‘শব্দ এক ভালোবাসা,শব্দ এক অনন্ত নরক
‘কে বাঁচায় কে বাঁচে’ গল্পে মৃত্যুঞ্জয়কে আমাদের উত্তরাধুনিক পৃথিবীর ভোগবাদ সহজেই না বলে দেবে। আফিসের কেরানি,মাস-মাইনে পাওয়া মৃত্যুঞ্জয় মৃত্যুকে দেখেছিল খুব সামনে থেকে। অনেকেই দেখে। কিন্তু সেই মৃত্যু
মৃত্যুঞ্জয়ের মধ্যে যে সংকটের জন্ম দেয়,তার
উত্তরাধিকার বোধহয় ভবিষ্যত্ পৃথিবীতে খুব বেশি জন্ম নেয়নি। তাই অফিসে এসে তার
বমি হয়,ঘেন্নার নয়, সহানুভূতির বমি, অপরাধবোধের বমি। বন্ধু নিখিলের সঙ্গে
জমে ওঠে প্রতর্ক। নিখিল
বোঝাতে চায়, যেমন শিশু চারাগাছকে আগলায় তার মা। তবু মৃত্যুঞ্জয়ের
মধ্যে ঘনীভূত সহমর্মিতার বোধ প্রতিবাদ হয়েই বেরিয়ে আসে। দুনিয়া তাকে পাগল
ঠাওরায়। তবু
নিজেকে মেনে,সমাজকে মেনে মৃত্যুঞ্জয়কে পাগল হতে
হয়।
এই বাংলা কবিতাবইয়ের সম্পর্কে
দু-কথা বলতে গিয়ে কেন মানিকের এই গল্পটি দিয়ে ভূমিকা করলাম, তার কারণও এই মৃত্যুঞ্জয়। যে কণ্ঠ সন্দীপন চক্রবর্তীর সাম্প্রতিক বই ‘শরণার্থী শব্দদল’-এ উঠে এসেছে,
সে কণ্ঠ নিয়ে পাঠকমহলে দুবিধা আছে। তবু সন্দীপন সেই পথে হেঁটেছেন। এখন এই বইটির আলোচনা
বা পাঠ-অনুভূতি এভাবেও শুরু করা যায়, যেন
আমি শুধু এই বইটিই পড়েছি এবং আমার আলোচনা এই বইয়ের পরিসরেই আবদ্ধ থাকবে। কিন্তু সে পথে এগোতে
চাইনা এ কারণে, তার লেখালিখিকে ধারাবাহিক লক্ষ্য
করে একটি বিষয় পরিষ্কার ধরতে পারা যায়, কবিতার আবহমানতাকে
মান্য করেও কিন্তু সন্দীপন তাঁর পরিবেশ-প্রতিবেশ-পরিস্থিতির প্রতি সদা জাগরূক। সমকালীনতাকে বাঁকা
চোখে দেখার রেওয়াজ আছে বাংলা কবিতামহলে। এবং যখন কোনও কবি তাঁর সামাজিক সত্তাকে সামনে এনে
লেখেন তখন খুব সহজেই পাঠকপরিধির একটা অংশ তাকে কবির সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা হিসেবে
দেখেন। এমন
বই যাতে কবি তাঁর সমসময়ের অবস্থানকে কাউন্টার করে প্রতিষ্ঠা পাবেন সামাজিক জীব
হিসেবে। এর
বেশি কিছু না।
সন্দীপনের সেই ভয়টা নেই। সন্দীপনের কাব্যভাস
চাইলেই আবহমান বাংলা কবিতার সুমহান রম্য-আধুনিক বিষাদকে জড়িয়েই ডুগডুগি বাজাতে পারত। সত্যি বলতে কী, ডুগডুগি বাজাতে বাজাতে কবিতা খুব মন্দ লেখা হয় নি। কিন্তু এর পাশে যদি
কবি সজাগ থাকতে চান। সজাগ
না থেকে যদি তার উপায় না থাকে, তাহলে তিনি
নিশ্চয়ই সন্দীপনের মতোই কোনও পথ বেছে নেবেন। নব্বইয়ের বাজার
অর্থনীতি এবং তার প্রভাবে ধ্বস্ত হয়ে যাওয়া সামাজিক,রাজনৈতিক বোধের বা বোধ-হীনতার মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে মানুষগুলো কেমনভাবে
