আগের সংখ্যাগুলি

Thursday, April 11, 2019

"যে বাজায়, সে মায়াবী তুমি নও"- হিন্দোল ভট্টাচার্য









একজন কবিকে ধারাবাহিক ভাবে পড়ার মাধ্যমেই তাঁর ব্যক্তিত্বকে বোঝা যায়। যদিও পাঠক হিসেবে এই বোঝা না বোঝায় অনেক ফারাক থাকে। তাই বলা উচিত, আমি অন্তত ধারাবাহিক ভাবে না পড়লে একজন কবির সামগ্রিক যাত্রাপথকে ধরতে পারি না। আবার অনেকের মতে, একজন কবির একটি বই হল অনেকটা হলোগ্রামের মতো। সেই বইয়ের মধ্যে ধরা থাকে তাঁর যাত্রাপথের অনেক টুকরোই। সে যাই হোক,  গত বছর প্রকাশিত বইগুলির মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান বই হল সেলিম মল্লিক-এর সম্পাদনায়, তাঁরই প্রকাশনায় দীপক রায়ের কবিতা। গত সহস্রাব্দের সাত-এর দশকের এই কবি তাঁর কাব্যজীবনের প্রথম থেকেই যে গভীর নির্জন পথে হাঁটা শুরু করেছেন, তা খুব একটা দুরূহ না হলেও সুগম্য নয়। কারণ এই অভিযাত্রায় রয়েছে অনেক যন্ত্রণা, অনেক অপমান, অনেক ক্লান্তির সঙ্গে একার যুদ্ধ। প্রথমেই একটা কথা স্বীকার না করলে অন্যায় হবে। আর তা হল, এমন নিপুণ সম্পাদনার ক্ষমতা এই সময়ে যদি বাংলার কবিদের মধ্যে কোনও একজনের থেকে থাকে, তবে তিনি সেলিম মল্লিক। দীপক রায়ের কাব্যগ্রন্থগুলির থেকে সঠিক, প্রতিনিধিস্থানীয় কবিতা বেছে নেওয়া থেকে শুরু করে, তা সাজানো এমন ভাবে, যাতে কবির কাব্যব্যক্তিত্ব সম্পূর্ণভাবেই ধরা পড়ে, - এমন অন্তদৃষ্টিসম্পন্ন এই সম্পাদনা, যে সম্পাদনাও যে কখনও কখনও কবিত্ব হয়ে ওঠে, তা মনে পড়ে যায়। দীপক রায়ের কবিতা নিয়ে লিখিত তাঁর ভূমিকাটির মধ্যেও রয়েছে সেই নৈপুণ্যের ঝলক। কিন্তু ভূমিকাটি নিয়ে একটি কথা না বলে পারছি না, আর তা হল-সম্পাদনার যাত্রাপথ, ভিশন এবং বীক্ষাটি নিয়ে যদি তিনি লিখতেন এখানে, তা হলে বাংলার পাঠক আরও বেশি সমৃদ্ধ হত। আশা করি সেলিম অন্যত্র তা নিয়ে লিখবেন। তিনি না লিখলে আর কেই বা লিখবেন এই সময়ে। আসি দীপক রায়ের প্রসঙ্গে। এখানে যিনি থাকেন তিনি রাজা, স্লেজগাড়ি, থেকে গৃহযুদ্ধের উঠোনে রচিত পর্যন্ত সবকটি কাব্যগ্রন্থ থেকে বাছাই করা কবিতা নিয়েই এই দীপক রায়ের কবিতা। এছাড়াও রয়েছে অগ্রন্থিত কবিতা। প্রকাশিত কবিতার বই সম্পর্কে তথ্য ইত্যাদি। ধারাবাহিক ভাবে পড়ার সময়ে আবিষ্কার করি, কত বিচিত্র পথে তাঁর দার্শনিক জগতের পরিভ্রমণ হয়েছে জীবনে। এও লক্ষ্য করি, তাঁর সারাজীবনের কাব্য হল, নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে কাব্যের সেই এপিফ্যানি থেকে চলে যাওয়া বোধির সেই স্তরে, যাকে অর্জন করার জন্যেই হয়ত কেউ শিল্পচর্চা করেন। একই সঙ্গে খারাপ লাগে এই কথা ভেবে, যে, বাংলা ভাষার এই গুরুত্বপূর্ণ কবি কেন অনাদৃত? কেন এখনও একলাটি ঘরের কোণে পড়ে রয়েছেন? কেন নির্জনে রয়েছে তাঁর কবিতা? ‘দীপক রায়ের কবিতা’ প্রকৃত প্রস্তাবেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলন, বাংলা সাহিত্যের সম্পদ বলা চলে।

