মধ্যযুগের এক সন্ধে। কাকচক্ষু নদীর শরীরে এসে পড়েছে
ফালি চাঁদের জ্যোৎস্না। দূরে নদীর বাঁকে যেখানে চোখ যায় না সেখান আকাশে ধোঁয়া
ভলকে ভলকে ওঠে। ভস্মমাখা কোনো অঘোরী কাপালিক ধূনি জ্বেলেছেন। সামনে হতভাগ্য কোনো
নববধূর মৃতদেহ শোয়ানো। মৃদু জ্যোৎস্নায় তার স্তন-বিভাজিকা চিকচিক করে। নদীর বুকে
মোচার খোলায় ভাটিয়াল সুরের মাঝি ভেসে যায়। নদীর পেটি ভরে ওঠে সাদাবালিতে।
পর্ণকুটীরে কবি কুপি জ্বেলে বসেন। তাঁর সামনে ভূর্জপত্র। এই মায়াময়তা বাংলা কবিতার
নিজস্ব উচ্চারণ। এই ভাষায় কোনও সিটি লাইটের বিচ্ছুরণ নেই। নিজস্ব কাব্যময়তার
অপসারী আলো আছে, যা পাঠককে নিজস্ব অভিমুখে অভিসারী করে। ‘বাংলা, পর্ণশবরী’ সেই
কাব্যভাষারই একটি উচ্চারণ –
“ আদ্যা যোগী পীঠে বজ্রবনিতা
ক্ষুরাকার হ্রদ। পাশে ধূম-নেভা চিতা
আঁধারে সঘন তারা ম্রিয়মান চাঁদ
আদিম জ্যোৎস্না ভরে শূন্যের ফাঁদ
বৈঠা টানছে মাঝি। অতিদূর বালি
শূন্যে গমন করে অঘোর কাপালি...”
কবি পার্থজিৎ চন্দ এই বইয়ে আঁকেননি কৃত্রিম ইয়োরোপীয়
সন্ধে, লেখেননি হ্যালোজেনের নিচে দাঁড়ানো কবির রমনী-মোহন পংক্তি। কারণ কবিতার নিজস্ব
ভাষা আসলে চির একাকী –
“সন্ধ্যে নামলেই ঘোড়ার নালের শব্দ শোনা যায়। টোডরমলের
ঘোড়া সব। আমি উন্মাদ হয়ে যাই, মদের জন্য বুক ছটফট করে, দেখি সব শেয়ালের মতো কাদের
মূর্তি যেন তালবনে ঘনিয়ে উঠছে। সুদূর গৌড় থেকে জ্বালা জ্বালা মদ আসে; গলা বুক
জ্বলিয়ে-পুড়িয়ে মদ রক্তে মিশলে আমার সমস্ত ক্রোধ ছুটে যায় শুঁড়িটির দিকে। খোচর-বেনিয়া
আর বেনিয়া-খোচর আমার দু-চোখের বিষ। আর ঘৃণা করি রামাই ঢঙ্গিকে... তার মতো
ভাঁড়েদের, যারা বিবাহের গান গেয়ে রমণীমোহন হয়ে যায়”
‘বৃহৎ বঙ্গ’ সিরিজের কবিতাগুলি লেখা হয়েছে পয়ারে। এখানে ছন্দের নিখুঁত
ব্যবহার আর কবিতার স্বর বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে –
“ হার্মাদ সাথে মগ জোটে
পুবদেশে
আধাঁর সঘন হয় অভাগীর কেশে
পড়ে
থাকে বালা তার সম্ভ্রম ঘোচে অসহায়
স্বামী শুধু চোখ দুটি মোছে
গোপনে
পালাতে গিয়ে সেও পড়ে ধরা আগে
পিছে ডাঁয়ে বাঁয়ে মগের প্রহরা
ভোঁতা
শিক দিয়ে দিয়ে মগ তালু ফুটো করে সরু
বেত গুঁজে দেয়। হাজারে হাজারে
এইভাবে ক্রীতদাস দ্বীপ ও নগর বাংলার
নীলাকাশে ঘন-কালো ঘোর
মার
খেতে খেতে মার ছুঁড়ে দেয় লোক চাঁটগায়ে
সন্দ্বীপে ঘৃণা হয় শোক
মগ
ছোটে পুবদিকে ছেড়ে রাহাজানি জনশ্রুতি
হয়ে ওঠে মগের ধাওনি”
বাংলার ভূমিতে ঘোর অশান্তির এক ছবি এখানে দেখতে পাই।
কবিতার আঙ্গিকের অবাধ যাতায়াত আবার পরক্ষণেই আমাদের নিয়ে যায় শাঁখারির গ্রামে।
শাঁখারি আর শাঁখারি বউ যেন তাদের সহজ যাপনে হর-গৌরী, ভেসে আসে পরিপূর্ণতার
আহ্বান...
