কবি অজিতেশ নাগের লেখা "ছাগমুণ্ড ও আত্মাজল"। বইটা আদ্যপ্রান্ত অনেকবার পড়লাম। আমার মনে হ'ল লেখক বোধহয় কোনো বলি দেওয়া দেখেছেন! আর তাই নিয়েই তার অবচেতন মনে যে সব প্রশ্নের আলোড়ন সৃষ্টি
হয়েছে, তার উপলব্ধির কথাই এই দীর্ঘ কবিতায় তিনি ব্যক্ত করেছেন। ঋদ্ধ মহোদয়ের কাছে তারই প্রশ্ন রেখেছেন। অবশ্য এটা একান্তই আমার নিজস্ব ধারণা।
এই লেখাটি ভাষা ও
দর্শনের আলোকে সমৃদ্ধ। হ্যাঁ, বহু প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দুদের শক্তি পূজার শাস্ত্রাচার
নিয়মানুযায়ী বলির প্রচলন ছিল। পাঁঠাবলি, মোষবলি, এমনকি তন্ত্র সাধনায় নরবলির কথাও শোনা যায়। কিন্তু সত্যিই কি হিন্দুধর্মে (উপনিষদে বা বেদে) পশুবলির কথা বলা হয়েছে? না। কিছু ব্রাহ্মণ বেদ উপনিষদের জ্ঞান সঠিকভাবে অর্জন না করেই
ভ্রান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে পশুবলি দিয়ে থাকেন। ‘জীবহত্যা
নয়, জীবে প্রেম করার কথা বলা হয়েছে। এখানে রক্তপাত বা কোনো হিংসাত্মক কাজ করা নিষেধ। যজ্ঞ হ'ল অহিংস। মেধ, অর্থ, ত্যাগ কিংবা
নৈবেদ্য! রাষ্ট্র
সবসময়ই প্রগতিশীল; আর তাই প্রগতি অশ্বের মতো বেগবান। তাই রাষ্ট্রের হিতাকাঙ্ক্ষে যে যজ্ঞ করা হয়, অশ্বকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তাই এই যজ্ঞকে অশ্বমেধ যজ্ঞ বলা হয়।
গো' শব্দের অনেকগুলো অর্থের মধ্যে একটি হল পৃথিবী। তাই পৃথিবীর মঙ্গল কামনায় যে যজ্ঞ করা হয় তা হল গোমেধ যজ্ঞ। মানুষের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মার মুক্তির জন্যে, বা মঙ্গল কামনায় যে যজ্ঞ করা হয় তা নরমেধ যজ্ঞ। পশুহত্যা করে কোন হোম-যজ্ঞের বিধান শাস্ত্রে নেই।
জীবই জীবের জীবিকা। কিন্তু বৃথা হিংসার বিধান নেই। ভোগাসক্ত মানুষ এই নিয়মকেই লঙ্ঘন করেছে।
কবি অজিতেশ নাগ বলেছেন,
কবি অজিতেশ নাগ বলেছেন,
‘বলিদানকারী অর্জন করে ছিন্ন ছাগ,মেষমুণ্ড ,
গলিত চর্বির রাশি অভুক্ত সারিসারি মুখের উপর
হস্তচালনা করেঃ উত্থাপিত তথৈব তথাস্তু
নিমেষহীন ভাবে ছন্নমতি হয় মনুষ্যপুংচিহ্ন!’
গলিত চর্বির রাশি অভুক্ত সারিসারি মুখের উপর
হস্তচালনা করেঃ উত্থাপিত তথৈব তথাস্তু
নিমেষহীন ভাবে ছন্নমতি হয় মনুষ্যপুংচিহ্ন!’