দীপক রায়ের কবিতা/ সম্পাদনা ও সংকলন- সেলিম মল্লিক/ অস্ট্রিক/ প্রচ্ছদ- প্রণবেশ মাইতি/ ১৫০টাকা


‘এই রোদ, এই জল, হাওয়া—এদের মধ্যেই বারবার ফিরে আসা, ফিরে ফিরে আসা।
জন্মজন্মান্তর ধরে যেন এই যাওয়া আর আসা চলছে। এইসব ভাবি কিন্তু কোনও কিনারা
পাই না;
শুধু শিরীষ গাছের ডালে সূর্যের আলো এসে পড়ে আর সবুজ পাতায় দেখি অজস্র
আলোর আলপনা...
হাওয়া বহে যায়—বর্তমান থেকে একটানা ওই হাওয়া বহে যায় অনাদি অতীতের
দিকে...’

কবি পার্থপ্রতিম মজুমদার এমনই এক ব্যক্তিত্বের কবি, যিনি অতি নীচু স্বরে প্রকৃতির সঙ্গে একাকী কথাবার্তা বলে চলেছেন তাঁর কাব্যজীবনের শুরু থেকেই। এই যাপিত আধ্যাত্মিকতার টুকরো টুকরো প্রতিফলন আমরা যখন পাই, তখন বুঝতে পারি, এই নীরবতা আসলে কত কথা বলে। তাঁর স্মৃতি, তুমি পাথরের ফুল এক আশ্চর্য কাব্যগ্রন্থ। এমন এক অনন্ত জীবনের জন্য তিনি প্রার্থনা করছেন এই কাব্যগ্রন্থে, যার পরে আর অন্য কোনও কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না। যেমন একটি গান বলে আরেকটি কবিতার কথা এখানে না বললেই নয়। কারণ এই কবিতাটি হল এই কাব্যগ্রন্থের প্রাণভোমরা।

আনন্দকে বলি,এসো, আমার লেখায় এসে দাঁড়াও। ভোরের হাওয়াকে বলি, আরো আরো প্রাণবায়ু এনে দাও আমার লিপিতে। ভোরের আলোকে বলি-
অনন্ত কি তা আমি জানি না, কিন্তু তোমার এই আলোর রূপে আমি চিরকালের মন্ত্রমুগ্ধ...

কোনো মৃত্যু, নশ্বরতা আমার জন্য নয়...

এক ধীর শান্ত নদী যেন বয়ে যায় পার্থপ্রতিমের কবিতায়। বেশ কিছু ধ্রুপদী সনেট এবং দশ লাইনের কবিতা রয়েছে এই কাব্যগ্রন্থে, যেগুলি যেমন ব্যক্তিত্ব এবং ভাবনার অনন্য লিপি তেমন নির্মাণের কারুকাজে ভাস্বর। আপাত ভাবে মনে হতে পারে এক অন্তর্লীন রোমান্টিক সুর বয়ে যায় তাঁর কবিতাগুলিতে। কিন্তু সেই সুর ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে তাঁর জীবন এবং সময়কে খুঁজে চলার আকুতি। যেমন কিছুই হারায় না শীর্ষক কবিতায় তিনি লিখছেন- তুমি নেই তুমি আছ জানি/ তোমার ভিতরে আমি আছি। কী তার জীবনদর্শন এ প্রশ্ন যদি কেউ তোলেন, তবে তাঁর কবিতা অনুসরণ করে বলা যায়- ‘ আমিও তাদের মতো, একদিন সব ছেড়ে যাব/ প্রতিটি মুহূর্ত আমি সুন্দরের পায়ে রেখে যাব।‘ কথা হল, তাহলে জীবনের কোন সংকট তাঁকে এই ভাবনার কাছে নিয়ে এসেছে? কোন সেই অন্তর্লীন শক্তি, যা তাঁকে এই আলোকপ্রত্যাশী করে তুলেছে? কোন সেই বিশ্বাসের সুর্‌ যা তাঁকে গভীর বিশ্বাসী করে তুলেছে? এক গভীর ঈশ্বরচেতনা তাঁর কবিতার  মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। হয়ত এই আধ্যাত্মিকতা বা এই সংযোগ সকলের জন্য নয়, বা হয়ত সকলে এই সংযোগকে আবিষ্কার করতেও পারবেন না। কিন্তু তাঁরা তো প্রেমকে আবিষ্কার করতে পারবেন। পার্থপ্রতিমের কবিতা রবীন্দ্রনাথের প্রেম ও পূজার কবিতার মতোই পারস্পরিক হয়ে থাকে।

