'মাঘের শেষ রাত, কালকে ফাল্গুন/অকাল বসন্ত হাওয়ায় ভাইরাল'-----এই
বসন্তে সেই মস্তান নেই ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই মস্তানির শেষ চিহ্নটুকু হাতে এসে পড়ে,
‘ন্যুড স্টাডি’। 'খুঁজতে খুঁজতে এই অবেলায় তোমার দেখা'। এই মাত্রাবৃত্তের দোলায় যাঁর কবিতা প্রাণ
দোলাতে পারে, তিনি কবি পিনাকী ঠাকুর। পিনাকী ঠাকুরের কবিতা পাঠকের কাছে 'স্যুররিয়ালিস্টি ছবির মতো...' ধরা দেয় যে কখন, পাঠক টেরই পান না। এক-এক পর্যায়ে অনুভূতি পৌঁছে যায় 'সাড়ে ছ'কোটি
সাল আগের রাত'-এ, কবিতার নিজস্বতা যেন 'গ্রহাণু পৃথিবীকে ধাক্কা দেয়'। আর
প্রতিটি কবিতা টাচ করে পাঠক লীনতাপ শোষণ করে
নেন।---
‘তবুও মরিনি এই বাংলায়
পালাইনি জাভা বালি
সুমাত্রা !
ভাঙা মন্দিরে তোকেই
খুঁজেছি
নৃত্যরতার
টেরাকোটা-ইটে’
কিংবা
‘এসব দ্বীপ আজও কিশোরী
ভার্জিন
সরোম কাঁটাওয়ালা যোনিটি
মেলে দিয়ে
নিজের চোখ ঢাকে মেয়েলি
লজ্জায়...’
আবার
‘কলেজ ছুটির পর সে
নায়িকা ভাবে হায়
থ্রি এক্স ছবিতে দেখা
আসনভঙ্গিমা...’
একের পর এক কবিতায়, কবিতার ছত্রে-ছত্রে ছড়িয়ে
রয়েছে যেমন তীব্র যৌনতা, তেমনই একের পর এক ইমন রাগের কবিতারা 'রাঙা পালশের বসন্তদিন' থেকে পালিয়ে 'সুন্দরবন'-এর
দিকে দলবেঁধে ছুটে যায়।
'আদিবাসী গ্রাম ঢাকের ভাষায়
কথা বলে ওঠে'। প্রতিটি অক্ষর যেন সেই
ভাষা, 'স্পর্শ চাইছে...’। সাত মাত্রার
চলনে পিনাকী ঠাকুর যেন হাতের নাগালের বাইরে গিয়েও নিজেকে খুঁজে চলেন।
‘জীবনব্যাপী
যত দূরের রাস্তায়
পথেই পথ চেনা ক্লান্তি
মাখা চোখ...’
অথবা
'দু'মাসও
বাকি নেই,মাধ্যমিক দেবে
আগুনে ছাই খাতা
প্রশ্ন-উত্তর...
তবুও স্বপ্নেরা পোড়েনি,পড়বে না
বসেছে ফুটপাত, অঙ্ক করে যায়।'
আবার, পরের একটি কবিতায় তাকিয়ে দেখি সেই
শব্দকোলাজ। যা পিনাকী ঠাকুর প্রথম বই থেকেই করতে সক্ষম। বাংলা আধুনিক কবিতায় এটাই
যেন পিনাকী ঠাকুরের কবিতার মূল বৈশিষ্ট। নিখুঁত ছন্দে বেঁধে শব্দ দিয়ে কোলাজ তৈরি
করতে পারেন অনায়াসে। অথচ মনে হবে একটাই বাক্য, পুরো কবিতাটা। যেমন,
বাসের জন্য। অফিসের
গেটে।
লুকিয়ে রয়েছে
আগুনপাহাড়।
ব্যাংকে। বাজারে। বাচ্চার
স্কুলে।
আড়মোড়া ভাঙে
আগুনপাহাড়।
ছবির গ্যালারি।
থিয়েটার হল।
ভুলে থাকে ভাল
আগুনপাহাড়।
এইসব
কবিতায় বাস্তবতার চিত্র আমাদের চোখের সামনে যেন 'জলরঙের আঁকা'। 'আইন ভেঙে আজ চশমা ফেটে' গেলে বসন্তের
'ট্রিগারে
লেখা' ফাল্গুনে 'চোখে চোখ পড়া দু'এক
সেকেন্ড...' শিল্পময়তায় পাঠক ডুব দিয়ে উপলব্ধি করে 'জীবন কিন্তু সিরিজ লিখছে',
'সারা গায়ে শুধু সাবানের ফেনা।
জ্ঞান-অজ্ঞান... কী
যে হয়ে গেল...