নড়ে-চড়ে কথা বলে, সন্দীপন তাকে লক্ষ্য করতে ভালবাসেন। বরং বলা ভালো
মৃত্যুঞ্জয়ের মতোই নিজেকে বিলুপ্ত করে সমসময়ের বিগ ব্যাং-এ প্রবেশ করা ছাড়া তার আর
কোনও উপায় থাকে না। এটাই
সন্দীপনের কবিজীবনের অন্যতম মুসাবিদা। অবশ্য এমন নয় সন্দীপন শুধু এই মাঠেই খেলতে ভালবাসেন। তবু তার চয়েসের
দূরদর্শিতা তাকে ভাবতে বাধ্য করে এইভাবে। মূল্যবোধহীন যে সুবিধেবাদের অমোঘ পরিসরে বাস করছি
আমরা, যেখানে সত্য গুলিয়ে যায় কিংবা মিথ্যা ব্যবহৃত হতে হতে, উপস্থাপিত হতে হতে সত্যে রূপ নিয়ে নেয়। আমরা সেই রূপকে গ্রহণ করে অশ্লীল
আনন্দে মেতে উঠি। কেননা
আজকের নীতিহীন অনন্ত সুবিধেবাদের অংশীদার কোনও রাজনৈতিক পার্টি বা ব্যাক্তি নয়, স্বয়ং মানুষ। প্রচ্ছন্ন সমর্থনে তার আদর্শবাদী কুম্ভীরশ্রু আজ
সোশাল মিডিয়ার ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নিবেদিত। সন্দীপন জানেন, তিনিও অসহায়ভাবে এই পৃথিবীরই বাধ্য অংশীদার। বিশ্বায়নিক পৃথিবীতে
তার সত্তাও পারিবারিক ও কর্মীজীবনের পেশাইতে ছাতু হতে হতে নিষ্প্রাণ চ্যাপ্টা। তাই
কখনো তত্ত্বকথা না আউরে, একেবারে সরাসরি কবিতায়
উঠে আসতে থাকে মাছি মারা কেরানীর প্রতিদিনের ছোট হয়ে যাওয়ার ইতিহাস :
আগুন লেগেছে ঘরে, অথচ চিত্কার করা বারণ এখন
এখন অন্ধকার বুকের উপরে ভারী বুট
এখন বিরুদ্ধতাও বিক্রিযোগ্য, ধর্ষণও উপভোগময়
এখন বিবেক সাজা বুদ্ধিজীবীর দল
লোলচর্ম বেশ্যার হাসি
এখন ঝড়ের মতো থমথমে চারিদিক,ভয়ের বলয়
এখন ক্ষমতা মানে লোভ আর দাপটের
ভাষা
এখন মানচিত্র মানে ঘেয় কুকুরের
দাঁত জাগে সারি সারি
এখন ধর্মের নামে আমায় নিলামে তুলে
নিয়ে
শুঁড়িপথ বেয়ে আহা বুকে হহেঁটে আসে
ওরা বীভত্স রঙিন
এখনও গলায় যদি রক্ত না ওঠে আমাদের
আমরা বেজন্মা সব। শিরদাঁড়াহীন
আর সেই ইতিহাসে তেমন কাব্যিকতা
থাকে না, তাই সন্দীপনের ভাষা হয়ে পড়ে সরাসরি। সময়ের ডকুমেন্ট্রি
কাব্যের আচ্ছাদনে ফিরে ফিরে আসে। ঠিক এখানে থমকেই আমি ফের লেখার প্রথমে ফিরে যাব, যেখানে এই প্রশ্ন তুলেছিলাম আমি যে, সন্দীপন কী
কারণে এই ভাষ বেছে নিলেন, যার মধ্যে অকারণ তির্যকতা নেই, নেই চোখ-ধাঁধানো কোনও ইমেজ। বক্তব্য, সেও
তো ন্যায়-অন্যায়ের পরিধি মেনে, জীবনাচরণের গ্রন্থি পেরিয়ে
অনেক অনেকদিন আগে থেকেই ফ্লোয়িত। সন্দীপন আলাদা কোথায়? এর উত্তরে যেটুকু বলার তা হল, নব্বই পরবর্তী সময়ে
মানবিকতার যে বিপুল পরিবর্তন হল জীবনকে দেখার ভঙ্গির মধ্যে চলে এল হরেক রকমফের, সেখানে অবস্থান তৈরি করে কেরানীর উত্তরাধুনিক প্রস্থানভূমি। সন্দীপন চক্রবর্তীর এ
