আগের সংখ্যাগুলি

Saturday, April 13, 2019

মর্মযাতনায় ভরা দিনরাত্রির কাহিনি - নাহার তৃণা





মদ্র দেশের নিঃসন্তান রাজা-রানী, অশ্বপতি এবং মালবী সন্তানের আশায় সূর্যের অধিষ্ঠাত্রী দেবী সাবিত্রীর নামে পুজো দিয়ে এক কন্যা সন্তান লাভ করেন দেবীর প্রতি সম্মান জানিয়ে মেয়ের নামকরণ হয় 'সাবিত্রী' কালক্রমে সেই মেয়ে নিজের সতীত্বের বিশাল ব্যাপক নজির রাখেন যেকারণে হিন্দু পুরাণে তিনি 'সতী সাবিত্রী' হিসেবে খ্যাত হাসান আজিজুল হকের দ্বিতীয় উপন্যাস "সাবিত্রী উপাখ্যান" এর কেন্দ্রিয় চরিত্র সাবিত্রী'র নামকরণ সেই দেবী কিংবা রাজকন্যার নামানুসারে হয়েছিল কিনা জানা নেই তবে সূর্যের আলো কিংবা তথাকথিত সতীত্বের  অহংকারের ঠিক বিপরীতে চরিত্রটির নির্জীব অবস্হান এই অবস্হান নিয়তি নির্ধারিত ছিল না কিছু পশুর অধম মানুষ আর বিকলাঙ্গ সমাজ সাবিত্রীর পরিণতির জন্য দায়ী যে কারণে, পরবর্তীতে আলোহীনতার মাঝে সাবিত্রীর স্বস্তি খুঁজে ফেরা বিকারগ্রস্হ হয়ে মৃতপ্রায় একটা কিশোরী জীবন টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া মর্মান্তিক বার্ধ্যকের দিকে(পঁচাশি বছর বেঁচে ছিলেন সাবিত্রী)

"সাবিত্রী উপাখ্যান" হাসান আজিজুল হকের মনগড়া কাহিনির ভিত্তিতে রচিত উপন্যাস না বিংশ শতকের গোড়ার দিকে রাঢ় বাংলার শ্রীকৃষ্ণপুরের সাবিত্রী নামের এক কিশোরীকে সদলবলে অপহরণ এবং সম্মিলিত ধর্ষণের পর তাকে অপরাধী দলের পাপীষ্ঠ সবুরের উপর ছেড়ে দিয়ে অন্যরা সরে পড়ে নিরাপত্তার কারণে এরপর তাকে নিয়ে সবুর শুরু করে ভ্রাম্য জীবন ভ্রমণকালীন সময়ে সবুরের কুকর্মের সঙ্গী হয় বক ধার্মিক সৈয়দ সাহেব, সবুরের বন্ধু হুদা, হুদার আত্মীয় মওলাবখ্শ হরির লুটের জিনিসে ভোগের আনন্দ তো ভাগেও! সাবিত্রী তখন ভিন্ন কোনো সত্তার অধিকারী নয়, কেবলি মাংসের দলা যার উপর নিরন্তর চলে নেড়ি কুকুরের মত কিছু পুরুষের 'মচ্ছব' তারই পরিণতিতে একজন প্রাণবন্ত কিশোরীকে প্রায় নো ম্যান্স ল্যাণ্ডের বাসিন্দা হয়ে পরবর্তী জীবন পার করে যেতে হয় সাবিত্রীর সেসব ক্লেদাক্ত আর মর্মযাতনায় ভরা দিনরাত্রির কাহিনি নিয়ে এ উপন্যাস

