতোক্তির ঢঙে, প্রায় বিড়বিড় করে বলেছিলেন,
“অবশ্য
সেই একজন পাঠক,
লেখক
নিজেও হতে পারেন।”
মিশো
বিবৃত এই আত্মমগ্নতা শীর্ষবিন্দু ছুঁয়ে গেলে কবি হয়ে যান বিচ্ছিন্ন, একপ্রকার
মৃত। ‘Miracle of Rose’-এ জাঁ
জেনে তাই বলেছেন-“The author of a beautiful poem is always dead.”
…সমূহ
গরল পান করে প্রকৃত কবি নিবেদন করেন এক কোমল জীবন-সংবেদ -
“একেই কি
মায়া বলে?
যেদিকে
তাকাই,
নিবিড়
ধ্বংসের মধ্যে রুবাইয়ের মুখ
ধীরে
ধীরে ফুটে ওঠে। সমস্ত ছায়ার পাশে
মুনিয়ার
নির্বিশেষ থাকা...
অথচ
বিস্ময়টুকু মিথ্যে নয়। শব্দের
শাসন,
সে-ও এক ধ্রুব
সত্য-
কঠিন
ব্যাধির গায়ে দুরারোগ্য সুখের রেখাটি
কখনো-বা চোখে
পড়ে,
কখনো
পড়ে না...
হয়তো
বনের মধ্যে,
সারাদিন, কাঠ কাটে
কেউ
কোথাও
ছুতোর মিস্ত্রি,
মনে
মনে,
শূন্যতার
ব্যবহার
জানে!”
ব্রহ্মাণ্ডের
এই অন্তহীন মায়াঘরে আত্মখননের প্রতিটি বিন্দুই হয়ত কবিতা।
কবিতারও
একটি নিজস্ব মনোবীজ থাকে, যার দ্বারা সে
ভূত-বর্তমান-আগামীর
সাথে সংযুক্ত। প্রাকৃত, অতিপ্রাকৃত
এক মন্ত্রঘোর,
যার
সন্ধানে কবি কখনো হাঁটেন ছায়াপ্রিজমের বাহু ধরে, কখনো কৃষ্ণগহ্বরের
অন্তঃকেন্দ্রে,
কখনো
মূলাধার,
কখনো
সৎকারের মধ্যে দিয়ে। খড় এবং
আকাশ,
সবুজ
প্রান্তর এবং বিষাদ – কখন যে মিলেমিশে কবিতার অন্তিমে পৌঁছে দেয়
তা রক্তকোষও জানে না। এই বৃত্তান্ত, প্রকৃত
প্রস্তাবে,
জন্ম-মৃত্যু
অতিক্রমী এক নীল আলোর আত্মজীবনী।
কিছু
জেন কবি,
কথিত
আছে,
সারাজীবন
শব্দের ধ্যান করে গিয়েও একটি শব্দও লেখেননি। শেষে মৃত্যু
আসন্ন বুঝে তিন শব্দের একটি বাক্য লিখেছেন মাত্র।
আত্মজিজ্ঞাসায়
কাতর হয়ে মৃত্যুলগ্ন অব্দি ভেবেছেন- বড় বেশি শব্দব্যয়
হয়ে গেল না তো!
সংহত
নির্মাণকালে ধীর, স্থির, কুশলী
থেকেছেন শৌভ। এই চটকসর্বস্ব একুশ শতকে,যেন জেন সন্ন্যাসীদের সেই শান্ততা, স্থৈর্যই মূর্ত হয়েছে শৌভ-র
কবিতায়।
“ইদানীং
ঝড়-বৃষ্টি
এলে,
প্রথমেই
ভাবি-
জানলাগুলো
ঠিকমতো বন্ধ আছে কিনা!