“
বোমভোলা আসে রোজ শাঁখারির বেশে গৌরী
রাঁধেন শাক মথ বসে কেশে
কলহ করেন তিনি নেশা দেয় দোল চারিজন
সন্তান ভরা গৌরী-কোল
দিবানিশি শাঁখ কাটে শাঁখারির হাত ঘষে
ঘষে তেতে ওঠে লোহার করাত
শাঁখা
পরো মা’গো তুমি ভুলে থেকো শোক কপালে
সিঁদুর-টিপ অক্ষয় হোক”
কখনও পটে আঁকা হয় শবর আর তার শিকার জীবনের আদি কথা।
হরিণ-হরিণীর কথা...
“দেখেছি হরিণ এক জল খেতে আসে রাত ফুঁড়ে ওঠা ব্যাধ ঘোরে আসেপাশে
নাভিতে পড়েছে তার চাঁদ ছলোছল আপন মাংস স্বাদে জিভে আসে জল
মাংসের নীচ থেকে জেগে ওঠে তির ধনুক শরীর বোঝে। কামনা অধীর”
আবার কবিতা যেন আমাদের নিয়ে এসে দাঁড়ায় শুষ্ক নদীর
চড়ায়। কবিতার এই সীমানায় শূন্যতাই ‘সদ্গুরু’...
“
ভেলা নাই নাও নাই যতদূর রেখা গভীর জলধি। দূরে শূন্যতা-রেখা
তাকেই প্রণাম কর দূর্গম পথ নিয়তি
তোমার মোহ-শূন্যের রথ”
তবে এটাও বলা অবশ্যই দরকার যে বইটির কবিতাগুলির চলন
একই আঙ্গিকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমরা বইটির কবিতাক্রম অনুসারে এগোলে দেখব কবিতার
স্বর দ্রুত বদলাচ্ছে। কবিতা তার নিজের শ্বাস্বত ভাষায় ফুটে উঠছে ক্রমশ –
“জোনাকিরও
ছেলে-মেয়ে আছে। ওই যে আঁধারে নাচছে; হতে পারে সে পুরুষ জোনাকি। সঙ্গকেত দিয়ে মুগ্ধ
করছে সঙ্গীনিটিকে। ওই যে লাজুক, ঈষৎ লাজুক জ্বলা-নেভা; হয়ত সে মহিলা-জোনাকি। সেই
সংকেত গ্রহণ করছে। এবার ওদের সংগম হবে। ওরা চলে যাব এপাতার আড়ালে। বাইরের আলো
ণিরবে নিভিয়ে ওরা জ্বেলে নেবে শরীরের ভেতরে লুকনো ঝাড়বাতি
প্রায় সব প্রাণী শরীরের আলো জ্বেলে... গন্ধ ছড়িয়ে পথ
প্রস্তুত করে। মানুষের পথে শুধু শক্ত ও পিচ্ছিল হয়ে ওঠা ছাড়া আর কোনো ঘটনা ঘটে না
মানুষের মেধা তার শরীরের ভেতর ও বাইরের আলো নিভিয়ে
দিয়েছে। অতএব সে যখন সংগম করে সে শুধু শূন্য অন্ধকারে দাঁত চেপে ধরে
সেই হারানো আলোর জন্য কাঁদে”
কিংবা এই কবিতাটিও –
“কামারের কোপ আর বলির বাজনা –
সার্থক বলিদানে
এই দুই সমান জরুরি
ধড় থেকে নেমে আসে গলা
যেন জমে থাকা রক্তের
এবার মুক্তি
রক্তমাখা ঢাকের শব্দের
উল্লাস। আকাশ ফাটানো বোল
রক্তমাংসমেদ সবই পাবেন; তবু
শেষ চিৎকার শুধু তিনিই শুনবেন
দেবীও তা চান”
“তিতিরের জন্য লেখা” সিরিজের কবিতাগুলি আমাদের নিয়ে যায় কোনো এক নিবিড়তম
দিনে। সিরিজের চারটি কবিতাতেই শব্দের গভীর বুনোট বা কবিতার ভাষা আমাদের পাঁজরের
আবরণ খুলে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেয় কবিতার ভাষার অন্য এক গুহামুখের সামনে...
