“টেবিলের নীচ থেকে বেরিয়ে এল সে। প্রথমে ভয়ংকর কিছু একটা ভেবে পা সরিয়ে নিচ্ছিলাম। পরে বুঝলাম, সে একটি উচ্চিংড়ে।” এমনি করে শুরু হওয়া গল্পের নাম ‘খেলা’। তারপর সেই উচ্চিংড়ে বলতে থাকে, “তোমার কাছে যা আনন্দ, আমার কাছে তা অপঘাত। সেই ছোটোবেলায় আমার এই অবলা পা-টি তুমি ছিঁড়ে নিয়েছিলে। আর এই বড়ো হয়েও দেখছি তোমার সেই কুটিল আনন্দ থামেনি।” অকিঞ্চিৎকর উচ্চিংড়ে, নাকি বক্তার হঠাৎ জেগে-ওঠা বিবেক!গল্প কিন্তু আখ্যানের চেনা পথ ধরে আর এগোয় না। সাবেক ছোটোগল্পের প্লট হলে এই সূত্র ধরেই আসত ফ্ল্যাশব্যাক, সম্ভবত বক্তার নানা কুকীর্তির খতিয়ান। তারপর হয়তো সেইসব চূর্ণ আখ্যানের কোনোটি পল্লবিত হয়ে তৈরি করত ছোটোগল্পের সংকট-মুহূর্ত। অথবা গল্পটি চলত বক্তার মনোবিকলনের জটিল পথ ধরে, ছোটোগল্পসুলভ কোনো এক অভাবিত সমাপ্তির দিকে! কিন্তু অণুগল্পকারের হাতে সেই সময় বা পরিসর, কোনোটাই নেই! তাই একশো পঞ্চাশ শব্দেরও কম দৈর্ঘ্যের এই অণুগল্পের সমাপ্তি হয় এইভাবে:“বিচ্ছিরি উচ্চিংড়ে! তুই আমার মনের সব কু জেনে ফেললি কী করে… একে তো বেঁচে থাকতে দেওয়া যায় না আর… চটিশুদ্ধু বাঁ-পা দিয়ে ওকে পিষে ফেলতে গিয়ে দেখি টেবিলে[র] নীচে সব ভোঁ ভাঁ… কেঊ কোত্থাও নেই, যেন কখনও ছিলই না…”। প্রশ্ন হল, এরকম একটি অণুগল্প থেকে পাঠকের প্রাপ্তি কী? গল্পের শেষ বাক্যটিতে এসে পাঠকের ধোঁকা লাগে, সত্যিই কি ছিল ওই উচ্চিংড়ে! এই জাদুবাস্তবতার ঘোর-লাগা সমাপ্তির পরেই হয়তো আসল গল্পটা শুরু হবে, পাঠকের মনের ভিতর, কুর-কুর করে ডেকে উঠবে এক বিবেক-দংশনকারী উচ্চিংড়ে! শুধু এই একটি গল্পেই নয়, লেখক চন্দন ঘোষ-এর অণুগল্প নির্মাণের মুনশিয়ানার ছাপ রয়েছে এমন আরও অনেকগুলি অণুগল্পে। বইয়ের নাম ‘অণু-সন্ধান’ (অভিযান পাবলিশার্স, জানুয়ারি ২০১৯), বত্রিশটি মৌলিক অণুগল্প আর অণুগল্পের নানাদিক নিয়ে গভীর অন্তর্বীক্ষণমূলক চারটি প্রবন্ধ ছাড়াও এতে স্থান পেয়েছে লিডিয়া ডেভিস-এর তিনটি অণুগল্প ও আর্নেস্ট হেমিং ওয়ে-র লেখা থেকে দুটি অণ্যগল্প-সদৃশ আখ্যানের অনুবাদ।
এক হিসেবে ‘অণু-সন্ধান’ এক অভিনব সংকলন গ্রন্থ: এতে একইসঙ্গে ধরা পড়েছে গল্পকার, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদকের স্বতন্ত্র কিন্তু পরিপূরক সত্তা। আসলে গল্পকার চন্দন ঘোষ-এর অণুগল্পের মেজাজ ও চলন সম্যক ঊপলব্ধি করতে গেলে সমকালীন বাংলা ও বিশ্বসাহিত্যের অণুগল্প সম্পর্কে লেখকের ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক ধারণা খানিকটা বুঝে নেবার প্রয়োজন আছে। কারণ বাংলা ভাষায় অণুগল্প রচনার সাম্প্রতিক প্রয়াস একমাত্রিক নয়, তা বহুবর্ণী! বস্তুত অণুগল্পের সর্বসম্মত সংজ্ঞা এখনও আমাদের হাতে নেই; অণুগল্পের দৈর্ঘ্য কত হবে, তার অন্য গঠনগত বৈশিষ্ট্যই বা কী, এ নিয়ে বিভিন্নজনের মত বিভিন্ন। অন্যদিকে একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, এখনও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের, বিশেষত গদ্যসাহিত্যের, যে-কোনো প্রকরণের সংজ্ঞা নির্ধারণে পাশ্চাত্য সাহিত্যের, বিশেষত ইংরেজি সাহিত্যের, সাহায্য নেওয়া অনিবার্য।