আগের সংখ্যাগুলি

Friday, April 12, 2019

‘ঘষা কাচের প্রলাপ’ অন্যস্বর, অন্যদ্রাঘিমা-- চিত্তরঞ্জন হীরা





একটি আয়না হতে পারে এবং প্রলাপগুলো কবিতা । এককথায় ‘ঘষা কাচের প্রলাপ’ অন্যস্বর, অন্যদ্রাঘিমা ভাবা যায় না একজন কবি সচেতন না   হলে এমন নির্মাণ ও সৃষ্টি কৌশল রপ্ত করলেন ! একটি চেতন কাঠামো রয়েছে, যা তাকে ‘প্রত্যন্ত’ থেকে ‘অত্যন্ত’ সমসাময়িক এবং বিশ্বনাগরিক করে তুলেছে । এটা আড়ালে বা বিচ্ছিন্ন থাকা কোনও কবির পক্ষে কখনও সম্ভব নয় । তিনি অজ্ঞাতবাসে থাকতেই পারেন, কিন্তু নিভৃতে জগতের সমস্ত চলাচলের সঙ্গেই নিজেকে সম্পৃক্ত রেখেই নিজেকে লেখাকে আপডেট রেখেছেন, লেখনশৈলী থেকেই তা পরিষ্কার বোঝা যায় এ কবিতার গায়ে কোনও প্রভাব নেই ।
     পাঠক হিসাবে উৎপল দের কবিতা তাই আমার কাছে গভীর এবং আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে । তিনি যখন লিখছেন,  
      ‘তার ছায়া / ফ্লুরোসেন্ট হয়ে বর্শা বিঁধেছে । চাঁদ খুলে আসে...’
এটি কোনও প্রথাগত বা মূলধারার চলন নয় । বা যখন লিখছেন, ‘নাকের  দুপাশ বেয়ে লাটাইয়ের টানটান ঘুম ...’  পড়তে পড়তে অভূত রহস্যের ব্যঞ্জনায় অভিভূত হয়ে চুপ করে থাকি । এর কোনও তুলনা হয় না । 
      একজন কবিকে চেনা যায় এভাবে তাঁর ভাষা দিয়ে । অধিকাংশ কবিতাই হয়তো আরও মনোনিবেশ দাবি করেছিল, তাহলে বোধকরি আরও মসৃণ হয়ে উঠতে পারত, তবু এক একটা পংক্তি বিদ্যুতের ঝলকের মত । যেমন তিনি যখন লিখছেন,
             ‘... ... নিরুদ্দেশ  ছাপা হলে ঘর কি ফিরেছে !
                  প্রতিদিন চোখের আড়াল ভেসে ওঠে’ ( পৃষ্ঠা : ১২ )
এটা সময়ের ভাষাকে অগ্রবর্তী রেখেই এগিয়ে চলা । আবার যখন ‘ফয়সলা কাঁধ বেয়ে পিরামিড হয়   দেখি শুধু ক্ষেত্রফল নয়, পুরো পরিসরটাই বড় হতে থাকে । অনন্য । একেবারে ইমেজ ঘুরিয়ে নতুন ভাবনায় উপুড় করে দেওয়া ।  
     ক্রমশ যেন কথারা আর কথা থাকে না । নির্বাক রাত ঝুলে পড়ে টঙের উপর কম্পাস হয়ে ।‘টঙ’ শব্দটির ব্যবহার খুব টানল । এক ঝলক গ্রামকে চেনা যায় । নাগরিক পাঠকদের কাছে এটি নতুনের আভাস হতে পারে ।
    উৎপল দের কবিতায় আবেগের সংযম, ক্রিয়াপদের সংযম আমাকে ভাঁজ খুলে সচেতন পাঠের দিকে তাড়িত করে । বাংলা কথন ভাষায় আন্তর্জাতিক হয়ে উঠেছে সে খেয়াল অনেকেরই থাকে না, বরং জীবনানন্দ-অনুসারী ভাষায় গতানুগতিকতাকে আজও পুষ্ট করে চলেছেন অধিকাংশ কবি, তিনি সেখানে অতিক্রমের মন্ত্র ঠিক অর্জন করে নিয়েছেন । এই যে,                    
            ‘... ... ... জানলার ভিড় করা ফিসফিস 
        জঙ্গল খেলতে খেলতে ফুলঝুরি করে ফেলে গাঁ ।’  ( পৃষ্ঠা : ১৭ )
এ ভাষা জীবনানন্দের নয় । পঞ্চাশ, ষাট, বা সত্তর দশকের নয় । এ ভাষায় রয়েছে সম্প্রসারিত চেতনার প্রভাব । অতি চেতনার প্রবল টান । এটাই সেই ‘মন্ত্র’ যা সমাজ এবং কবিতার দায় প্রকাশ করতে শেখায় ।
   ‘পারাপার’ কবিতাটিও অনবদ্যছাতায় ফুটে থাকা আপেলের গন্ধ, বৃষ্টির ভিজে যাওয়া শিরায় ছুটছে চুলের রহস্যের খোঁজ বা একটু অন্য ভাবে পড়লে, ফেলে  দেওয়া সিরিঞ্জ, বৃষ্টি ভেজা শিরায় ছোটা – এমন বহুমাত্রিক চিত্রকল্পতা এক একটি অসম্ভব অনুভূতির দরজা খুলে দাঁড়ায় । এসব যেন উড়ে উড়ে আসছে । আর,
                       ... ... ওড়াউড়ি  শেষ হলে
                লাটাইয়ে গুটিয়ে আসে ঠাণ্ডা কুয়োর গান ।’  
যা আমাদের কল্পনাতেই আসে নি তারা সব এক এক করে বাস্তব হয়ে উঠছে । তিনিই দেখালেন, ঋতু ফিরছে না, ডাক উঠে আসছে মাঠের ওপার থেকে ... , আর একজন ‘আসছি’ বলে সাড়া নিচ্ছেন, দিচ্ছেন না কিন্তু । আহা !
