কবিতায় জেগে ওঠে পাতাবাহারের আলো’ – অভিজিৎ দত্তর ‘নীল
চতুর্দশী’ কাব্যগ্রন্থ আসলে নীল নক্ষত্রের আলোকচ্ছটায় আন্দোলিত বর্ণময় কবিতাসমূহের
উৎসব!
কাব্যগ্রন্থ – নীল চতুর্দশী
কবি – অভিজিৎ দত্ত
প্রকাশনী – পরম্পরা প্রকাশন
প্রকাশক – গৌতম দাশ
প্রচ্ছদ – রোচিষ্ণু সান্যাল
প্রথম প্রকাশ – জানুয়ারি ২০১৯
‘ওই যে ছাইগাদায় শিথিল অড়হর গাছ, ফুল এক-দুটি – ধুলোমাখা,
রোগা, মুখে তেতো হাসি-’
কবি এই লাইন দিয়ে শুরু করেছেন তাঁর চড়াই-উৎরাই পথ... এটাকে
একটা পর্বত অভিযান বলা যেতেই পারে যেখানে সাফল্য রচিত হয় ব্যর্থতাকে ছুঁয়ে দেখবার
পরে। একটা দীর্ঘ যাত্রাপথের শুরুতে অবর্ণনীয় ব্যর্থতা থাকে যার ইঙ্গিত দিয়েছেন কবি
‘প্রথম ঋতুর দাগ’ কবিতায়। একজন
সাফল্যের পূজারী তাঁর কল্পনায় ক্রমে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত স্বপ্নিল সৌন্দর্য গাছ ও
নীলিমাকে অনুভব করেন তার কথাও কবি ব্যাখ্যা করেছেন কবিতায়। আরেকটি গভীর সত্য তথা
মানসিক অনুধাবন করেছেন কবি, ‘বস্তুত ফুলে নয়, খুলে-রাখা সুশ্বেত পৃষ্ঠায় প্রথম
ঋতুর দাগ চেনা যাবে।’
কবি ‘বিপ্লবের জন্মকথা’ কবিতায় লিখেছেন এক অপার্থিব
অনুভূতির সঞ্চারণ যা সদ্যপ্রসূত বিপ্লবকে সবুজ প্রভায় আচ্ছাদিত করে রেখেছে...
‘রোদ ওঠে। চড়া
রোদ। ছিন্ন মালার মতো টিয়েরা উড়ে আসে বালিকার দিক
থেকে আমার দিকে – সবুজ প্রভা রেখে যায় আমার ভিতরে... শুধু
ওই বালিকা জেনেছে।’
কবি ‘ধানের স্বরলিপি’ কবিতায় দেখিয়েছেন একটা ধানজন্ম
ভবিতব্যের আর এক নতুন ধানের জন্মকথা রচনা করে...
ধানবীজ হয়ে
উঠি আমরা মানুষ –
নতুন ধানের
কল্পনা ও সামর্থ্য তুলে ধরি...
ইশ্বরের গোপন
প্রভাতে রেখে যাই জন্মের গোপন ইশারা।
কবি অভিজিৎ দত্তর
কবিতায় বিশেষণসমূহের চমৎকার ব্যবহার মুগ্ধ করে পাঠককে। প্রায় প্রত্যেকটি কবিতায়
বিশেষণের অনন্য ব্যবহার পাঠককে কবিতার গভীরে নিয়ে চলে যেতে পারে সহজেই...
কবি আসলেই যে
কবিতার একনিষ্ঠ সাধক তা কবি স্পষ্ট করে দিয়েছেন তাঁর এই কাব্যগ্রন্থের অনেক
কবিতার... অগ্রজদের কবিতার গভীরতায় কিভাবে তিনি ডুবে গেছেন, তা তিনি নিজস্ব
ছন্দবদ্ধ প্রচেষ্টায় ব্যখ্যা করেছেন কবিতায়।
‘এই গর্ত’
কবিতায় কবি লিখছেন...