এইসব প্রসঙ্গ নিয়ে প্রণিধানযোগ্য আলোচনা স্থান পেয়েছে চন্দন ঘোষ-এর প্রবন্ধ চারটিতে। অণুগল্প হিসেবে কোন শ্রেণির (Genre) গদ্য-আখ্যান পাঠক এই লেখকের কাছ থেকে আশা করবেন, তার দিশাও মিলবে এই প্রবন্ধগুলিতে।
অণুগল্প নিয়ে চন্দন ঘোষ-এর প্রবেশক প্রবন্ধটি (‘অণুগল্প: গদ্যসাহিত্যের অঙ্গনে এক দুরন্ত চিত্রল মৃগশাবক’) ২০১৬-এ প্রকাশিত হয়েছিল ‘বহুস্বর’ পত্রিকায়। এই প্রবন্ধের সূচনায় প্রবন্ধকার শেক্সপিয়ার-কে উদ্ধৃত করে বুঝিয়ে দিয়েছেন, অণুগল্পের ক্ষেত্রে “Brevity is the soul of wit”। বিশ্বসাহিত্যের প্রেক্ষিতে অণুগল্প তথা ফ্ল্যাশ-ফিকশন-এর বিবর্তন ও শ্রেণিবিভাগ নিয়ে উদাহরণ সহ আলোচনার অন্তে তিনি তালিকাবদ্ধ করেন অণুগল্পের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি। অণুগল্পের এইসব চরিত্রলক্ষণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল “কিছু না বলা কথা উহ্য রেখে রহস্যসৃষ্টি করা”, “পাঠকের জন্য বিনির্মাণের সুযোগ রাখা”, এবং সর্বোপরি, “অতিমাত্রায় বাকসংযম, কাহিনি বিস্তারের সীমিত সুযোগ রাখা।”অনুসন্ধিৎসু পাঠক লক্ষ করবেন যে, চন্দন তাঁর গল্পে প্রায় সর্বত্র এই তিনটি লক্ষণকে মান্য করে চলেছেন।এই সূত্রে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় ‘ভুলভুলাইয়া’, ‘এন্টার বাটন’, ‘নাচ মেরি বুলবুল’ প্রভৃতি গল্পের।
দ্বিতীয় প্রবন্ধটি আমেরিকার প্রখ্যাত ফ্ল্যাশ-ফিকশন লেখক লিডিয়া ডেভিস-এর জীবন ও সাহিত্যকৃতি বিষয়ে। এ লেখা সংগত কারণেই কিঞ্চিৎ তথ্য-ভারাক্রান্ত। তবে ডেভিস-এর লেখার আলোচনায় বা গল্পের বিষয়ে ডেভিস-এর নিজস্ব দর্শনের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কিছু মূল্যবান কথা তুলে আনেন লেখক। লিডিয়ার লেখায় মার্সেল প্রুস্ত বা রাসেল এডসন-এর প্রভাব কীভাবে পড়েছিল তার বিশ্লেষণ আগ্রহী পাঠকের কাছে কৌতূহলোদ্দীপক। ডেভিস-এর লিখনশৈলী প্রসঙ্গে প্রবন্ধকারের পর্যবেক্ষণ: “ডেভিসের কাছে গল্পের সংজ্ঞা কিঞ্চিৎ আলাদা।