জ্বালামুখ থেকে
ফুটন্ত লাভা
উগরে দিচ্ছে
আগুনপাহাড় !'
এইসব 'মাহ ভাদর' ভরা যৌনতার
কাব্যসাধনা চিরকাল পাঠককে শিহরিত করেছে । তিনি নয়ের দশকের অন্যতম রোমান্টিক কবি, তিনিই বলতে পারেন.. 'প্রথম বৃষ্টিকে পাঠালি, জাদুকরী ?' বলা যেতে পারে 'শরীরে
ঢেউ তুলে প্রেমের কবিতাটি উঠে দাঁড়ায়...' আবার প্রেমের
পাশাপাশি পিনাকী ঠাকুরের কবিতায় সমাজও উঠে আসে তীব্রভাবে,
‘আগুনে দাউদাউ
বস্তি, চালাঘর
শীতের জানুয়ারি,
মাথায় নীলাকাশ,
ক্লাবের এনে দেওয়া
ঠাণ্ডা ডালভাত
সঙ্গে রাস্তার কলের
জল শুধু
দু মাসও বাকি নেই,
মাধ্যমিক দেবে
আগুনে ছাই খাতা
প্রশ্ন-উত্তর...
তবুও স্বপ্নের না
পোড়েনি, পুড়বে না
বসেছে ফুটপাতে,
অঙ্ক করে যায়
আমার ছোট মেয়ে
মাধবী প্রামাণিক।
এখানে মাধবী প্রামাণিক একটি রূঢ় বাস্তবের
প্রতীক হয়ে ওঠে। ঊঠে আসে মাধবীর বাবার যন্ত্রণাও। আগুনে ছারখার হয়ে যাওয়া বস্তির পাশে আলো হয়ে
জ্বলে ওঠে,
‘আমার ছোট মেয়ে মাধবী প্রামাণিক’। চিরন্তন বাংলা হয়ে জ্বলে থাকে। কবিতার মতো জেগে
থাকে। আবার অন্য একটি কবিতায় দেখি ঠিক একইভাবে জেগে থাকে, সেই ‘গ্রামের ছোট
মেয়ে’----
‘সে ছিল ঘিয়া নদী। ছোট্ট। আঁকাবাঁকা।
উঠোন। ধানখেত।
ভগ্ন মন্দির’
............
‘কিশোরী মেয়েটার
এক্কা দোক্কায়
হঠাৎ লাফ দিয়ে হাসিতে বয়ে যেত।’
............
‘নদীর গলা টিপে
মেরেছে ‘সভ্যতা’।
দোকান-বাড়িঘরে
ভরাট নদীখাত।
তিস্তা রঙ্গিত
তোর্সা জলঢাকা
যখন ফুঁসে ওঠে নরুন
বর্ষায়
ঘিয়াকে মনে পড়ে।
জংলা ডুরে শাড়ি,
গ্রামের ছোট
মেয়ে...’
এইসব তীব্র অনুভূতির 'চোখের চিঠি শুধু চোখেই পড়া
যায় তলিয়ে যেতে যেতে...'।
তাঁর সশরীরে চলে যাওয়ার অব্যবহিত পরে পরে
তারকনাথ মুখোপাধ্যায়ের যথাযথ প্রচ্ছদে 'ন্যুড স্টাডি' কাব্যগ্রন্থটি
এইসবেরই স্বাক্ষর বহন করে পাঠককে পাঠ করিয়ে নেয়। ‘বসন্ত মস্তান’ ঠিক থেকে যাবেন
এইসব কবিতায় আর পাঠক-হৃদয়ে।
কাব্যগ্রন্থ : ন্যুড স্টাডি
কবি : পিনাকী ঠাকুর
প্রকাশক : সিগনেট প্রেস
দাম : ১০০ টাকা
No comments:
Post a Comment