স্মৃতি, তুমি পাথরের ফুল/ পার্থপ্রতিম মজুমদার/ আদম/ প্রচ্ছদ- শোভন পাত্র/ ৮০টাকা

তরুণ প্রজন্মের কবি স্রোতস্বিনী চট্টোপাধ্যায়। কিন্তু কী অদ্ভুত গভীর এবং গোপন তাঁর মায়ায় পাওয়া এই কাব্যগ্রন্থ মায়াস্পর্শ তির্যকপ্রবণ। এই যে মায়ায় পাওয়া বললাম, তার জায়গায় বলা যেত দেবতায় পাওয়া, বা বিষাদে পাওয়া বা প্রকৃতিতে পাওয়া। যে একাকীত্বের সাধনা তিনি করেছেন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিতে, তা বড় সহজ কাজ নয়। ভিতরে কোনও বাউলের ঘর না থাকলে, এই কবিতাগুলি লেখা যায় না। একটি উদাহরণ-
সবটুকু তোমার।
এই সমর্পণ শেষে
সে ঘুমিয়ে পড়ল

এই মুহূর্ত থেকে তার সমস্ত দোষ
                            ক্ষমা পাচ্ছে
ঘন চাঁদের আলো এসে ধুয়ে দিচ্ছে ঘর

সে যেন শিশুর প্রথম কান্না
                         আদিম, সুন্দর
                                             ( সমর্পণ)

জয় গোস্বামীর একটি কবিতায় একটি ম্যাজিকের মতো লাইন ছিল- দুঃখের কথাটি আমি দুঃখকে বলিনি। স্রোতস্বিনীর কবিতার এই বইটি পড়তে পড়তে মনে হয় দুঃখের কথাটি তিনি প্রকৃতিকে বলছেন খুব গোপন করে। নিজের দার্শনিক অস্তিত্ব, নিজের ভাঙা প্রেমের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বসন্তের বাতাসের সঙ্গে কাছে ও দূরের সংলাপ তৈরি না হলে কখনও এই সব কবিতা লেখা যায় না। বোঝা যায় এক অকথিত যন্ত্রণার স্বরলিপি লিখছেন কবি। কিন্তু সেই স্বরলিপি উচ্চকিত নয়। কারণ, যে কোনও গভীর বিষাদ, যে কোনও বড় দুঃখ আসলে এমন এক বোধির কাছে নিয়ে যায়, যা ক্রমশ নীরব করে দেয় মানুষকে। সেই ব্যক্তি যদি কবি বা শিল্পী হন, তিনি তখন মৃদু হাসির মতো আগ্রহে দুঃখের সঙ্গে, যন্ত্রণার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে শুরু করেন। আর সে কারণেই স্বোতস্বিনী লিখতে পারেন- ক্ষতচিহ্নের সামনে দাঁড়িয়ে/ ক্ষমা করতে শিখে যাই।  ‘সুখ, একা, রাজবাড়ি, বোধন, তীর্থ, ঘোর, কলঙ্ক, বিন্দু—এরকম আশ্চর্য সব কবিতায় এই কাব্যগ্রন্থ যেন হয়ে উঠেছে একলা মানুষের নির্জনে কথোপকথনের অন্তর্জগৎ। এখানে রাজবাড়ি শীর্ষক কবিতাটি তুলে দেওয়া যায়-

রাশি রাশি কাঞ্চন ফুল ঝরে পড়ল
এই মুহূর্তে

মৃদু হাওয়া এসে নীচুস্বরে বধির করছে চারপাশ,
আমি মাথা উঁচু করে দেখি
অপূর্ব আকাশ আদিগন্ত ছড়িয়ে যাচ্ছে,

খেয়া পারাপার করছে দুজন যুবক—
তারা পাড়ি দিয়েছে কোন দূর দেশে,
তবু রাজবাড়ি দেখা যায় না আর

কিছু কিছু কাব্যগ্রন্থ থাকে, যার অভিযাত্রা সেই কাব্যগ্রন্থেই শেষ। হয়ত এর পর স্রোতস্বিনীর অন্য কাব্যজীবন শুরু হবে। কিন্তু এই কাব্যগ্রন্থটি এক স্বতন্ত্র সংলাপ হয়ে থেকে যাবে তাঁর কাব্য-জীবনে। যদি না, তিনি নিজেই এই গ্রন্থের প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজে পান কখনও। কিন্তু আদৌ উত্তর কি পাওয়া যায়?