     একজন কবি দেখছেন, গ্রামের মাঝখান দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে ‘শূর্পণখার দুই কান’ – কি ভীষণ প্রতীকি ! আশ্চর্য হতে হয় আঙুলের ঘাম ফুলে ওঠে । আরও আশ্চর্য হতে হয় ‘মিলন’ কবিতায় যে আবহ তৈরি করা হয়েছে সেখানে ঐ বিনোদিনী, কুঞ্জবিহারীরা শুধু এক একটি নাম মাত্র, ঘনঘটা হচ্ছে এই আত্মায়, যমুনার উথালপাথাল জলকে দিচ্ছে বাস্তবিক হাহাকার । ‘সখীদের হাহাকারে পূর্ণতা ঝাঁপ দেয় জলে ।’ 
    এভাবে একের পর এক আচ্ছন্নতা ভেঙে নতুন নতুন ছবি ফুটছে, অবাস্তবের বাস্তবতা গুলো খুলে দিচ্ছে অচেনা জগৎ । আমরা যেন ঝরে পড়া অশোকফুলে ভালবাসায় বনবাস বুঝতে না বুঝতে জলের নূপুর আর বাঁকানো সানাই থেকে ধ্বনির মহড়া শুনতে পাচ্ছি । দুলে উঠছে সমস্ত মিথগুলো ডি-মিথ হয়ে ।
     এ খেলাটা মূলত শব্দ নিয়ে । শব্দ দিয়ে ছবির অন্তরের বোধকেই বেশি বেশি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা । বোধের আঁচলে বাঁধা পড়ে সারি সারি প্রণাম । ভাসানের রাতে গলুইয়ের গান সুতোয় বাঁধা বৃষ্টি হয়ে যায় । আসলে কোনও বাঁধনই বাঁধা নয়, মুক্ত করে তোলা । ঘুমঘোর কেটে যায় যখন ঈশ্বরের পায়ের তলায় তিনটি বেড়াল আড়মোড়া ভাঙে ।
    ‘শূর্পণখার দুই কান’ আরও একবার ব্যবহৃত হয়েছে ‘চক্র’ কবিতায় । ওখানে গড়িয়ে নেমেছিল গ্রামের মাঝখান দিয়ে, এখানেও অশোকস্তম্ভের চক্রটিকে সামনে রেখে কিছুটা গড়ানো ভাব এবং শেষে কেল্লা আগলানো । ভাবনার পার্থক্য ও বোধের তারতম্য রয়েছে । হয়তো পুরোটা গভীরে নামতে পারছি না, তবে চক্রের থেকে চক্রীদের বুঝে নিতে অসুবিধা হল না । মনটা আবিস্কারের আনন্দে দুলে উঠল । তারপরই নিরুদ্দেশ হতে হতে মাটির ত্রিফলায় বিদ্ধ হয়ে গেলাম । ‘কফিন’এও পেরেক পড়ার আগে ‘ফাঁকা হাঁড়ির শব্দে ফুটে ওঠে দিন’  
      অভিপ্রায় কখনও বিমুখ হতে পারে না, আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় শব্দ থেকে অক্ষর, অক্ষর থেকে ধ্বনির এক একটি বর্ণচ্ছটা, আমাদের জাগ্রত করে, যা ছিল বধির, সে-ই সরব  হয়ে ওঠে । যখন পড়ছি একটা গোটা আকাশ, তখন তার অর্ধেক জুড়ে –
        ‘তোমার  ইশারায় গান বেয়ে আসে – যতিহীন 
       ধনুকে বিদ্ধ কাপুরুষ আমি, শ্রুতিহীন থাকি ।’  ( পৃষ্ঠা : ৫০ )
     এভাবে চলার পথে অশ্রুত অনেক ধ্বনিই আমাদের কানে সুর হয়ে বাজে । ‘সাপ-বাঁশি থেকে নির্গত হয়ে ‘রূপোগাছ’ কে জড়িয়ে ধরে । তাহলে আমরাই প্রশ্ন করতে পারি – এ জীবন তাহলে কি শুধুই সাপলুডো খেলা ?
    জীবনটা আরও অনেকরকম । বেহালায় কেঁদে ওঠা একবুক জল ও আকাশ যেমন অনেকেই দেখতে পায় না, তেমনি এই বেড়ে ওঠা দিন ও কাল, দুপাশের হাই তোলা ভিড়, ভাঙা কলসির ফুল-বাতাসা-খই ও দাঁড়ের ছলনা, কিছুই উপেক্ষার নয় ।
     মাঝে মাঝে মনে হয় রাজনীতিটা ঠিক ঠিক বুঝে গেল সবাই, কিন্তু কবিতার কাছে এসে শুধু পেছন পানে চাওয়া । এই কারণে পুড়ছি, দগ্ধ হচ্ছি, আবার যখন দেখি ‘আমোদিনী হেসে ওঠে খিল খিল’  ভাবতেই মনের কোনে একটা আহ্লাদ ফুরফুর করে ওঠে, অর্ধেক শরীরে অবুঝ, বাকি অর্ধেকে গারস্থ্য কল্যাণ, কাঠের এসরাজে বেজে উঠছে সে ।
    ‘মধুমাস ও পোকাজীবন’ পর্বের আটটি কবিতা ধরে নেওয়া যাক লেখালিখি জীবনের শুরুর দিকে । কিন্তু কত বলিষ্ঠ ছিল সেইসব দিন । এই লেখাগুলো না থাকলে একজন কবির শুরুর দিনগুলোকে বোঝা যেত না । অসংখ্য ধন্যবাদ । এই যে নিজেকে ভেতরে ভেতরে তৈরি করে নেওয়া, আর ক্রমশ একজন স্রষ্টার পুনর্জন্ম, তিনিই তো দেখতে পান –
        ... ‘হেসে ওঠে উদাসীন আর তার স্নেহ ।’...   ( পৃষ্ঠা : ৫৭ )