কবিতার বইতে শঙ্খ ঘোষ আছেন, ট্রাডিশন হয়ে, কিন্তু সেই ট্রাডিশনকে মেনেও সন্দীপন আলাদা তার সময়ের কশেরুকায়। যিনি লিখবেন, শঙ্খ ঘোষের কবিতা তাকে বাঁচতে শেখায়, আবার সেই তিনি
আক্ষেপের মৃদু গুঞ্জনে বলেওঠে :
কিছুই বোঝে না ওরা, হাসাহাসি করে শুধু। কখনও ভেবেছ
একটি সোমত্থ ছেলে ভাষার ভিতরে কেন
রক্তবমি করে?
কেন সে একান্ত এক ভূতগ্রস্ত অন্ধকারে আচারিপিছারি খায় একা ?
আছে কি এইসমস্ত অস্বস্তির কোনও
যুক্তিসংগত উত্তর? আছে তো বটেই। কিন্তু দিচ্ছে কে!প্রতিটিই
প্রশ্নই দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে প্রশ্নের আকারে। সন্দীপন নিজেই তাঁর
সুসম্পাদিত ‘পাঠকই কবিতা’
নামের প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিনের তৃতীয় সংখ্যার একটি আলোচনার ‘কৈফিয়ত’ অংশে শ্রীজাত-র কবিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে যে
কথাগুলি লিখেছিলেন, সে গুলি তাঁর নিজের কথাও, নিজের চিন্তাও। সন্দীপন লিখছেন “ এই একঘেয়ে, বোরিং, ক্লান্তিকর জীবনের সবকিছুই আস্তে
আস্তে হয়ে উঠছে নিছক অভ্যাস।খাচ্ছি,গিলছি,ভাবছি। এমনকি
লিখতে লিখতে লিখতে লিখতে দাঁড়িয়ে গেছে অভ্যাসে।নতুন কোনো শব্দই আর ভরসাযোগ্য
হচ্ছে না। কিন্তু কিসের ভরসা?কার কাছে ভরসা?চশমা চোখে ওপরচালাক, কার কাছে আর ঠোকাবে সে?.....তার চেয়ে বরং এই ভালো। এই ধান্দার ভিতর মুখ লুকিয়ে গুঁজে থাকা। এখন বরং
খেলতে শেখা শয়তানিরঙ সাপলুডো, কেমন করে দেখাতে হয় থুতুর
সঙ্গে রক্তপাত। দেখানো এই চেহারাকেই তো লোকে আমার আসল চেহারা বলে ভাবে। সেটা আমি
নিজেই বেশ ভালো করে জানি। যদিও ভেতর ভেতর
ড্রিলার চলছে,বাইরে তবু আপ্লুত। একেই বলে বাঁচা। সত্যি কি বাঁচা?নাকি জ্যান্ত লাশ?”। এই কথাগুলির অর্থ নিশ্চয়ই আমাদের বুঝিয়ে বলতে হবে
না। যে
অন্তর্গত রক্তপাত আমাদের ক্লান্ত করে, সেই
তো এইসব অনুভবের মায়াঞ্জন চোখে পড়িয়ে দেয়। কিন্তু পড়িয়ে দিয়েও
কিছু হয় কি? যে অমোঘ চাহিদা, নীতিহীন রাজনৈতিক লাম্পট্য, আনুগত্যের সুবিধেবাদ
মধ্যবিত্তকে ঘিরে-পেচিয়ে ধরেছে, বা আমরাই স্বেচ্ছায় তাকে
জীবনপ্রণালীর অন্তর্গত করেছি। আপাত ভোগের অপরিমিত ইচ্ছেয় আঙুলগুলো লকলক করে উঠছে
রিভলভিঙ চেয়ার দেখে। ভারতবর্ষ
চালায় কর্পোরেটে। আর
বাঙালি, সে টিপে টিপে মুড়ি-বাতাসা খায়, ইংরিজি না বলতে
পারলে হাফ-স্ট্রোক হয় তার। ভেতরে জকি-র জাঙ্গিয়া পরে বিশ্বায়ন উদযাপন করে সে। কম্যুনিজম সামলাতে না
পেরে সমনমব্যুলিজমকে নিও-কম্যুনিজম আক্ষা দেয়। একটি উগ্র রাজনৈতিক