মায়াস্পর্শ তির্যকপ্রবণ/ স্রোতস্বিনী চট্টোপাধ্যায়/ প্রচ্ছদ- সুদীপ্ত দত্ত/ সিগনেট প্রেস/ ১০০টাকা

কোনও কোনও আশ্চর্য কবি এতটাই নির্জনে থাকেন, যে, তাঁদের সহজে চিহ্নিত করা যায় না। কিন্তু চিহ্নিত হতে যে তাঁরা চান না। তাঁরা গভীর কবিতার সাধনাই করে যেতে চান। পঙ্কজ চক্রবর্তী এমন একজন কবি। একটি কবিতা তাঁর কাব্যাদর্শের এক সুচারু পরিচায়ক।

আমার উপর আলো পড়ুক আমি চাই না
আমাকে দেবতার মতো দেখাক আমি চাই না
বরং প্রতিটি ছাত্রের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমি
দেখাব নদীর পাশে কীভাবে জেগে ওঠে ঘুমন্ত শহর
একথালায় ভাত মেখে ন’জন ভাগ করে খাব

আমি ও আমার ছাত্র দরজা খুলে ঝড়কে আমন্ত্রণ জানাব।

( আশ্রমিকঃ এক)

চার ফর্মার সামান্য জীবন নামক যে অসামান্য কবিতার বইটি হাতে এল, সেই বইটির ছত্রে ছত্রে নতুন কবিতার পদধ্বনি। প্রতিটি শব্দের কোডের ভিতর যে বসে আছে অন্য কোনও শব্দের রূপ, তা তাঁর কাব্যসাধনার মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কে এই ছাত্র, আর কেই বা এই শিক্ষক, এই প্রশ্ন আমাদের মনের মধ্যে ঘুরে বেড়াতে পারে। তিনি নিজেই এই গ্রন্থের বার্তা শীর্ষক কবিতায় লিখেছেন- ‘ যে কোনও পুরোনো শব্দের অভিঘাত ঘেঁটে আমি জেনেছি/ বাতিল ও নগণ্য ক্রিয়াপদ কীভাবে তুলে আনে/ সিঁড়ির নীচের অন্ধকার”। ছোট ছোট বস্তু ও শব্দখণ্ডের ভিতর তাঁর যে অর্থসাধনা, তা তাঁকে ব্যক্তিত্বের চেতনার এক অন্য স্তরে নিয়ে যাচ্ছে।

শূন্য বোতল, আমি তার ছায়া স্পর্শ করে
বুঝেছি প্রখর সত্য পিপাসার, পারম্পর্যহীন
বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো এইসব ঘরবাড়ি
ভাঙাচোরা, দরজা খিলান কারা নিয়ে গেছে
কেবল রয়েছে এক ভাঙা চেয়ার, এখনও সামান্য
নড়ে চড়ে ওঠে- আভিজাত্যটুকু শুধু এই।
                                                   ( আভিজাত্য)

এই একটি কবিতার মধ্যে দিয়েই তাঁর কাব্যব্যক্তিত্ব সম্ভবত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সমর্পণ বা ঈশ্বরচেতনার নিঃসংশয় বিশ্বাসের জায়গায় নিজেকে নিয়ে যাচ্ছেন না তিনি। বরং তিনি নতুন করে খুঁড়ে দেখছেন কোথায় পড়ে আছে ভাবনার বিশ্বসংসার। অন্তর্লীন এক ম্যাজিক রিয়ালিজম তাঁর কবিতাকে স্পর্শ করে আছে। ভাবনা এবং ভাষা দুই দিক থেকেই নতুন কবিতার দিকে হেঁটে চলেছেন কবি।

চার ফর্মার সামান্য জীবন/ পঙ্কজ চক্রবর্তী/ নাটমন্দির/ প্রচ্ছদ- জিশান রায়/ ৮০ টাকা

