কবিতা
এক প্রবহমান শিল্প। যেমন প্রকৃতি। সে কখনো রুক্ষ, কখনো সবুজ, কখনো মরু, কখনো হেমন্তের বিষাদে আচ্ছন্ন,
তো কখনো শীতার্ত। আবার সে-ই কখনো রুদ্র। লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া পাগল
আদিম ভালোবাসা। প্রকৃতি তাই, সবসময় বহুমুখী, বহুস্তরীয়। সে যেমন ভাবে পারে, নিজেকে প্রকাশ
করে। কবিতাও তাই। যতই তাকে চেষ্টাকৃত ভাস্কর্যের মতো করে তোলার জন্য মানুষ উঠে পড়ে
লাগুক, সে নিজের মতো করেই প্রকাশিত হয়। কথাটি হল, তাকে দেখতে পাওয়ার চোখ। চোখের চেয়েও বড় কথা অন্তরের চোখ, যাকে বলে ভিশন। শিল্প, এই অন্তদৃষ্টির সাধনা।
তাই সে আপাত স্থির পাতার মধ্যে দেখতে পায় সবুজের ক্লোরোফিলের চঞ্চলতা। দেখতে পায়
একটি সাদামাটা পাথরের মধ্যে মূর্তির রূপ। যেমন আপন মনের মাধুরী মিশায়ে সে গোলাপের
দিকে চেয়ে যখন বলে- তুমি সুন্দর, তখন সে সুন্দর হয়,
তেমন,একমাত্র সে-ই পারে দৃশ্যকে দেখার
প্রেক্ষিতকেও বদলে দিয়ে তাকে নতুন করে দেখতে। এ কারণেই শিল্প, কবিতা বহুদেশদর্শী, বহুমাত্রিক। সেই বহুমাত্রিকতার
রূপ খুঁজে পেলাম আলোচ্য কবিতার বইগুলিতে।
আব্বাচরিত/
সোহেল ইসলাম /
প্রচ্ছদঃ শুভম ভট্টাচার্য / নাটমন্দির /
মূল্যঃ ৮০
শব্দ, অক্ষর,
কথা, এই সংসার, এই যাপন আমাদের কী দেয়! মায়া। মায়া ছাড়া, জড়িয়ে
রাখা ছাড়া আর যেন কিছু দেওয়ার নেই তার। মেনে নিই। তাই নিয়ে হাঁটি আমরা। গড়ে তুলি
নিজস্ব মায়াপথ। জন্ম। হাঁটাপথ। আর কুড়োতে কুড়োতে পরিপূর্ণ করি নিজেকে। ঋদ্ধ করি।
আর এগোই। এই পথ ততদিনে আমাদের শেখায়-- ছল, চাতুরি,
ভাঙা, গড়া...কিন্তু যে স্নেহ আজন্মের,
যে স্নেহ শুধু দেওয়ার দাবি রাখে প্রতিদান পাওয়ার কোনও ইচ্ছেই যেন
নেই তার। শুধু ভালোবেসে, আগলে, স্নেহে
ভরিয়ে রাখা এই স্নেহ বোধহয় সন্তানস্নেহ... লোভ নেই তার। আশা নেই তার। নিয়ম নেই।
নীতি নেই। শুধু ভালোবাসার, স্নেহের বীজ রোপণ করাই তার কাজ
যেন...
"‘মা
বাটনায়
ডাল বাটছে
কুমড়ো
ফুলের বড়া হবে আজ
লণ্ঠনের
ছায়া তেলের কড়াইয়ে
দেখলে
মনে হয় না
কোথাও
কোনো দুঃখ আছে
মা
স্বাধীনতা চেনে না
ইংরেজ
তাড়ায়নি
অভাব
সারাতে সারাতে শিখিয়েছে –
বেঁচে
থাকা কাকে বলে!’