“সাভানা জঙ্গলে আমি খুঁজে পাই ছোট্ট কুটির, কাঠের
তৈরি। ছোট্ট টেবিলে ক্যান্ডেল মদের গেলাস কাউবয়-টুপি। ধীরে ধীরে এই সিল্যুয়েট ঘিরে
ফেলে কুয়াশার ভারী ব্ল্যাঙ্কেট। বন্দরে জাহাজঘাটায় বাণিজ্য-বাঁশির শব্দে নাবিকের
সম্বিত ফেরে, বেশ্যা তারা বেরিয়ে পড়েছে... কালো করিডোর। গ্যাংব্যাং। দূর থেকে শোনা
চাবুকশব্দ আর সংগমদ্বনি প্রতারণাময়। এই যৌনবাণিজ্য আমাদের ইতিহাস, আমাদের সামাজিক
নদীদের পুষ্ট করেছে। হারামির হাতবাক্সের থেকে বন্দরে লাফিয়ে নেমেছে যৌনমেধার খেলা”
আরও
বেশ কিছু কবিতা উল্লেখ করার মতো যেখানে
কবিতার আপাত সহজ-স্রল কিছু লাইন কবিতার মধ্যে নিহিত স্বরকে দৃঢ় ভাবে আঘাত করে –
“ মধুবিদ্য শ্রেষ্ঠবিদ্যা; এ বিদ্যা যার হাতে থাকে
সে পুরুষ
বিষণ্ণ হয় খুব। তার
ঘরের উঠোনে
চিরবিচ্ছেদ ছাপ রেখে যায়”
‘শ্বাস’ শিরনামের কবিতার কিছু লাইন তুলে দিলে স্পষ্ট
হবে আরও –
বলিদান নিয়ে
বিশেষত এই খাড়া ও কাত্তান নিয়ে
অনেকের ভুল ধারণা রয়েছে
ধারে নয়; ভারে কাটে ছাগলের গলা
অদ্ভুতভাবে কামার ও হড়িকাঠে ঢুকে যাওয়া মাথা –
দুজনেই শ্বাস চেপে রাখে
নরম গর্দানে
নাহলে হয়তো কাত্তান
ছিটকে উঠত
টুকরো টুকরো কিছু লেখাতেও কবির দৃষ্টিভঙ্গি তার
নিজস্ব রঙে প্রোজ্জ্বল –
“ তবু শ্রাবণের দিনে
দেখি আঙুল
হারানো এক পাগলের ছায়া
গাছেদের
পাতায় পাতায় তার
জল দিয়ে
আঁকা জলরং ছবির বিষাদ”
অথবা এই লাইনটিও –
“ ঠিকই বলেছেন জেলার-সাহেব
জে. সি. বোস
বলবার আগে গাছেরা কি প্রাণহীন ছিল!”