তরুণ কবিদের মধ্যে যাঁরা যাঁরা ছাপ ফেলতে শুরু করে দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম কস্তুরী সেন। তাঁর লেখার মধ্যে ছন্দ, অলংকার শুধু নয়, এক স্বতঃস্ফূর্ত অথচ গোপন সাধনা আছে। যে সাধনা কবিকে আরও নিপুণ ভাবেই ব্যক্তিত্বের সাধনার মধ্যে নিয়ে এসেছে। তিনি অল্প কথার কবি নন। বরং তাঁর কবিতার মধ্যে রয়েছে এক ধরনের বনস্পতিসুলভ আচরণ। গাছ, ডালপালা, ফুল, ফল, ছায়া, বৃষ্টি, ভাঙা কোটর, শুকনো পাতা পড়া গুঁড়ি, এলোমেলো ভাবে হেঁটে যাচ্ছে হয়ত পিঁপড়ে, ওই তো এসে বসল একটি কাঠবিড়ালী।  সবকিছু নিয়েই তিনি যেন উচ্ছ্বাসে মেতেছেন। এই উচ্ছ্বাস যে সবসময় আনন্দের, তা নয়। কখনও কখনও গভীর বিষাদেরও। তাঁর নতুন কবিতার বই নাম নিচ্ছি মাস্টারমশাই। ছোট ছোট কাজ এত অসংখ্য এই কবিতার বইয়ের পাতায় পাতায় যে মনে হয় কোনও এক সাঙ্গীতিক অনুষ্ঠানে এসে পড়েছি, আর সেই অনুষ্ঠানে শ্রোতাদের বসার জায়গা হল বিভিন্ন গাছের ছায়া। যে যার নিজের মতো করে বেছে নিতে পারে, সে কেমন করে সঙ্গীতের শ্রোতা হতে পারে।

‘ ...সে লেখা আমার নয়, সে লেখা আমার নয়
মাধুর্যের দেহনিম্নে আদ্যন্ত রঙিন
অতুল আশ্চর্য জড়ো করে
সারাজীবনের বৃষ্টি তুমি হয়ে ঝরে গেছে
একদিন লেখার উপরে।‘
( ঋণ)

বাংলা ভাষার নামে, অবৈধ, ভীরু, খোঁজ, অনধিক,  লেখা – এরকম আরও বেশ কিছু আশ্চর্য কবিতার কথা বলা যায়, যেগুলি স্রেফ নির্মাণের কারুকাজের জন্যই মনে থেকে যায়। কিন্তু কবিতা তো শুধু নির্মাণ নয়। তাই কবিতাগুলি আবার পড়লে বোঝা যায়, সেখানে নির্মাণ প্রকৃতপক্ষে ভাবনা ও আঙ্গিকের সঙ্গত। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে অন্ধ শীর্ষক কবিতাটির কথা। অথবা ছুটি শীর্ষক কবিতার কথা। বারান্দা শীর্ষক কবিতাটি সম্ভবত এই বইয়ের সবচেয়ে ভালো কবিতা।

সেসব আলাদা কথা। ঘুমোনোর ভান।
সেসব সতর্ক দৃশ্য। মাঝরাতে কথা থেকে ফিরে আসা শিশুটির পাশে।
ঘুম শ্বাস ঝড়ঝাপটা, চাঁদের বিচিত্র কারুকলা,
সব সামলে কথা মাত্র, এর বেশি হাতে নেই আর।
কথা শেষ হলে, ভোরের গেরস্ত টবে ফুল ফোটে।
বারান্দা আমার।
যে ফোটাক, সেই ফুল উৎসর্গ তোমাকে করেছি
মাটি কামড়ে পড়ে আছি। মাটি ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না


নাম নিচ্ছি মাস্টারমশাই/ কস্তুরী সেন/ ধানসিড়ি/ সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়/ দাম- ৯৫টাকা

খুব সম্ভাবনাময় কবি সরোজ দরবার। শুধু বিঘে দুই থেকে প্রকাশিত তাঁর ‘কৃষিকথা সামান্যই’ একটি একফর্মার বই হলেও, প্রভাবে এটি সম্পূর্ণ একটি কাব্যগ্রন্থের সমতূল্য। একফর্মার বই অনেক সময় সেই প্রভাব ফেলে পাঠকের মনে, যা একটি সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ফেলতে পারে না। বিশেষ করে স্বীকার করতেই হবে, বাংলা কবিতার ইতিহাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বইই একফর্মা বা দুফর্মার। সরোজের কবিতার বইটিতে রয়েছে দুটি সিরিজ- কৃষিকথা সামান্যই এবং কবিতা যা লেখায়। দুটি ভিন্ন কাব্যভাষায় এই তিনটি সিরিজের কবিতা লেখা। কৃষিকথা সামান্যই এবং কবিতা যা লেখায় সিরিজের ইঙ্গিতময়তার পাশাপাশি এখানে পাঠক টের পাবেন আরেকধরনের প্রত্যক্ষ বাকভঙ্গি।

