আগের সংখ্যাগুলি

Thursday, April 11, 2019

পক্ষপাতদুষ্টে দুষ্ট হয়েও হঠাৎ চওড়া বাঁকবদল - সুমন সাধু





একটা আস্ত সংসারের মধ্যে ঢুকে পড়ছে গতিবিধির চেতনা। যেন এইমাত্র জন্ম নেবে শহুরে কোকিল। উত্তুরে হাওয়ায় মিশে যাবে শুভ লগ্ন, ক্যালেন্ডারে দাগ। তান সেনের গানে হালকা কড়ি-মা উড়ে আসবে এইমাত্র। ঘড়িতে দেখা যাবে বেলা গড়িয়ে বিকেল কষার সময়। ঘরে ফিরবে ফিরবে করছেন একজন সাংসারিক। জীবনের সমস্ত ছক না কষে সময় দেবেন বেপাড়ার দিনে, রোববারে, স্নানঘরে কিংবা সমুদ্র থেকে ধার করে নিয়ে আসা নোনা বারমুডায়। 

"এ কেবল জ্যোৎস্নাদিনই জানে। এক রাস্তার মতো অন্ধকারে যারা অটো না পেয়ে হেঁটেছিল, মাঝে এক সমুদ্র ঢুকে এসেছে ঢেউ নিয়ে। শুধু রবিবার কাছে এলেই এক ইদানীং পেয়ে বসে দৌড়ে যাওয়াদের।" - লিখছেন আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর সাম্প্রতিকতম কবিতা-বই "পক্ষপাতদুষ্ট"-এ এসব খুঁটিনাটি কথাই লিখে চলেছেন কবি। আকাশের কবিতা ধারাবাহিকভাবে যাঁরা পড়তে অভ্যস্থ, তাঁরা বুঝতে পারবেন তাঁর দেখার চোখ কীভাবে বদলে যাচ্ছে কবিতায়। কেন জানি না পক্ষপাতদুষ্ট পড়তে পড়তে বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়ের " উত্তর কলকাতার কবিতা" বইটির কথা। সেখানে আমাদের সেই ছেলেবেলায় লুকিয়ে দেখা স্বপ্নগুলো খুব কাছ থেকে দেখতে পেয়েছিলাম। কেন এ প্রসঙ্গ টানলাম? কারণ, পক্ষপাতদুষ্ট আমার পাঠকসত্ত্বাকে বারবার যুবকবেলার স্বপ্নে এনে ফেলছে। যে স্বপ্ন হয়তো আমিও দেখতে চেয়েছিলাম। হয়তো আকাশ এইসব লেখা লিখবে বলেই সেই স্বপ্ন আমার জীবনে আসেনি। 

কবি এই বইটি চারটি পর্বে ভাগ করে দিয়েছেন। "নষ্টচাঁদ, পক্ষপাতী চাঁদ", "বেজে ওঠো, শয়তানমাস", "সশব্দ যাত্রাপথ। বাঁক পরিমিতি" এবং "রাশিফলে নেই"। শেষ পর্বটিই আশ্চর্যজনকভাবে আমায় ছুঁয়ে গেছে। সেই পর্ব থেকে কয়েকটি ছেঁড়া ছেঁড়া লাইন তুলে দেওয়া হল। 
১) "সেদিন স্তব্ধ মাঠে লুকিয়ে যা উগ্রেছেন কোণে, সেও কি আমারই বীজ? আমার ঝড়ের ঝরা ফল?"
২) "হঠাৎ বৃষ্টি নামলে এই ক্ষেতে কোথায় লুকোবো? হঠাৎ বৃষ্টি মানে প্রিয়জন মারা যাবে কেউ..." 
৩) "শুধু তুমি ছুটি পেলেও বাড়িতে বলা চাপ, আমি বাড়িতে বললেও টাকা জমছে না। তাই সমুদ্র আমাদের স্বপ্ন দেখাবে আরও কিছুদিন; আরও কিছুদিন লেখা বন্ধ থাকবে এমাসে..." 
৪) "যতক্ষণ না রাস্তায় জল দাঁড়াচ্ছে আমি স্বাধীন; যেদিন রাস্তায় জল দাঁড়াচ্ছে, ম্যানহোল খুঁজতে বেরিয়ে পড়ছি সকাল সকাল।" 
এবং
৫) "হাঁটবার ওষুধ দিলে আপনি সাঁতার কেটে বসছেন, সাঁতরাবার ওষুধ দিলে উড়ে যাচ্ছে মাছরাঙা।" 