… অধিকাংশ লেখাই খুব ছোটো, ছোটোগল্প নামে ডাকার উপযুক্ত নয়। এবং এসব তিনি সচেতনভাবেই করেছেন। তাঁর কোনো কোনো রচনাকে কবিতাও বলা যেতে পারে।” আলোচ্য বইটি পড়তে পড়তে অনুভব করা যায় গল্পকার চন্দনের কোনো কোনো গল্পও যেন কবিতাকল্প! লিডিয়া ডেভিসের ফ্ল্যাশ-ফিকশন বা কাফকার মাইক্রো-ফিকশনগুলির কোনো কোনোটির মতোই সেসব গল্পেও নেই কোনো সুনির্দিষ্ট ‘প্লট’, যেমনটা থাকে প্রথাসিদ্ধ ছোটোগল্পে। যেমন ধরা যাক ‘বোবা-জ্যোৎস্না’ গল্পটি। মূক রিকশাচালক ‘বোবা’-র এই গল্পে নেই কোনও সুনির্দিষ্ট ‘স্টোরি-লাইন’। “জাতীয় সড়কের মোড়ের ছুটন্ত গাড়ির স্রোতের মধ্যে অকুতোভয়ে” ভেসে যাওয়া বোবার রিকশার মতোই ঈষৎ বিভ্রান্ত পাঠককে সওয়ারি করে এই গল্পও ভেসে যেতে থাকে গল্পহীনতার সরণি বেয়ে কোনো এক অনির্দেশ্যের উদ্দেশে! শেষ অনুচ্ছেদে এসে এ গল্পের অন্তরের গল্পটুকু এক কবিতাময়গদ্যের আকারে ফুটে ওঠে: “চাঁদের রাত বড়ো ভালোবাসে বোবা। …পূর্ণিমার রাতে জ্যোৎস্নার রুপোলি চাদর জড়িয়ে একটু একটু দোলে বোবা, … বুক বাজিয়ে উঁ উঁ উঁ শব্দ করে যেন গান গাইতে চায় সে।… আর চাঁদের আলোয় পথ চিনে চিনে ও ফিরে যেতে থাকে কোনো লবটুলিয়া বইহারের অরণ্যের গন্ধমাখা মোকামের দিকে।… বোবা তার ফেলে আসা কুঁড়ে ঘরটির সঙ্গে অনর্গল কথা বলতে বলতে, গল্প করতে করতে ক্রমশ চাঁদের আলো হয়ে যেতে থাকে।” এই গল্পের মতোই কাব্যময়তার ঘোরে আচ্ছন্ন আরও অনেকগুলি গল্পের দেখা মেলে এই সংকলনে। যেমন, ‘একটি সিজয়েড বিকেলের কাহিনি’ বা ‘বঁটি-পুরাণ’। আলাদাভাবে উল্লিখিত এই গল্পগুলিতেই শুধু নয়, গল্পকার চন্দন ঘোষ-এর অধিকাংশ অণুগল্পেরই কোথাও না কোথাও গদ্যের পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা কবিতার ঘ্রাণ অনুভব করা যায়। “মূলত কবিতাই লেখেন” (দ্রষ্টব্য, বইয়ের ‘ব্লার্ব’) যিনি, তাঁর গদ্যে এমনটা অস্বাভাবিক নয়, অবাঞ্ছনীয় তো নয়ই!প্রসঙ্গত বলা যাক, আলোচ্য গ্রন্থের শেষ প্রবন্ধটিতে (‘কবিতা, গদ্যকবিতা ও অণুগল্পের আন্তর্সীমানা ও মিথোস্ক্রিয়া’)লেখক নিজেই অণুগল্প ও কবিতার সাযুজ্যের (লেখকের ভাষায় ‘জিনগত মিল’) বিষয়টি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন। তাঁর নিরীক্ষণ, “শুদ্ধ গদ্যকবিতা, প্রোজ-পোয়েট্রি, অণুগল্পের বিভাজনরেখা খুব অস্পষ্ট।” বক্তব্যের সমর্থনে তিনি পাশাপাশি উপস্থাপন করেছেন লিডিয়া ডেভিস-এর অণুগল্প, রাসেল এডসন ও চার্লস সিমিক-এর গদ্যকবিতার অনুবাদ। বাংলা কবিতার অঙ্গন থেকেও উৎপলকুমার বসু, ভাস্কর চক্রবর্তী, রমেন্দ্রকুমার আচার্য চৌধুরী-র গদ্যকবিতা উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন, বিশুদ্ধ কবিতাও কীভাবে অণুগল্প-কল্প হয়ে ওঠে কখনো কখনো।
আলোচ্য সংকলনের অণুগল্পগুলি ধারাবাহিকভাবে পড়লে পাঠক উপলব্ধি করবেন যে, গল্পকার চন্দন ঘোষ সম্ভবত বাংলা অণুগল্পের প্রচলিত আখ্যানধর্মী ধারায় আস্থাশীল নন। অথচ তাঁর কোনো কোনো গল্পের মধ্যে লুকিয়ে থাকে নিটোল একটি কাহিনির সূত্র, নির্মেদ বিবৃতির অন্তরাল থেকে যা কিনা পাঠককে হাতছানি দেয় নিজস্ব বিনির্মাণের পথে। এই সংকলনের এমনই এক উল্লেখযোগ্য গল্প ‘পশ্চাদগমন’। জমজমাট