“... সামান্য কৃষক আমি
বর্ষণ শেষে দু-দণ্ড মাথা রাখি তোমার থানে
বলি মনে মনে, হে ঈশ্বরী প্রবীণা
সোনার থানে ছেয়েছে মানবজমিন আমার

ওদের বুকে দুধ দিতে তুমি ভুলো না”

(কৃষিকথা সামান্যই, ২ নং কবিতা)

এর পাশাপাশিই তুলে ধরতে হয় আরেকধরনের বাকভঙ্গি-

তুমি কি রাণা রায়চৌধুরীর কবিতা
ভাস্কর চক্রবর্তীর, না কি মৃদুল দাশগুপ্তর?
আল মাহমুদেরও হতে পার

মোটমাট তুমি অন্য কারোর
রাতের বাতিল, ভোরের আদর
অন্যের সংসার থেকে ছুতোনাতায়
এসে করে যাও, করতে পার
পোড়া কপালে সেই-বা কী কম!

দেখো, কতগুলো বসন্ত জুড়ে
আমাদের কত ফুল ফুটে গেল,
আমরা তবু টের পাইনি সংগম!
                ( প্রেমেরই কবিতা, তিন নং কবিতা)

পাঠক হিসেবে মনে হয় প্রেমেরই কবিতা- এই সিরিজটি সম্ভবত সবে শুরুর মুখ দেখাল। আগামী দিনে এই কাব্যভাষায় যদি একটি পূর্ণাঙ্গ কাব্যগ্রন্থ পাই আমরা, তাহলে আমরা আনন্দিত-ই হব।

কৃষিকথা সামান্যই/ সরোজ দরবার/ শুধু বিঘে দুই/ প্রচ্ছদ- চিরঞ্জিৎ সামন্ত/ ৩৫টাকা

দর্শন এবং কবিতার মধ্যে পার্থক্যের জায়গাটি অতি সূক্ষ্ম। কিন্তু দর্শনচর্চা এবং কবিতার মধ্যে পার্থক্যের জায়গাটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখানো যায়। কিন্তু এই বিষয়টি এত দীর্ঘকালীন তর্কের বিষয়, যে সহজে সাধারণ কিছু কথায় তা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এটুকু বলা যায়, দর্শনের সন্দর্ভ লেখার জন্য কবিতা নয়। কারণ কবিতা হল দর্শনের সেই অন্তর্বস্তু, যার জন্য দর্শন তার ভাবনার ভিতর চুপ করে বসে থাকে। কবিতা একজন কবি কেন লেখে, এর কোনও উত্তর পাওয়া যায় না। কেউ যদি জিজ্ঞেস করেন, কেন আকাশ থেকে বৃষ্টি পড়ে, কেন বসন্তের বাতাস মন কেমন করে দিয়ে যায়, কেন জন্ম হল, কেন মৃত্যু, -- এসব প্রশ্নের জন্য কিছু কিছু যুক্তি সাজানো যায়, কিছু কিছু নশ্বর যুক্তি নিজেদের মধ্যে কথাও বলে। কিন্তু কবি সম্ভবত তার দেখা দৃশ্যের ভিতর, তার অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে সেই সব কথার কাছেই আত্মসমর্পণ করেন, যার প্রশ্ন খুঁজে চলেছেন তিনি নিজে। প্রকৃতপ্রস্তাবে, একটি প্রশ্ন আরও একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়ে যায়। আর আমরা সেই সব প্রশ্নগুলিকে লিখে যেতে পারি। এত সব ভাবনার অবতারণা করার কারণ একটি আশ্চর্য কাব্যগ্রন্থ। প্রভাত সাহা-র অস্তিত্বের ভিক্ষাভাষা।
সম্পূর্ণ কবিতার বইটি একসঙ্গে পড়া অসম্ভব বলে মনে হল। কারণ এই কবিতার বইয়ের প্রত্যেকটি কবিতাই এত অসংখ্য দার্শনিক আত্মজিজ্ঞাসার, যে , কবিতাগুলির মধ্য দিয়ে সহজে ভ্রমণ করা যায় না। একটি কবিতা পড়ে তার পর নিজের মনের মধ্যেই চলে নানান ভাবনার সঙ্গে দিনযাপন, রাতযাপন। দর্শনচর্চা এবং কবিতার এমন সঙ্গত সম্ভবত আগে কখনও পড়িনি বলেই মনে হয়। অথচ এই গ্রন্থটি শুকনো কিছু দর্শনের বাকবিস্তারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং দর্শনকে আত্মস্থ করে হয়ে উঠেছে নিরাভরণ কবিতাই।