দলের আধিপত্য নাশ করতে চাওয়ার রোমান্তিক-মর্মান্তিক বাসনায় অপর একটি উগ্র রাজনৈতিক
দলকে ওয়াকওভার দেওয়ার ভাবনায় অবিচল থাকে। এই বাঙালি চেয়ারের তলায়, আধুনিকতা, উত্তরাধুনিকতার সংকট থেকে বহু দূরে
নিদ্রামগ্ন। তারা
কিভাবে অসহায়-মর্মাহত-লড়াকু-দেওয়ালে পিঠ থেকে যাওয়া সন্দীপনের লেখা পড়বেন, আমি জানি না। নিরাভরণ সত্যি বড় ভয়ানক যে। তবু যদি ভাষার আড়াল, চিত্রকল্পের আড়াল তাকে বিমূর্ত করে, স্পষ্টতার অভাব
তাকে নিয়ে কল্পনাবিলাস করবার সুযোগ দেয়। আমি আমার মতো করে বুঝেছি—এ হেন
পাঠ-প্রতিক্রিয়া গড়ে ওঠবার তুমুল সম্ভাবনা থাকে। শরণার্থী শব্দদল—সেই
সাংকেতিকতা থেকে মুক্ত।
তাহলে কি ভাষার কূটত্ব সরিয়ে
রাখতে চাইছেন সন্দীপন? একেবারেই না। বইটির
পাঠ আমাদের সুনিশ্চিত করে কবি বিশেষ অভিপ্রায়ে সাজিয়েছেন পাণ্ডুলিপি। যা সহৃদয় সামাজিক
থেকে আত্মস্থ কোনও ধী-জগতের দিকে নিয়ে যায়। যেন একজন সংবেদনশীল নিজের চারপাশের
অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক অধপপাত দেখতে দেখতে ক্লান্ত এবং রাগী। সেই নিয়ন্ত্রিত রাগ
বেরিয়ে এসেছে শুরুর কবিতাগুলিতে। কবি তার অভিমুখ সুনিশ্চিত করেছেন পাঠকের দিকে। এবং পাঠক যখন কবির
জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে শুধু করছেন, তখন
সন্দীপন যেতে শুরু করলেন গহণে। আরও গহণে। তখন পাঠক তার প্রতিবেশী। তার গহনের
ঠার-ঠোর-ইঙ্গিত সবই বুঝতে পারবেন। বুঝতে পারবেন, আরও
একটি প্রোপাগাণ্ডাধর্মী বই উপহার দেওয়া কবির উদ্দেশ্য নয়। কবি যে দহনের কথা
বলেন, তা সামাজিক হয়েও ভীষণ ব্যক্তিক। মুশকিল এইটাই, বা সমাজতাত্তিক পরিবর্তন এইটাই, স্বাধীনতার পর
পর্যন্ত যখন কোনও কবি পাঠকের আর্থ-সামাজিক সংকট ও তার আত্মসংকটের কথা লিখেছেন, পাঠক সেখানে একাত্ম হয়েছে। কিন্তু সন্দীপন যে সময়ে লিখছেন, সে সময়ে রাজনীতি তার আদর্শ, তত্ত্ব্ভাবনা, চেতনা, দর্শন, সম্পূর্ণরূপে
হারিয়েছে। আরও
স্পষ্টভাবে বললে, প্রতিক্রিয়াশীল ও
বামপন্থার লড়াইয়ে নীতি ও নীতিহীনতার ভেদ ছিল খুব স্পষ্ট। আজ আর সেই ভেদ কোথায়? রাজনৈতিক দলের কর্মপন্থার মধ্যে যে সুনিশ্চিত পার্থক্য ও দূরত্ব থাকা অবশ্যম্ভাবী ছিল এমনকি আটের দশকের শুরুতে, সেই তলানিটুকুও যে রইল না নয়ের দশকে এসে। অবক্ষয়ী বামপন্থা জন্ম দিল
দিশেহারা রাজনীতি ও দর্শনহীনতার। জন্ম দিল উপভোগ-সর্বস্ব উন্মাদনার। এই গণ-হিস্টিরিয়ার
যুগে, এই মেগানম্যালিয়াক কেতায় আর পাঠক কিভাবেই বা কোণঠাসা হয়ে পড়া একটা ভাষায়
সেই অনুভূতির সঙ্গে সংযোগস্থাপন করবেন, যার দিন গিয়াছে?