চারিদিক
ঘুরে দেখি,
সব
ঘর। যদি কিছু খোলা থাকে,
টেনে
বন্ধ করে দিই। যেগুলো বন্ধই ছিল
তাদেরকেও
সাবধানে পরীক্ষা করি
এইভাবে, সুরক্ষা
নিশ্চিত হয়
বাইরে
থেকে বাড়িটিকে দেখে, মনে হয়,
ভয়ে
চোখ বন্ধ করে আছে...”
কথা
শেখার পর থেকে আমরা আসলে কথক নই, অনুবাদক হয়ে উঠি। কবিতার মুহূর্তে, শব্দের
ভাড়া খাটা আততায়ীর মতো ক্ষিপ্র, অথচ উদাসীন হয়ে
যান কবি। শব্দই তাকে চালনা করে, সম্প্রসারিত
করে এবং সংহত করে। নিজের ভস্ম থেকে উঠে দাঁড়িয়ে শব্দ হয়ে যায়
স্বয়ম্ভূ।
"কার বাড়ি
মাঠের ওধারে,
শাদা?
সারাদিন
বন্ধ পড়ে থাকে,
আর
রাত্রি
হলে ঘরে ঘরে জ্বলে ওঠে আলো
কারা
আসে,
কারা
যায়,
অস্পষ্ট
গানের সুর
ভেসে
আসে মাঠের এপাশে!
কখনো
অনেক রাতে,
যদি
ঘুম ভেঙে যায়,
বারান্দায়
সিগারেট খেতে এসে দেখি -
চাঁদের
খুলির নীচে জ্বলে আছে অন্য এক প্রেতের করোটি
সারাদিন
ভুলে থাকি,
কাজেকর্মে, নানান
ছুতোয়
কেবল
দিনের শেষে,
বাড়ি
ফিরে
মনে
পড়ে সেই অন্য বাড়িটির কথা-
মাঠের
ওপাশে স্থির,
যেন
খুব অপেক্ষায় ফাঁকা!"
চাঁদের
খুলির নিচে যেন জ্বলে আছে এক অপার ক্রমবিচ্ছিন্নতা, যা কবির
কাছে এক প্রেতের করোটি বিশেষ - কেবল রাতের আঁধারে
জাগে। গান গায়।
সুর
ভেসে আসে। তারপর হয়ত নিঃসাড় নিস্পন্দ হয়ে ঘুমের গভীরতর
জীবনে চলে যায়। এভাবেই, সুন্দর
যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে, যখন সে তার চূড়ান্ত সীমাকে নিঃশব্দে অতিক্রম
করে যায়,
তখনই
ত্রাসের শুরু,
দুর্জ্ঞেয়তার
প্রারম্ভ। ত্রস্ত কবি এসে আশ্রয় নেন নির্জনতার কোলে। পরিব্যাপ্ত শূন্যতার সামনে নিভু নিভু কেঁপে
ওঠে তার কল্পলোক।
এই
সংকলনের প্রথম কবিতাটি মূল কবিতাগুলির সাথে একই ক্রমভুক্ত নয়।
অথচ, চিন্তাবিদ
ল্যুডহ্বিগ হ্বিটগেনস্টাইনকে উৎসর্গ করা এই কবিতাটি সমগ্র কবিতাগুলির চেতনা ও অস্তিত্ব
ধারণ করে আছে,
ঈষৎ
আঁধার নক্তাকাশ স্নেহপাশে বেঁধে রাখে যেমন নামগোত্রহীন অসংখ্য নক্ষত্র। Tractatus Logico-Philosophicus বইটির শেষদিকের একটি অনুচ্ছেদে হ্বিটগেনস্টাইন
বলেন,
"That whereof we cannot speak, thereof we must remain silent"... মিলন কুন্দেরা
কোথাও বলেছিলেন,
"Then one day I said something I would better have left unsaid."