উপরের দুটি কবিতাই ওই কয়েকটি লাইন নিয়েই তৈরি। পাঠককে
এটা খুব অবাক করে দেবার মতো যে কবিতাগুলির শিরোনাম হল যথাক্রমে ‘প্রেম’ ও ‘সহমত’
এবার
আসি বইটির নির্মাণ নিয়ে দু একটি কথায়। বইটির প্রকাশক ‘পরম্পরা প্রকাশন’ –এর গৌতম
দাশ অত্যন্ত যত্ন নিয়ে বইটির প্রকাশ করেছেন। বইটির আকার ডিমাই। ন্যাচারাল পাতায়
ঝকঝকে হরফে ছাপা। প্রচ্ছদে শিল্পী রোচিষ্ণু সান্যালের শিল্পনৈপুণ্য চোখে পড়ার মতো।
পরিশেষে
বেশ কিছু কথা বলতেই হয় যে এই বইয়ের প্রায় বেশিরভাগ কবিতাগুলির ভাষ্যের ঝোঁক সময়পঞ্জীর
একটি নির্দিষ্ট সময়ের দিকে ইঙ্গিত দিলেও কবিতাগুলির চলন চোখে পরার মতো। ভাষ্য বা
স্বরের এই ‘ড্রিফট’ বইটিতে একটা দারুণ ভারসাম্য এনে দিয়েছে। কবিতার ফর্ম্যাট বা
আকার নিয়েও নিরীক্ষা করেছেন কবি ‘হরিশচন্দ্র’, ‘রামমোহন’, ‘হীরা বুলবুলি বাঈ’
কবিতাগুলি লেখা হয়েছে মুক্তগদ্যের আকারে
আবার ‘বৃহৎ বঙ্গ’ সিরিজের কবিতাগুলি লেখা হয়েছে পয়ারে। ‘মনজে, তোমাকে’ কবিতাটি আছে
চিঠির আকারে আবার ‘যা বলেছি গেরিলাক্যাম্পে’ কবিতাটি কথোপকথনের ভঙ্গিতে লেখা
হয়েছে। তবে কবি তো চিরবিষণ্ণ রহস্য-সন্ধানী। তার সমস্ত কবিতার অভিমুখই হল এই কৃষ্ণগহ্বরের
ভিতর লুকিয়ে থাকা সত্যের দিকে। ‘আর্তনাদ’ কবিতার কয়েকটি লাইন দিয়ে লেখা শেষ করছি –
“ যোনিপথ আলোকিত হলে জন্মের রহস্য থাকে না। আর এই
রহস্যটুকু তার মৌলিক সম্পদ, তাই সুড়ঙ্গ পেরুনো সব জাতকের বোজা চোখ। শুধু দু-একজনের
চোখ খুলে যায়... দৈব দুর্ঘটনায় হয়তো কিছুটা... তারা আজীবন অভিশাপ মাখা। আদিম
অরণ্যে গিয়ে চোখে পড়ে দুই ডালে কেউ
পাখি-মা’র পা-দুটি বেঁধেছে। ডিম ফেটে নয়, বিশাল ছিদ্র দিয়ে... ধাতু আর আলো ঠিকরানো
পথে হেলতে-দুলতে পাখি বেরিয়ে আসছে
সে তখন গাছের
ছায়ায় বসে শান্ত শরীরে চুপচাপ ছুরি বের করে। খুলি উপড়িয়ে নিজেই নিজের ঘিলু বের করে
আনে, ধরে পাতার থালায়
মাঝে মাঝে দেখা যায় তাকে বন থেকে ছুটে বেরিয়ে আসতে।
অস্ত সূর্যের দিকে থালাটি বাড়িয়ে সে বলেই চলেছে, ছাগলের গলা নাও... হাড়িকাঠ, বলির
খড়্গ নাও, শুধু জীবনে রহস্য দাও
পুনর্বারের দিকে রহস্য ফেরাও”
কাব্যগ্রন্থঃ “বাংলা, পর্ণশবরী”
কবিঃ পার্থজিৎ চন্দ
প্রকাশকঃ পরম্পরা প্রকাশন
প্রকাশঃ বইমেলা ২০১৯
No comments:
Post a Comment