বিশ্বায়নের অন্যতম প্রবক্তা থমাস
ফ্রিডম্যান তাঁর লেখায় দাবি করেছেন,
গ্লোবালাইজেশন কোনও প্রপঞ্চ নয়, আজকের দিনে এটি একটি সর্বব্যাপী
আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা যা বিশ্বের প্রায় সব দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক
সম্পর্ককে প্রভাবিত করেছে। এটাই সত্য যে, অনেক
প্রান্তিক মানুষ তাঁরা হয়ত বুঝতে পারেন না, কোন অদৃশ্য সুতোয়
তারা দুলছেন এই অতিবাণিজ্যিক মুক্ত অর্থনীতির চক্করে। তাই ফ্রিডম্যান যখন
সোচ্চারভাবে ঘোষণা করেন, দ্য ওয়ার্ল্ড ইস ফ্ল্যাট। তখন আরেক সমাজতাত্তিক
জোসেফ স্ট্রিগ্লিথ খুব জোরের সঙ্গেই ফ্রিডম্যানের বিরোধিতা করে বলেন, পুরো দুনিয়ার একসঙ্গে ফ্ল্যাট হওয়া সম্ভব নয়, কেননা
দুনিয়ায় অনেক বৈষম্য আছে। এবং সেই বৈষম্য এতই প্রান্তিক এতই প্রকাশ্য যে তাকে
অস্বীকার করে নিজের অন্ধত্ব প্রমাণিত করা চূড়ান্ত অপদার্থতার বিষয়। কেমন অন্ধত্ব ঠিক? আসুন, সন্দীপনের একটি কবিতা পড়া যাক :
স্মৃতিফলকের মতো জেগে আছে
সারি-সারি ক্লান্ত বহুতল
তার পেটে বসে এক বিষণ্ণ জোকার
দেখছে—পাখির খোঁজে উড়ে যাচ্ছে
খাঁচা
ভাষার ভিতরে বাঁচা মানচিত্র ছিঁড়ে
খাচ্ছে
অযোনিসম্ভূত এই গর্ভফুল মিশে
যাচ্ছে অন্নের আঠায়
অগ্নিজল গলে গিয়ে সাদা সাদা হাড়ের
পাহাড়
ভাষার ফাটল বেয়ে নেমে আসছে ঘুমন্ত
শহরে—
আর তার পেটে বসে কোনো এক বিষণ্ণ
জোকার
লিখে রাখছে নিরুপায় অসহ্য উজ্জ্বল
ওই আর্ত হাসিগুলো
এই কবিতা বিশ্বায়নের দানবিক
আস্ফালনে ক্লান্ত মানুষের জোর করে জিততে চাওয়ার কথা বলে। কিন্তু জিতে যাওয়া কি
এতই সহজ। কিংবা
এভাবেও বলা যেতে পারে, হয়ত সে ভাবছে সে জিতে
গেছে, বা তাকে ভাবানো হচ্ছে। এই জয়ের নেশায় সে
অযোনিসম্ভূত। তবু
একসময় ভাষার গর্ভে সে পুনর্বার ত্রাণ পেতে পেতে সেই হাসিগুলো লিখে রাখে, যাদের দেখে মেট্রোপলিটন মনের মনে হয়েছিল আর্ত,অপসৃয়মান। আহত সেই জোকার হারিয়ে
যাওয়া এই গ্লোবাল ইকনমির বাজারে ক্রমশ বুঝতে পারে
মানুষ আঘাত পেলে পায়চারি করা এক