 হাসান আজিজুল হকের প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস "আগুন পাখি"র ভীষণ সাদামাটা কথক নারী চরিত্রটির সময় মত প্রজ্ঞাময় বলিষ্ঠতায় উচ্ছ্বসিত- মুগ্ধ, এই পাঠক  আগ্রহ নিয়ে সেরকম কিছুর আশায় তাঁর দ্বিতীয় রচনা পাঠের পর উপাখ্যানে সাবিত্রী চরিত্রটির প্রতিবাদহীনতা এবং জীবনকে বঞ্চিত করতে দেখে  যুগপৎ ব্যথিত এবং হতাশই লেগেছে সবুর যখন তাকে স্হান থেকে স্হানান্তরে নিয়ে বেড়াচ্ছে, সেসব সময়ে সাবিত্রীর ভাবনায় যে চমক ছিল, ছিল গভীর জীবনবোধের ইশারা; জীবনের ক্ষেত্রে তার যথার্থ প্রয়োগের কোন লক্ষণই দেখা যায়নি মানছি, এক্ষেত্রে সমাজ-সংসার তাকে সঙ্গ দেয়নি সেভাবে, সময়কালটাও একটা বড় ফ্যাক্টর কিন্তু যে মানুষ নিজের উপর ঘটে যাওয়া চরম অন্যায়ে নিজেকে মৃত্যুর হাতে সঁপে না দিয়ে সাহসের সাথে ভাবতে পেরেছিল 'কেউই বাঁচা বাদ দেবে না, তাহলে সেই বা দেবে কেন?' তার সে ভাবনাকে সঙ্গী করে সে তো বাঁচার আনন্দে বেঁচে নিতে পারতো! তা সে করেনি, বরং বলা ভালো করতে দেয়া হয়নি, তাই যাপনের আগ্রহ হারিয়ে পূর্ণিমার আলোকে অচ্ছুৎ রেখেছে বাকী জীবন, নানান বিকারে হয়েছে আক্রান্ত অন্যের পাপে নিজেকে শাস্তি দেবার এই ব্যাপারটায় মন সত্যিই ভারাক্রান্ত হয়েছে

নিরন্তর ভাবনায় সাবিত্রী তার মনের ঘৃণা যথেচ্ছা উপুড় করেছে, 'পিথিমির মদ্দা কোনো শোওর যেন তার কাছে না আসে' কিন্তু ঘটনাকালে(প্রথমবার বাদে) সে প্রতিবাদহীন থেকে গেছে তার এই প্রতিবাদহীনতা ছিল পীড়াদায়ক সবুরের মণ্ডুটা আঁশবটি দিয়ে কোপ বসানোর জন্যেও সে হাড়িদিদির উপস্হিতি কামনা করেছে, স্বপ্রণোদিত হয়ে বটির সন্ধানে উন্মুখ হয়নি নারীর এহেন প্রতিবাদহীনতায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আর তার কাছে মেরুদণ্ড বন্দক রাখা পুরুষ সকল যথেচ্ছা সুযোগ নিতে থাকে সাবিত্রীকেও তাই ছাড় দেয় না সবুর বা তার পরিচিতরা

একই সুযোগে ঠুলি পরা মানুষের দ্বারা তাকে নিয়ে রচিত হয়েছে মুখরোচক গান, 'সাবিত্রীর এই যাওয়াতে ছেড়েছে পতি কী কারণে মেয়েমানুষ এমন কুকর্মে মতি' বটেই তো পতি পরম গুরু, সে যতই মেরুদণ্ডহীন হোক, দুকড়ি আয় উপার্জনের মুরোদ নাই থাকুক, নারীর জন্য তার চে' বড় সহায় আর কে হতে পারে! সহায় কেউ হয়নি সাবিত্রীর, না স্বামী, না সমাজ না পুলিশ প্রসাশন বা  বিচার ব্যবস্হা তাই এমন অপরাধের শাস্তি হিসেবে একজনেরও মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন হয়নি নানা মেয়াদের জেলবাসের শাস্তি সদ্য বিবাহিতা কিশোরী এক মেয়ের জীবনটা তছনছের মূল্য হিসেবে ধার্য হয়েছিল মাত্র সাবিত্রী অপহরণ ঘটনা নিয়ে হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষে লাশ পড়লেও তাতে সাবিত্রীর ভাগ্যের কিস্যু হেরফের হয়নি ভাইয়ের সংসারের এককোণে বাতিল হওয়া আসবাবের মতই জীবনকে বরণ করে নিতে হয়, আগুন পাখি হয়ে ওঠার মন্ত্র সাবিত্রীর জানা ছিল না!