নিজেকে পেয়ে
নিজেকে শূন্য করে হারিয়ে যাস তুই

অবশেষে তোরই প্রতীক্ষায় রচিত আকাশ
মুক্তির বন্ধন হয়ে আসে

উন্মুক্ত অন্ধকারে সঞ্চারিত হয়
অশ্রুর আলোয় ভরা আনন্দ

চির-ভিখারির আনন্দ-বেদনা।

(পূর্ণিমা)

এই কবি, মনে হয় সমর্পণের পর আরও গভীর ভাবে কোনও সমর্পণের রাস্তা খুঁজছেন। এই সমগ্র কাব্যগ্রন্থটিই এই খুঁজে চলার ভাষ্য। সেই সমর্পণের ভাষ্য কীরকম? তিনি লিখছেন- ‘ এত প্রাণ দিলি প্রভু, এত প্রাণ/ এত প্রাণ নিয়ে কোথায় জুড়োব?/ যদি না প্রাণের পরাণখানি পাই’। এখানে এসে মনে হয় এই গ্রন্থটি নিয়ে খুব একটা আলোচনা করা যাবে না। কারণ প্রাণের পরাণখানিই নিয়ে যিনি লেখেন, সেই পরাণের সন্ধান যারা না করেছে, তাদের পক্ষে এই অচিনপাখির কথা ভাবাটাই অসম্ভব। উপনিষদের পাশাপাশি বৌদ্ধ দর্শনের ভাবনাও যেন প্রতিধ্বনিত হচ্ছে এই কাব্যগ্রন্থে।

... আমার নিঃস্বের ভেতর পূর্ণতার শূন্য-আকাশ
তুই এনে না দিলে
কীভাবে আমি তোকে পূর্ণ করে যাব?

কেড়ে নেব তোর ভিক্ষাপাত্র?

(অপরাধ)

প্রভাত সাহার এই কাব্যগ্রন্থ আমাদের আশ্চর্য করে। শুধুমাত্র তাঁর নিরন্তর অস্তিত্বের জিজ্ঞাসাগুলিকে নিয়ে প্রশ্ন করে যাওয়ার জন্য নয়। তাঁর গভীর বিশ্বাসের মধ্যে যে প্রশ্নের অনন্ত আর্তি রয়েছে, তা আমাদের উন্নীত করছে। তা কবি হিসেবে তাঁকে যে আরও বেশি বিপন্ন করছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। বিশ্বাসের মধ্যে এই নিরন্তর বিপন্নতার কবিতা খুব বিরল। আবার বিপন্নতার মধ্যে গিয়েও তিনি বিশ্বাসের কথা বলছেন। এখানেই দার্শনিক সূক্ষ্ম সন্দর্ভ মিশে যাচ্ছে কবির অস্থির যাপনের মধ্যে।

আকাশ পাশে এসে না দাঁড়ালে
শরীরে অজস্র শরীর;

তাদের অজস্র মুখের ভেতর
হারিয়ে যায় তোর মুখ
কিছুতেই খুঁজে পাই না তোকে

নক্ষত্ররা পাশে এসে না দাঁড়ালে
তোর মুখের একান্ত আলোয়

তোর নিজস্ব কোনও গোপন অন্ধকার নেই।

(তোর মুখের একান্ত আলোয়)

আবার মনে পড়ে জীবন দুঃখময়। জীবন প্রকৃতই দুঃখময়। এই দুঃখ বড় দুঃখ। ছোট দুঃখ নয়।

অস্তিত্বের ভিক্ষাভাষা/ প্রভাত সাহা/ প্রচ্ছদ- হিরণ মিত্র/ ১৫০টাকা

আর একটি আশ্চর্য কাব্যগ্রন্থ হল সর্বজিৎ সরকার-এর জাদুকরি ও চিতাবাঘ। ৪৮ পাতার এই কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতাতেই একজন চিত্রকরের তুলির যন্ত্রণা। বিষাদের ধূসর ছোপ সমস্ত কবিতার ক্যানভাসে। কিন্তু তার প্রতিটি আঁচড়ে রুয়েছে ভালোবাসার সাক্ষ্য। এ এক জীবনদায়ী ভালোবাসা। একটি জেনগল্পে যেমন ছিল, হত্যাকারীর মধ্যেই থাকে যে নিহত হচ্ছে, সে। আবার যে নিহত হচ্ছে, সে-ই থাকে হত্যাকারীর ছুরির ভিতর। সর্বজিৎ সরকারের জাদুকরি ও চিতাবাঘ এরকম ভাবেই পরস্পর হয়ে আছে। জীবনের মধ্যে মৃত্যু এবং মৃত্যুর মধ্যে জীবনের যে রহস্যময় আলোছায়া থাকে সারাজীবন, সর্বজিৎ সেই আলোছায়ার মধ্যে ডুব দিয়েছেন। 