গাছ হয়ে যায়
শিকড়ে অসহ্য জ্বালা,তবু তাকে উপড়ে নেওয়া যায় না কখনো
লক্ষ্য করুন পাঠক, সন্দীপন কী মর্মান্তিক সত্যিকে প্রকাশ্য করেছেন। মানুষ গাছে রূপান্তরিত
হচ্ছে। ইচ্ছে
হচ্ছে শেকড় উপড়ে ফেলতে,কিন্তু পারছে না। কেননা যতই নিকৃষ্ট
হোক, আদপে তো সেটা তার নিজেরই। তবে এই মেটামরফোসিস কিন্তু মানুষ থেকে পোকা হওয়া নয়, মানুষ থেকে গাছ হওয়ার। ফিরতে চাইছেন কথক,কোথায়? শিকড়ে?
ভাষা মাটি। মাটি ভাষা। পুড়িয়ে বাসন করি,খাইদাই,লিখি—
না-পোড়ালে কাঁচা মাটি জল দিয়ে
মাখি আর প্রতিমা বানাই
ফলাই আনাজ,খুড়ি,লাঙ্গলের মুখে যদি ওঠে গো জানকী...
সেই জোকার এখানে কৃষক। মাটি তার ভাষা, সে ভাষা একমাত্র কৃষকই বোঝে। তাকে পুড়িয়ে,দোহন করে,জল কাদা দিয়ে মেখে ভিন্ন ভিন্ন জীবন উপাচার
গড়ে ওঠে। গড়ে
ওঠে তন্ত্র। এই
কৃষক জানে, মাটি ততক্ষণ কর্ষণ করে যেতে হবে, যতক্ষণ না লাঙ্গলের ফলায় জানকী উঠে আসে। সন্দীপনও জানেন, এই জগাখিচুড়ি সময়ে পুরাণপ্রতিমার কাছে আশ্রয় নিলেই তবে ভরন্ত বৃষ্টির
পেটে জেগে উঠবে আলপথ। শব্দখনি। ধান। তখন উপযুক্ত পুরুষের মতই তাকে ধারণ করে রাখতে হবে
মাটি,কিংবা মাটি হয়েই ত্রাণ দিতে হবে ভাষাকে।
সমস্ত বইটি পড়ে উঠে আবার বইয়ের
ব্লার্বে চোখ গেলো। বুঝলাম আবার, বই পড়বার আগে পড়া
ও বই পড়বার পরে পড়া, এই দুইয়ের মাঝখানে একটা সূক্ষ্ম সাঁকো
আছে। সূক্ষ্ম,কিন্তু পলগা নয়। সেই সেতু বিশ্বাসের। কী লেখা রয়েছে সেখানে?
“মাথার ওপর অগণন নক্ষত্র,মেঘ। নিচে পতঙ্গকুলের
অস্থির ছায়া। চারপাশে দমচাপা ব্যবস্থা। ছিন্ন মুন্ড,কাটা
জিভ,বারান্দায় রক্তমাখা ফুসফুস টাঙ্গানো। অসহায় মানুষের একক
বিচরণ এইসব দৃশ্যে,...এই কবিতাগুলিতে
অসহায়তার চরম বিন্দু থেকে পরিত্রাণের শেষ চেষ্টা লিপিবদ্ধ হয়েছে। ‘’
কে লিখেছেন? স্বয়ং সন্দীপন, না অন্য কেউ?
জানি না আমরা। শুধু এইটুকু জানি তার
একান্ত ঘরের দেওয়ালে নির্ঘাত সাঁটা আছে এই কথা : ‘শব্দ এক ভালোবাসা,শব্দ এক অনন্ত নরক’।
No comments:
Post a Comment