বিংশ শতকের গোড়ায় সাবিত্রী তার ঈশ্বরের প্রতি প্রশ্ন রেখেছিল 'হায় ভগোমান পিথিমিতে মেয়ে মানুষ কেন জন্মায়!' একবিংশ শতকেও এমন আহাজারিতে পৃথিবীর বাতাস সমানভাবে ভারী হয় ক্ষমতার রাজনীতিতে ভারসাম্য রক্ষায় একজন পূর্ণিমা রানীর জায়গায় বসানো হয় নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চার সন্তানের হতভাগী জননীকে যুদ্ধ বিগ্রহ, ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াই, কিংবা ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটাতে নারী আজও দুপেয়ে সারমেয়দের লক্ষ্যবস্তু সবুরদের মতো সারমেয়রা আজীবনই পশু থেকে যায় মানুষ হতে পারেন না তাদের থাবার নীচে নারী শরীর কেবলি মাংস পিণ্ড

অত্যন্ত পছন্দের লেখকের কাছ থেকে বহুদিনের অপেক্ষার পর পাওয়া "সাবিত্রী উপাখ্যান" নিয়ে যতটা আশা ছিল, তা পুরোপুরি মিটেনি তেমন কাহিনি বর্ণনার মাঝে মাঝে এই ঘটনার সাক্ষি সবুদের ডকুমেন্টেশনের উপস্হাপনা উপভোগ্য লাগেনি মোটেও, বরং কোথাও কোথাও কাহিনি ছন্দ হারিয়ে বিরক্তি এনেছে এই উপন্যাসের সবচে' বড় অলংকার হাসান আজিজুল হকের জাদুকরী ভাষার কারুকার্য এ বইতেও তার নজির কম নেই তাঁর অনবদ্য শব্দচয়ন আর ভাষাভঙ্গির প্রতি পাঠক মন নতজানু হবে বলেই বিশ্বাস ২১৫ পাতাকে বাহুল্যই মনে হয়েছে আমার কাছে


2 comments:

  1. নাহার তৃণার পাঠপ্রতিক্রিয়া পড়লুম || স্বয়মপূর্ণ ও বলিষ্ঠ এই প্রতিক্রিয়ায় মন উৎসুক হয়ে ওঠে এবং কেন পৃষ্ঠাভারে(২১৫ পৃষ্ঠা) আলোচক এমন নাসিকাকুঞ্চিত করেন, সে জিজ্ঞাস্য থেকেই যায় || তবে, মূল বইটা হাতে পড়বার এক তুমুল ও অমোঘ আকর্ষণ নাহার সৃষ্টি কোরে তোলেন, তাঁর স্বল্প শব্দের স্বচ্ছতায় | মূল বইটা পড়ার ইচ্ছা পোষণ করি ||

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনি লেখাটি পড়েছেন জেনে আনন্দ হচ্ছে গৌতমদা। ২১৫ পৃষ্ঠা কেন হাসান আজিজুল হকের লেখা ৫০০ পৃষ্ঠাও সোনামুখ করে পড়ে নেয়া যায়। ওঁর ভাষা, লেখনভঙ্গিই পড়িয়ে নেয়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট উপাখ্যানের বর্ণনায় ঘটনার সাক্ষী সাবুদের হাজিরার মাত্রা মাঝে মধ্যেই বিরক্তের কারণ হয়েছে। আর ধর্ষণজনিত ঘটনার টানা বিবরণ সহ্যের ক্ষমতাও পাঠক হিসেবে আমার হয়ত কম- তাই বাহূল্যের কথা বলা... আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন।

      Delete