এক সাহিত্যসভার মধ্যমণি সফল সাহিত্যিক স্বপ্নিলকে ভক্ত-পরিবৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে সতীনাথ, স্বপ্নিলের প্রথম জীবনের সাহিত্যচর্চার সতীর্থ! জীবনযুদ্ধে ব্যর্থ সতীনাথ লক্ষ করে: স্বপ্নিলের “ফরসা মুখ চকচক করে উঠছে। সমৃদ্ধি আর সাফল্যের আলো পিছলে নামছে ওর গাল বেয়ে।” এই সভায় অনাহূত, অপাঙ্ক্তেয়, অসুস্থ সতীনাথের মনে পড়ে পুরোনো দিনের কথা: স্বপ্নিলের “প্রথম চটি বইটা কে বিলি করে বেড়িয়েছিল? না, এত কিছু মনে রাখা সম্ভব নয় স্বপ্নিলের। বড্ড হাঁফ ধরছে। আজকাল হাঁটতেও বেশ কষ্ট হয়। মাঝখানের পথটা অনেক লম্বা মনে হচ্ছে। এতটা দূরত্ব পার হয়ে সতীনাথ কি পৌঁছুতে পারবে স্বপ্নিলের কাছে?” তাই ক্রমশপেছোতে থাকে সতীনাথ “এই হল থেকে, এই মানুষজন থেকে, এই আলো থেকে, বিশ্বাস থেকে, বন্ধুত্ব থেকে, জীবন থেকে।” পেছোতেই থাকে, “যতক্ষণ না পর্যন্ত তার এগজিট গেট এসে পড়ে।” এই গল্পের সমাপ্তিতেই সম্ভবত গল্পের শুরু, ও হেনরি-র ধ্রুপদী ছোটোগল্পের মতো! অথচ বাকসংযমের পটুত্বে এ এক সার্থক অণুগল্পের আকার লাভ করেছে।
‘অণু-সন্ধান’ গ্রন্থে মৌলিক গল্পের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি বিদেশি অণুগল্পের অনুবাদ স্থান পেয়েছে। বিদেশি গল্পের বাংলা অনুবাদ প্রায়শই মূলানুগত্যের কারণে আড়ষ্ট হয়ে পড়ে। বাংলা অনুবাদে ইংরেজি বাক্যগঠনরীতির প্রভাব অনুবাদের স্বাচ্ছন্দ্য ব্যহত করে। আনন্দের কথা এই সংকলনের অনুবাদ এই ত্রুটি থেকে প্রায় সম্পূর্ণ মুক্ত।
এই আলোচনায় সংকলনের সবগুলি গল্পের আলোচনা সম্ভব নয়, বাঞ্ছনীয়ও নয়; পাঠকের জন্য তোলা থাক এক নতুন ধারার গল্পের জগৎ আবিষ্কারের নিজস্ব আনন্দ।একটি গল্প সংকলনের সবগুলি গল্প সমান মানের হওয়া সম্ভব নয়। আর গল্পের মান বিচার বা ভালো লাগা মন্দ লাগার বিষয়টিও আপেক্ষিক। সেটুকু পাঠকের বিচার্য। তবে আলোচ্য সংকলনটি যে বাংলা অণুগল্প চর্চার ক্ষেত্রে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ নেই। গতানুগতিক গল্পকথনরীতির ছকের বাইরে বেরিয়ে ভিন্ন ধারার সার্থক অণুগল্প রচনার স্বাস্থ্যকর প্রয়াস এবং অণুগল্প বিষয়ক মূল্যবান কয়েকটি প্রবন্ধ উপহার দেবার জন্য লেখক চন্দন ঘোষকে অভিনন্দন। তাঁর কাছে অণুগল্পে উৎসাহী পাঠকের আশা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাবে বলেই মনে হয়। পক্ষান্তরে সুচারু মুদ্রণ ও দৃষ্টিনন্দন অঙ্গসজ্জার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য প্রকাশকের। দু-একটি ছাপার ভুল (যেমন, প্রবন্ধের শিরোনামে ‘মিথোস্ক্রিয়া’) উপেক্ষণীয়। তবে গল্পগুলির প্রথম প্রকাশকাল দেওয়া থাকলে লেখকের অণুগল্প-ভাবনার বিবর্তনের ধারাটি পাঠক সম্যক অনুধাবন করতে পারতেন।
No comments:
Post a Comment