'কবির লেখা গল্প' নিয়ে বাংলাভাষার
পাঠকদের মধ্যে একটা আলাদা কৌতূহল আছে। বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠিত কবিরা একাধিক সাহিত্য
পত্রিকা থেকে গল্প লেখার অনুরোধ পাচ্ছেন না, এটা না
হওয়াটাই অসম্ভব। কবির গদ্য যে প্রথার বাইরে গিয়ে অন্য স্বাদ নিয়ে আসে, সন্দেহ নেই। উল্টোদিকে, গল্পকারদের কবিতা লিখে
দেওয়ার জন্য রীতিমতো ঝুলোঝুলি করা হচ্ছে, এরকম আদেখলাপনা
কিন্তু দেখা যায় না তেমন। এর কারণ কী জানা নেই। তবে অনেক বিষয়ে বাঙালির অভ্যেস 'নষ্ট' করে দিয়েছেন যিনি, সেই সব্যসাচী রবীন্দ্রনাথের ওপরেই হয়তো এর দায় কিছুটা হলেও বর্তায়।
এক্ষেত্রে যে বইটিকে নিয়ে আমরা কথা বলব, 'পার্টি
বলেছিল ও সাতটি গল্প', তা কবি মৃদুল দাশগুপ্ত-এর লেখা আটটি
গল্পে সাজানো একটি গল্পসংকলন, যেগুলির কালক্রম ১৯৯৭ থেকে
শুরু করে সাম্প্রতিক, ২০১৮ অবধি। বইয়ের কথামুখে মৃদুল
লিখছেন,
"আমার গল্পগুলি কি গল্প হয়েছে? শ্যামলদা,
বরেনদা নেই। শ্যামলদার ভাই তাপসদাকে পড়িয়েছি। তিনি খুব পড়ুয়া।
তিনি 'হুঁ' বলেছেন। ওয়েব পত্রিকা
'গল্পের সময়'-এর সমীর, দেবাশিসও 'হুঁ' বলেছে।
সাহস জন্মেছে। হয়তো দুঃসাহসই। সেই সাহসেই এই বই।"
অত্যন্ত সবিনয় এই ভাষ্যটি পাঠককে বোকা
বানায়,
বুঝতে দেয় না আগামী খান-সত্তর পৃষ্ঠায় তাঁর জন্য কী অভিজ্ঞতা
অপেক্ষা করে আছে। কবির লেখা গল্পের বাজারচলতি যে ছাঁদ, প্রথম
গল্প 'গণধোলাইয়ের কারণ'-এই তাকে
আক্রমণ করেন মৃদুল। একজন যে মদ্যপ অথবা মদ্যপ নয়, কোনও
কারণে গণধোলাই খেয়েছে সে, এরকম নামমাত্র একটি প্লট রয়েছে
এই গল্পে, বাকী যা রয়েছে তা এক বিশেষ মুহূর্তের খনন ও
নির্মাণ, পাঠকের মনোযোগ চায়৷ আর মনোযোগ চায় গল্পের
প্রটাগনিস্টের নাম, মৈনাক, যা
সম্ভবত গল্পকারের 'অলটার ইগো', যাকে
আবারও 'মানসের বোন' গল্পে মূল
চরিত্র হয়ে ফিরে আসতে দেখব।
এর পরের সাতটি গল্পই অবশ্যই ন্যারেটিভ
কাঠামো অনুসরণ করে এগিয়েছে,
কিন্তু সে ন্যারেটিভ প্রায়শই অন্তর্ঘাতময় ও জাদুবাস্তবতার অংশ।
বস্তুত, ন্যারেটিভকে ভেঙেচুরে সাদামাঠা বাস্তবকে মূহুর্তে
পরাবাস্তবে পরিণত করাই মৃদুলের গল্পের একটি চরিত্রলক্ষণ বলা যেতে পারে, যার মধ্যে রয়ে গেছে তাঁর বুড়ো আঙুলের ছাপ। 'ধান...পান...
তারামাছ' গল্পটি কি প্রেমের গল্প, না ব্যর্থ বিপ্লবের, যেখানে মফস্বল হাসপাতালের
মেট্রন বনানী দত্ত তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক, কবি ও নকশাল,
মৃতুপথযাত্রী অভ্রদীপকে প্রায় দু'দশক পর
নিজের হাসপাতালে আবিষ্কার করেন।
'ভোর চারটে নাগাদ গুটিগুটি পায়ে এসে দাঁড়ালেন মেট্রন বনানী দত্ত। দেখলেন,
ঘুমোচ্ছে সে, ধূসর একটি ছায়া পড়েছে
মুখে-চোখে। অভিজ্ঞতা, তাঁকে বলল, ঠিক সময়ে এসেছেন। আলতো হাতে উষ্ণতা বুঝতে গিয়ে দেখলেন ঠোঁট নড়ছে
বিস্ফোরণের শূন্যে পৌঁছোনোর সংখ্যা পরিবর্তনের ধাঁচে, অস্পষ্ট
ধ্বনিতে শুনলেনও যেন, ধান.... পান... তারামাছ...। 'বনানী সিরিজ'- এর প্রথম কবিতা। কয়েক মিনিট যেন
কয়েক ঘণ্টা। এরপর।স্যালাইনের নল খুলে দিলেন বনানী। আর দরকার নেই।' (ধান... পান... তারামাছ..)