     ‘মরমী দুঃখই কবিতা জননী’ – এ তার প্রকৃষ্ট চিত্রাবলী । দৃশ্য এবং ঘটনা যখন একজন কবির ভেতর সত্ত্বায় জারিত হতে থাকে, তখন কল্পনায় আরও কিছু ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া  ঘটায় । কবিকে আরও নতুন কিছু নির্দেশ দেয়, যা ঐ ঘটনার উৎসে ছিল । এবং ভবিষ্যতে এমন কিছু ঘটতে পারে । একজন কবি এভাবেই অতীত, বর্তমান এবং ভবিষৎকে একটি মালায় গাঁথতে থাকেন । সৃষ্টি সময়কে অতিক্রম কালান্তরের দিকে পা বাড়ায় । 
     এই যে এখানে ‘বুদবুদ ভেঙে তুমুল বৃষ্টি’ – এর মধ্যে আমাদের প্রত্যেকের শৈশব আছে, কৈশোর আছে, আমরা অনেকেই দেখাকে প্রসারিত করতে পারি না । পৃথিবীটা তাই অচেনাই পড়ে থাকে । অথচ চোখ মেললেই দেখা যায় –
           ‘দু-দুটো রেনট্রির ফাঁকে এনামেল চাঁদ গড়িয়ে নামছে ।’ 
   
   ‘সাঁতার’ একটি অসামান্য মানচিত্রকে তুলে ধরা । আজও সেই সময় একটুও বদলায় নি । ‘কুঠির বাগান’ বললে একটা ছবি ভেসে ওঠে, একটা ইতিহাস, একটা সমাজ, কৃষকদের উপর নীলকর সাহেবদের সেই অকথ্য অত্যাচার কুঠিগুলো রয়ে গেছে পোড়ো হয়ে । সেখান থেকে আরও দূর এই বর্তমান । অসামাজিক দৌরাত্ব্য । ‘চাঁদ এসে লাট খেয়ে পড়ে...  শেষ ট্রেনে বাড়ি ফেরা রোজ ।’ 
     এরপরও রাজনীতি, বিপ্লব, সমাজ বদলে ফেলার স্বপ্নগুলো । রাতের হুল্লোড় দিনের গায়ে এসে লাগে । বাঁশবন ভেঙে কখনও জীবন, কখনও একটু স্বাধীনতা । সাদা ও কালো সব মাখামাখি । সাঁতার কোথায় ! আজও ডুবি আর ভাসি ।


_____________________________________________________________
ঘষা কাচের প্রলাপ – উৎপল দে । প্রকাশক – পাঠক । প্রচ্ছদ – দেবাশিস সাহা । মূল্য – ৮০ টাকা ।

No comments:

Post a Comment