আমার এই অন্ধ-বসবাস
থেকেই আমি পেয়ে যাচ্ছি বাতাবির সুঘ্রাণ –
আমার এই অন্ধ-বসবাস
থেকে জেনে ফেলি শাড়িটি আধাভেজা এখনও,
আমার এই
অন্ধ-বসবাস থেকে আমি টের পাচ্ছি মেয়েরা সমুদ্রবৎ
যখন পেয়েই
গেছি একটা সুড়ঙ্গ আর প্রতিরক্ষার মতো আলো
শেষকথা আমার
এই গর্ত থেকেই তোমাদের জানাচ্ছি: ‘আমি আর ফিরব না!’
কবির কাব্যগ্রন্থের নাম ‘নীল চতুর্দশী’। এই নামের তাৎপর্য
কবি বুঝিয়ে দিচ্ছেন ‘নীলচতুর্দশী’ নামাঙ্কিত একটি কবিতার বর্ণনার মধ্য নিয়ে... খুব
সহজভাবেই কবি অভিজিৎ দত্ত তাঁর কবিতার বর্ণনার মধ্য দিয়েই যেন কবিতাগুলির
শিরোনামের যথাযথ উত্তর রচনা করেছেন, পাঠককে ঠেলে দিয়েছেন এই ছান্দিক আনন্দময়তার
গভীরে যা পাঠককে মুগ্ধ করে তোলে।
‘নীলচতুর্দশী’
কবিতায় কবি এক নৈসর্গিক স্বপ্নময়তাকে কবি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন... নীলাভ
নক্ষত্রের বর্ণচ্ছটার আভায় কবি রচনা করেছেন...
ঘুমভাঙা
নীলপাখি নীল তার
গান,
কুমারসম্ভবের পাতা থেকে যেন পার্বতীর শ্রীমুখে
ফের দেগে
যায় আনন্দপ্রহার – ওঠো, জাগো,
বরণের দিন
আজ। মায়াশিকলের টান ছিঁড়ে গড়িয়ে
পড়েছে
দেখো লোহারও অশ্রু।
শেষে কবি বলছেন...
চিঠি-ওড়া
দিন মুছে
দিলে
প্রশ্বাসের নীরব-সমীরে – এসো এসো, এই দেখো
চারিদিকে
কেমন নীলের উৎসব আমাদের ঘিরে!
‘সঙ্গিনী’ কবিতায় কবি এক অন্ধ সঙ্গিনীকে রোলার ট্রাক্টার
ডাম্পারের বারবার পিষে দেওয়ার কথা বলেছেন যা এক গভীর সামাজিক ক্ষতকে ব্যখ্যা করে।
সমকালীন সময়ের পরিস্থিতি কবিকে বড় হতাশ করে তুলেছে... কিন্তু এর সঙ্গেও আর এক
জীবিত সঙ্গী যে দূরে বসে তার মৃত সঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে চুপ করে বসে আছে তার
মাধ্যমে কবি শোষিত বঞ্চিত মানবতার পাশে থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এক-পা
দু-পা করে এগিয়ে
সঙ্গী
পাঁশুটে কুনো-বেড়াল শুঁকে শুঁকে দেখছে
চোখ
কান লেজ মাথা ঘাড়... অন্ধতা!
পাঁজরের
হাড় গুঁড়িয়ে গিয়েছে একেবারে –
ডুকরে
কেঁদে ওঠে – জানে যে এই-ই শেষ!
তবু সে
যায়নি ছেড়ে, গাদায় বসে আছে দূরে।
অন্ধের অন্ধত্ব অভিশাপ নয়... তাদের নিজস্ব পৃথিবী আছে,
সেখানে তারা অন্ধকার খুঁড়ে চলে সূর্যোদয় দেখার জন্য, কলকলিয়ে ডেকে ওঠা পাখিকে ও
ফুলকে দেখার জন্য। কবি লিখেছেন এক আমোঘ উচ্চারণ...
অন্ধেরা
যে-অন্ধকার খুঁড়ে চলে প্রতিদিন সেখানে ঘটে সূর্যোদয়
পাখি
ডাকে, ফুল ফোটে, ছুঁয়ে দিলে পথেরা দাঁড়ায়-
অন্ধ-প্রতি
দৃশ্যও বদলায়।
অন্ধের হাতের মোক্ষম অস্ত্রের কথা কবি এই কবিতায় বলেছেন,
খঞ্জনি আর শক্তলাঠি... প্রত্যেক মানুষের কাছেই থাকে নিজেকে জীবনে উৎকর্ষতায় উন্নীত
করার অস্ত্র। সেটাকে খুঁজে নিতে হয়, আবিষ্কার করে নিতে হয়... প্রত্যেক মানবতার
কাছে সেটাই একমাত্র লড়াই। কবি শেষ লাইনে লিখছেন...