এখানেই শেষ করে দেওয়া যেত গল্পটা। যেকোনও
গল্পের পক্ষে এই সিদ্ধিতে পৌঁছনোও সহজ কথা নয়। কিন্তু আশ্চর্য, এখানে
থামতে চাননি গল্পকার। গল্প এগোয়, এগিয়ে মৃত্যুর এই
বিষন্নতাকে এক অযাচিত প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়, গল্পের
প্রিমাইসটিই ভেঙে পড়ে সম্পূর্ণভাবে, সে ভাঙনের ওপর
দাঁড়িয়ে যেন মজা দেখেন গল্পকার।
মজা-ই দেখেন। এই মজা কখনও তীব্র, কখনও
লঘু হয়ে ফিরে
ফিরে আসে 'একটি তেজস্ক্রিয় কাব্যগ্রন্থ', 'বাংলার ছোটখুকি', 'মানসের বোন' ইত্যাদি গল্পে। 'মানসের বোন' গল্পের সর্বাঙ্গে ঘুরে বেড়ায় এক দৈব 'মিসচিফ',
যা গল্পটিকে একইসঙ্গে সার্থক ও উপভোগ্য করেছে। 'জলপাইকাঠের এসরাজ'-এর এই কবিকে যাঁরা
ব্যক্তিগতভাবে চেনেন, তাঁরা গল্পের মধ্যে খুঁজে পাবেন
কবির অনন্য উইট ও রসিকতাকেও, এমনকি কোথাও কোথাও স্বয়ং
রক্তমাংসের মৃদুলকেও। কোনও গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্রটি কর্মজীবনের শেষপর্যায়ে এসে
কলকাতার পার্শ্ববর্তী জেলার সদর শহরে বাড়ি করে থাকে, কখনও
সে শহর খোদ শ্রীরামপুর। হাওড়া থেকে বর্ধমানগামী লোকাল ট্রেনের চলাচল উঠে আসে। উঠে
আসে রক্তমাংসের নানা চরিত্রের উল্লেখ। কখনও আল মাহমুদের ঢাকার বাড়িতে আড্ডা দিতে
দেখি তাঁকে। 'তপনকাকুর ছেলে শ্রীজাত এখন নামকরা কবি।
একেবারে বাচ্চা ছেলে। কিন্তু কত নাম। গীতিকারও সে খ্যাতনামা। এই শ্রীজাত মাঝে মাঝে
আমার গানের প্রশংসা করেছে। ফোনে মাঝে মাঝে তার সঙ্গে আমার কথা হয়।' (স্পর্শ)। সম্ভবত, লেখকের স্নেহভাজন ব্রাত্য
রাইসুর নাম এই একটিমাত্র বইয়ের সূত্রে বাংলা সাহিত্যে থেকে যাবে।
সংকলনের সবচেয়ে প্রতিশ্রুতিময় কিন্তু
শেষমেশ তা পূরণ করতে না পারা গল্পটি বোধহয় বইয়ের নাম-গল্পটি, 'পার্টি
বলেছিল'। সত্তরের অস্থির সময়ে পার্টির আন্ডারগ্রাউন্ড
কার্যকলাপের দমচাপা অনুসঙ্গ নিয়ে যে গল্প শুরু হয়, তা
শেষপর্যন্ত তা এক প্রৌঢ় সাহিত্যিকের অন্যস্বাদের প্রেমের গল্প হয়েই থেকে যায়।
সংকলনটি থেকে ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী
সেরা গল্প 'ভারতবর্ষ'। পদ্মাপারে ফেরিঘাটের রেস্তোরাঁয়
খেয়ে পয়সা না দিয়ে পালিয়ে যাওয়া দুই যুবকের সখ্যতা দিয়ে গল্পটি শুরু হয়েছিল,
তা এই উপমহাদেশের রক্তাক্ত ও করুণ ইতিহাসকে ধারণ করে রাখে।
কানপুরের নফরবাগ, ইসলামাবাদের রাওয়াল টাউন, কলকাতা, আরিচা-ঢাকা মহাসড়ককে এমনকি
আন্তর্জালকেও এক সূত্রে গেঁথে ফেলে এই গল্প যা সমস্ত তত্ত্ব-তথ্য-পার্টির বাইরে
গিয়ে শেষমেশ শুধুমাত্র মানুষের কথা বলে।
বইটি অতি যত্নে প্রকাশ করেছেন 'বোধশব্দ',
মুদ্রণ নির্ভুল ও অঙ্গসজ্জা ছিমছাম। অনুচ্চ কিন্তু পরিপাটি
প্রচ্ছদটি এঁকে দিয়েছেন শৈবাল মুখোপাধ্যায়। 'পার্টি
বলেছিল ও সাতটি গল্প' বইটি বাংলা গল্প-মানচিত্রে একটু
জরুরি সংযোজন, যা 'কবির লেখা
গল্প' হিসেবে নয়, একটি উত্তীর্ণ
গল্পসংকলন হিসেবে থেকে যাবে।
[পার্টি বলেছিল ও সাতটি গল্প। মৃদুল দাশগুপ্ত। বোধশব্দ। জানুয়ারি ২০১৯।
২০০ টাকা।]
No comments:
Post a Comment