গতকালের গোলাপ তোড়ায় অল্প ঢেলে দিচ্ছো জল,
ওরা আরও একদিন বাঁচবে,
ওদের শিকড়ে জল
জল জড়িয়ে আছে ওদের শিকড়ে।
মাথার কাছে রেখেছ গোলাপগুচ্ছ,
চাঁদ  যেমইন , পূর্ণ রাতে, মাটিতে নেমে আসে
তেমনি উপগত হবে আজ, আমাতে তুমি।

( জাদুকরি)

কবির আভ্যন্তরীন অভিযাত্রাকে বোঝা যায়, যখন তিনি কেন আর কবিতা লিখিনা শীর্ষক কবিতায় লেখেন-

যে বাজায়, সে তুমি নও
যে বাজায়, সে মায়াবী তুমি নও
যে বাজায়, তার মায়া তুমি

বোঝা যায়, এই কবি সেই বিরল কবিত্বের অধিকারী, যে কবিত্ব কবিকে আত্মধ্বংসী এক পথে নিয়ে যায়। খুব সহজ নয় সে পথ। সে রাস্তায় বেশি লোক নেই। দুদিকে বাড়ি থেকে খুব বেশি আওয়াজ ভেসে আসছে না। হয়ত দূরে কোথাও কেউ শাঁখ বাজাচ্ছে। বা ভায়োলিন ভেসে আসছে। সমস্ত দর্শনের গ্রন্থের উপর দিয়ে ভেসে আসছে মানুষের বিষন্ন স্বপ্নের হাওয়া। দর্শনের কথা, আত্মজিজ্ঞাসার কথা, নিরন্তর সংশয়ের কথা এই কাব্যগ্রন্থের কোনও কোনও কবিতায় সরাসরি চলে এসেছে যেমন, তেমন কোনও কোনও কবিতায় গভীর ইঙ্গিতবাহী। আমার ব্যক্তিগত ভাবে সেই ইঙ্গিতবাহী কবিতার দিকেই পক্ষপাত বেশি থাকলেও, স্বীকার করতেই হবে, এই কবিতাগুলি কবির নিজের জন্যই খুব প্রয়োজনীয়। যেন লাতিন আমেরিকার কোনও না কোনও ফিল্ম উঠে আসছে তাঁর কবিতায়। বিশেষ করে তাঁর কিছু কবিতা পড়তে পড়তে মনে পড়ে যায় এসিলিও সুবিয়েলার সেই বিখ্যাত ছবি দ্য ডার্ক সাইট অফ দ্য হার্টের কথা।

... আর বুকের বন্ধদরজা বৃষ্টিকে 
ঝরিয়ে দেবে বলে, তুমি আজও খুঁজে বেড়াচ্ছো
অনেক দূরের সমুদ্রের ওপারের একটা ধূসর শহর,
একটা হারিয়ে যাওয়া মানুষের মন,
মেশিনের আওয়াজ আর জলের ঢেউয়ের 
গর্জনের মধ্যে বারেবারে মিলিয়ে যাওয়া
একটা কণ্ঠস্বর, যা শুধু তোমার জন্যেই
সারারাত জেগে থাকতে চাইছে।

(দাম্পত্যঃ আমিষ রূপকথা)

আমাদের জীবন কীরকম, তা যদি কখনও কেউ দ্রুত আমাকে উত্তর দিতে বলে, তবে আমি তাকে পড়তে বলব এখানে ও অনন্ত শীর্ষক কবিতাটি। 
 কেন, তা রহস্যই থাক। 

শুধু একটি লাইন তুলে দেওয়া যাক বরং- ' অনন্তকাল...আর একটা দিন' / তুমি বলেছিলে তাকে। 

পাঠক, বইটি পড়ুন। 

জাদুকরি ও চিতাবাঘ/ সর্বজিৎ সরকার/ সপ্তর্ষি প্রকাশন/ প্রচ্ছদ- সর্বজিৎ সরকার/ ১০০টাকা



1 comment:

  1. দুর্জয় আশরাফুল ইসলামApril 15, 2019 at 2:55 AM

    ভালো আলোচনা। দুটো বই নিয়ে আগ্রহী হলাম। সংগ্রহ করে নিবো

    ReplyDelete