বলির পর বলিদানকারী
বলির্বধ্যের ছিন্ন মুণ্ডকে অর্জন করে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা রক্ত ও
দেহের অভক্ষিত গলিত অংশে হাত বুলোতে থাকে। অর্থাৎ তার ভিতরে লোভ, লালসাই জেগে ওঠে। তার মানবক পুরুষকার বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয়।
আমাদের মধ্যে যে কাম
ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য এই ষড়রিপু’র খেলা চলে অবিরাম, তাকে নাশ করার জন্যেই নিরীহ পশুকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার
করা হয় ও বলি দেওয়া হয়। কিন্তু মানুষের অন্তরে যে হিংস্রতা বা ষড়রিপুর উপাদানগুলি বিদ্যমান তা কি ধুয়ে মুছে সাফ হয়? বরং শুধু ভোগের লালসা! কবির
ভাষায়,
‘এ চাওয়া দেবীর নয়, এ চাওয়া নৈর্ব্যক্তিক’
সত্যিই দেবী এত রক্ত, এত প্রাণ চান না, চাইতে
পারেন না। এ চাওয়া অপৌরুষেয়। কবি বলেছেন, কিছু
অন্ধকারাচ্ছন্ন সংস্কারকে উদ্দেশ্য করে,
‘লজ্জানত
দেবী সতৃষ্ণনয়ন একখণ্ডিত বস্ত্রের তরে / দেবীর
চক্ষুদান, মৃদশরীরে প্রাণদানের পর দেবী লজ্জাভারে অবনত। চোখে তার তৃষ্ণা! কিসের
তৃষ্ণা ? একখণ্ড বস্ত্রের। প্রাণ সঞ্চারের পর লজ্জাবরণের বস্ত্রের জন্যে।
‘ন্যায়রত্ন ন্যায়াধীশঃ বিপরীতক্রমে বিভাজিকা,
আশ্লেষ সংকুচিত নয় ক্ষমার্হ প্রার্থনা সংগীত,
স্বীয় চৈতন্য খাবি খায় কন্দর্প রাস্তায়; রসস্থ হয়;
ধমনিজালে স্খলিত হয় উহ্যমান বিস্রংসী নিদাঘ,
ছাগাদি পবিত্রতম হয় চিটচিটে হাঁড়িকাঠের নিচে’
এখানে কবি বলছেন
ন্যায়নিষ্ঠ ন্যায় শাস্ত্র প্রণেতা যাদের উপর ন্যায় বিচারের ভার তারাই বিপরীতমুখী
গুণে অবস্থান করছে। তাই দৈবযোগে মিলন প্রসারিত করার জন্যে স্রষ্টার কাছে ক্ষমা
প্রার্থনা করতে হবে। নিজেদের সুচেতনা, শুদ্ধসত্ত্ব জ্ঞান লুপ্ত হয়; কামনাগ্রস্ত রিপুতে জড়িয়ে পড়ে। শরীরের শিরা-ধমনীতে প্রবহমান রক্তে বহন করে চলে ক্ষরিত
উষ্ণতা, ক্ষরণশীল উত্তাপ।আর বলির হাড়িকাঠে বলির্বধ্য ছাগ পবিত্রতা অর্জন করে।
সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব
মানুষ, অথচ বলির পাঁঠা রুষ্ট স্বরে তীব্র আর্তনাদে গর্জন করতে থাকে। কবির ভাষায় এটা মানুষের প্রতি তার ব্যাঙ্গাত্মক হাসি। বলি সমাপ্তির পরে দেবী খড়্গ হস্তে আবির্ভূতা হন। জীব নিধনে কি তিনি সত্যিই তৃপ্ত? এটাই কবির প্রশ্ন। বলপূর্বক ক্ষমতার জোরে আত্মাশান্তিজল পাওয়ার আশা, বৃথা দুর্লভ বস্তু পাওয়ার মিথ্যা আশা মাত্র।
তত্ত্ব জ্ঞান সম্পন্ন
পুরোহিতের চোখ তখন লোভে চকচক করে ছাগমাংসের জন্যে। বলির জীব-রক্ত দ্রুত ধাবিত হয় দেবীর চরণস্খালন করতে। আর ছড়িয়ে ছিটকে পরা মুণ্ড ও মাংস নিয়ে কাড়াকাড়ি চলে
মোক্ষপ্রাপ্তির তত্ত্ব-জ্ঞান-সম্পন্ন মানুষের মধ্যে।
এখানে কবির প্রার্থনা
বিশ্বমাতার কাছে,
‘হে মাতঃ, হে পুণ্যস্বরূপিনী,
আত্মাবলি নিবারিত হোক –
হনন হোক যত রিপুকাঙ্খা,
হনন হোক যত কামাকাঙ্খা,
হনন হোক যত আত্মাকাঙ্খা,
নিরম্বু নিরীক্ষণে নিরহংকার; নিরূপিত
হোক ধৃষ্ট তমিস্রা।’
জননী পবিত্রতার আধার, কল্যাণময়ী! তিনি
সন্তানের রক্তপাতে খুশী হতে পারেন
না। তিনি মঙ্গলময়ী। মানুষের মধ্যে উপস্থিত কাম-ক্রোধ-লোভ-মোহ-মদ-মাৎসর্য্য সব
রজোগুণ মুছে মানুষ কালিমা মুক্ত হোক। অন্তরের অন্ধকার দূর করে আলোর সন্ধান পাক।
কবিতার বই – ছাগমুণ্ড ও আত্মাজল
প্রকাশক – যুগসাগ্নিক
কবি – অজিতেশ নাগ
No comments:
Post a Comment