কবি
শৌভ লিখেছেন
-
"একদিন
তাঁর সঙ্গে দেখা হতে, তিনি
বলেছিলেন, যা-কিছু বলার
নয়
তাকে
যেন নিঃশব্দে অতিক্রম করি -"
অথচ, পঞ্চ-ইন্দ্রিয়-গ্রাহ্য
এই জগতে,
দ্রষ্টা
ও দৃশ্যের অন্তর্বর্তী স্তরটি হ'ল প্রজ্ঞান, যেখানে
ভাষা এসে মেলে ধরে তার আধ্যাত্মিক স্বর। কবি আর
চুপ থাকতে পারেন না। পরমুহূর্তেই
বলেন
-
"সে-কথা শুনেও, পরাঙ্মুখ
আমি,
কতবার
সন্তানের
কথা ভেবে
জরায়ুর
কালো ফাঁকা গর্তের ভেতরে
নেমে
গেছি,
কতভাবে
দেখেছি, অন্ধকারে
পাতা নড়ে,
গাছের
শিকড় বেয়ে উঠে আসে জল-"
প্রেয়সীকে
বিবসনা দেখে রুষ্ট হয়েছিলেন বোদলেয়ার। রবীন্দ্রনাথ
প্রেমিকার জন্য রেখেছিলেন মৃদু প্রস্তাবনা - 'পরো তবে
সৌন্দর্যের নগ্ন আবরণ'।
ভাষা
এইভাবে খেয়াল করে কবির মানসিক চলন। নির্ধারণ
করে দেয় তার রতি ও বিরতি।
কবিতা
ও দর্শনের আন্তঃসম্পর্ক বিষয়ে বোঝাতে গিয়ে দার্শনিক জর্জ বোয়াস বলেছিলেন-
'ষোলো
বছরের বেশি বয়স্ক কেউ কবিতায় কী বলা হচ্ছে তার জন্য কবিতা পড়ে না।' এলিয়ট এমনকি বলেছেন –
দান্তে
বা শেক্সপিয়র কেউ প্রকৃত অর্থে যাকে চিন্তা বলে, তেমন চিন্তা
করেননি। ড. হুমায়ুন
আজাদ আরও সহজ করে বলেন, “রবীন্দ্রনাথের
কবিতায় দর্শন খুঁজলে কী পাই? তাঁর ভালো কবিতাগুলোতে
দর্শন পাই না,
সেগুলো
স্বাভাবিকভাবেই এত ভালো যে দর্শনের কোনো দরকার পড়ে না সেগুলোর, তাঁর খারাপ
কবিতাগুলোতে পাই তথাকথিত দর্শন।”
‘নিঃশব্দে
অতিক্রম করি’
বইটির
অধিকাংশ কবিতায় আমি দর্শন খুঁজিনি। কারণ- খোঁজার
কোনো দরকার হয়নি। কেঁচোর মাটি তোলার মতো নিঃশব্দে তৈরি করতে
পেরেছি এক পূর্বাপরহীন বিকল্প জগত। অধিকন্তু-
“দিগন্ত
নামক একটা সম্ভাবনা, ওইদিকে ঘন হয়ে আছে”
পুনশ্চঃ
কবিকৃত এই বইয়ের প্রচ্ছদে শি-তাও (১৬৪২-১৭০৭) এর আঁকা
'Last Hike Together' ছবিটি রয়েছে। বস্তুত, ছবিটির ভিতর ত্রসরেণুর মতো লুকিয়ে থাকা
অনিবার্য সম্ভাবনার মাধ্যমে, সৃষ্টির
পূর্বাহ্নে যেন নিজেকেই সৃষ্টি করেছে এই কবিতা-সংকলন। মেঘের ধূসর বৃষ্টিবাকল খুলে অনির্বাণ ঝরে
পড়েছে শূন্যতার সফল আলোসম্পাত।
(নিঃশব্দে
অতিক্রম করি/শৌভ চট্টোপাধ্যায়/শুধু বিঘে
দুই)
No comments:
Post a Comment