অন্ধেরা
ঠিক সময়ে খঞ্জনি আর শক্ত লাঠি হাতে বেরিয়ে পড়ে,
তারা
জানে- প্রতিদিন তাদের এই লাঠি শাসন করে মানুষের আঁধারকে।
‘দিঘা-সিরিজ’ নামক কবিতার সিরিজে প্রথম কবিতা ‘ডাক’এ
সমুদ্রের বর্ণনা দিয়েছেন এইভাবে...
সমুদ্র
বৈদেশিক স্পৃহা, চুড়ান্ত সচ্ছল ও পুনর্বিবাহপ্রবণ;
সক্ষম
পুরুষের মতো সে ডাকে আস্তিন গুটিয়ে,
চিকের আড়াল
থেকে গূঢ় সাড়া দিয়ে ফেলে শুদ্ধসত্ত্বা নারী,
রক্তের
কণিকায় প্রবলতর ঢেউ ওঠে,
নিষেধের
রঙ্গমঞ্চে হঠাৎ যবনিকাপতন ঘটে যায়!
এই সিরিজের ‘দেবী’ কবিতায় কবি দেখিয়েছেন সমুদ্র আর একাকী
মানুষের সাজাত্য...
সমুদ্র
ডেকেছে, তুমি যাবে।
সমুদ্রের
ভিতরে রেখে এসো ইচ্ছা, সুখ, পরবাস, মাংসাশী ঘুম, নিয়তি...
মধুভরা
ফুল হয়ে এসো কোরকে কোরকে বসুক প্রজাপতি।
যাবে,
তুমি যাবে। সমুদ্রের ভিতরে যেটুকু অনন্ত, একাকী মানুষের
ভিতরেও
সেই অনন্ত আছে, যাবে এই জেনে।
‘উপলব্ধি’ কবিতায় কবি ব্যাখ্যা করেছেন কিভাবে পুরাতনকে
অনুভব করা যায়, উপলব্ধি করা যায়। চিকিৎসক ঠাকুরদা মারা গেলেও তাঁর ব্যবহৃত জিনিস
ছুঁয়ে দেখাতে কবি খুঁজে পেয়েছেন এক গথিক সৌন্দর্য... এখানে ‘গথিক’ শব্দটা ব্যবহারে
এক অনন্য মাত্রা দিলেন কবি। গথিক আর্ট হল্য মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় স্থাপত্য শিল্প যা
এক অনন্য নান্দনিকতার প্রতিফলন ঘটায়! কবি এখানে গথিক শব্দটা ব্যবহারে এক
পুরাতাত্ত্বিক অনুধাবনকে, উপলব্ধিকে ব্যখ্যা করেছেন।
পরিশেষে বলি, একজন অগ্রজ কবির কাব্যগ্রন্থচর্চা একজন
অপেক্ষাকৃত তরুণের কাছে অনেক বেশি শিখনের ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়... এক্ষেত্রেও তাই
হয়েছে। নিজের ব্যক্তিগত অনুভূতি প্রকাশের চেষ্টা করেছি মাত্র। পরম্পরা প্রকাশন এর
তরফে ‘গৌতম দাশ’এর প্রকাশনায় কাব্যগ্রন্থটির একটি চমৎকার সুন্দর উপস্থাপনা আমাদের
সামনে হাজির হয়েছে গত বইমেলায়। রচিষ্ণু সান্যালের ছিমছাম সাবলীল প্রচ্ছদটি নজর
কাড়তে বাধ্য... ‘ক্রোড়পত্র’ কবিতায় কবি লিখছেন কবিতার জন্য উচ্চারিত চিরজাগ্রত
দুটি লাইন...
কবিতায়
জেগে ওঠে পাতাবাহারের আলো –
কবির
মৃত্যুর পর, ক্রোড়পত্র সেই আলো খায়!
No comments:
Post a Comment