লাইনগুলো হুবহু তুলে আনলাম কারণ, এই দেখা আসলে আমার দেখা। আমার ব্যক্তিগত দেখা। যেটা ঘটনাচক্রে আকাশও দেখে ফেলেছে। এই পর্বের অনেকগুলি লেখা সম্পূর্ণ আকারে পছন্দ না হলেও কয়েকটি ছেঁড়া ছেঁড়া লাইন আমার কবিতা ভাবনাকে অমোঘ করে তুলেছে। বোঝা যাচ্ছে বেঁচে থাকার প্রত্যেকটা দিন তিনি আবিষ্কারের মধ্যে দিয়ে হাঁটছেন। যাতায়াতের রাস্তা থেকে তুলে আনছেন ক্ষত চিহ্ন। তবুও কোথাও গিয়ে একটা সুর বরাবর অনুভব করি ওঁর কবিতায়। আকাশ গঙ্গোপাধ্যায় বিপদের কথা বললেও সেখানে একটা ছন্দ কাজ করে। যে ছন্দের ফাঁকে বা স্পেসে ঢুকে যেতে পারে আরেকটা ছন্দ। এই দুইরকম ছন্দ আওয়াজের যে অনবরত এবং অবাধ্য যাতায়াত, তার ফলে যে ঝংকার তৈরি হয়, তাতে বোঝা যায় আকাশের কবিতা মোটেও শান্ত নয়, ভীষণ ছটফটে, জেদি। ধরা যাক আরেকটি কবিতা, 
"এক অক্ষরের সাথে অন্য অক্ষর, তার সাথে আরও এক/ এভাবে রিপু করতে করতে আসলে এক চক্রব্যূহ তৈরি হয়ে যাচ্ছে দ্রুত/ এবং একটা গোটা প্রজন্ম কারুর হাতে কাঁচি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না" 
ঝড় এবং ঝড়ের সীমাটাকে লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে, চিত্রশিল্পী বেরিয়ে পড়েছেন চরিত্র খুঁজতে। যাকে তিনি ক্যানভাসে বসাবেন। অলংকৃত করবেন। অক্ষরের সঙ্গে অক্ষর, রঙের সঙ্গে রঙ, রিপু হতে থাকবে চাওয়া আর পাওয়ার একটা চিরকালীন সম্পর্ক। বইটি পড়তে পড়তে কয়েকটি এলোমেলো শব্দ মাথায় ঘুরতে থাকবে। "মদ্যপান", " মানচিত্র", "বারান্দা", " উদাসীন" ইত্যাদি। শব্দগুলি অচেনা নয়। কিন্তু শব্দগুলির চলন, বারবার আসা-যাওয়া একটা ধাক্কা দেয়। ছেলেমানুষী ধাক্কা। ধাক্কাটা না হলেও হত, কিন্তু হল বলেই একটা হোঁচট খাওয়া গেল। 

ব্লার্বে একটি লেখা জ্বলজ্বল করছে। সেখানে কয়েকটা লাইনে বলা আছে, "আকাশ এও জানে- আর সবকিছু মিথ্যে হয়ে গেলেও, একজন আছে, যে তাকে মেঘলা করে দেবে না। পক্ষপাতদুষ্ট সেই না-এর মধ্যে মিশে থাকা একটুকরো সংশয়। অথবা সংসার।" 
শুধু এই বই নয়, আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়ের পূর্ব প্রকাশিত কয়েকটি বইয়েও এই সংশয় এবং সংসারকে দেখা গেছে। তারা পেটরোগা হলেও, খিদের অর্থ বোঝে। বোঝে অজস্র কোকিলের ডাকনাম বসন্ত। 


পক্ষপাতদুষ্ট 
কবি- আকাশ গঙ্গোপাধ্যায় 
প্রচ্ছদ- দেবর্ষি সরকার
প্রকাশক- আদম
মুদ্রিত মূল্য- ১২৫ টাকা

                                     


                                                               

No comments:

Post a Comment