(২নং কবিতা)
এ
মা যেন সেই চিরন্তন নারী। বাংলার মা। ভোর থেকে রাতের প্রহর পর্যন্ত যার দিন কাটে
সংসারের চিন্তায়... সন্তানের মুখে ভাত তুলে দেওয়ার চিন্তায়। এই নারীর নিজস্ব কোনও
স্বত্ত্বা নেই। সংসার,
মায়া, সন্তান, অভাব,
দুঃখ, কুমড়ো ফুল, লণ্ঠনের ছায়া নিয়ে শুধু বেঁচে থাকা তার। আর এসবই তাঁর জীবনের অঙ্গ।
অধিকার। ভালোবাসা। বেঁচে ওঠা। আর কবি সোহেল ইসলাম তাঁর মা'কে করে তুলছেন বাংলার মা। বাংলার ঘরের, মাটির
মা। চিরন্তন নারীসত্ত্বার নিপুণ এক চিত্র ফুটে উঠেছে কবিতাটির অক্ষরে, অক্ষরে।
'তোমাকে
পাওয়া ততটুকুই
যতটা
না পেলে ফসলের ঘুম ভাঙত না।
মাছরাঙা
জলের পেট থেকে মাছ তুলে আনতে
ঠোঁটটাকে
যতটুকু জলে ভেজায়
ততটুকুই
তোমাকে পাওয়া’
এই
মুখোশের পৃথিবীতে একমাত্র স্নেহকে বিশ্বাস করা যায়। একমাত্র তার কাছে পেতে ধরা
যেতে পারে সংসারকে। তাই হয়তো কবি যখন, " উনুনের তিনটি
মাথাকে মা/ বাবা, আমি ও ভাই বলিয়া ডাকিতেন' সেখানে বিচ্ছেদ আসাটাই স্বাভাবিক। কেননা,
মায়ার সংসারে মানুষই তো ক্ষণভঙ্গুর। তাকে
সামলাবে কে! তাকে আটকাবেই বা কে! তাই বিচ্ছেদ, বিরহ
যেমন করুণ করে তোলে জীবনযাত্রাকে আবার সেই শূন্যস্থানে এসে বসে অন্য কেউ। হোক না
সে সন্তান... মায়াই তো! পুরো কবিতাটি পড়া যাক একবার...
"উনুনের তিনটি মাথাকে মা
বাবা, আমি
ও ভাই বলিয়া ডাকিতেন
বাবা
যাইবার দিন এক মাথা ভাঙিয়া গিয়াছিল
মা
আর ঠিক করেন নাই
সেদিক
থেকে আগুনের শিখা বাহির হইতে দেখিলে
মা
ভাবিতেন বাবা হাত বাড়াইয়া ডাকিতেছেন
এই
করিয়া কতবার হাত জ্বালাইয়াছেন
আমরা
সে হাতে মলম লাগাইতেছি’'
এইযে
সন্ধ্যার বাতাস,
আবছা আলো, ভাঙা গড়া ঢুকে পড়ছে
অক্ষরের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে... ধর্ম নেই, রাজনীতি নেই...
অথচ পুরো নির্ভয়ের আশ্রয়ও নেই... ছেলেখেলার মত করেও তাকে ভাবা যাচ্ছে না। তাই তৈরি
হচ্ছে মানসিক যন্ত্রণা। কষ্ট। বানানো
সংসারে ' কতদিন মা'কে বিড়াল
বানিয়েছি/ আঁশবটি/ কলাপাতাও বানিয়েছি কয়েকদিন'। এখানে মা
যেন সর্বংসহা প্রকৃতি। তাঁকে সন্তান যেন সাজিয়ে তুলছে, ত্রাতা
হিসেবে, প্রেমিকা, কখনও বা শেষ
মাপকাঠি হিসেবে। প্রকৃতিও অবুঝ সন্তানদের বোঝানোর চেষ্টা করে। কিংবা হয়ত সন্তানকে
ঈশ্বর সাজিয়ে নিজেই তার খেলার সঙ্গী হয়ে পড়ে। তারপর হাল ছেড়ে নির্ভর করে সেই
সন্তানদের ওপরে... আর তখন সবকিছু ছেড়ে " শুধু কোরানের কালো অক্ষর দিয়ে/ ঘর
মোছে সারাদিন"।
' বারান্দার
টেবিলে কালো ব্যাগ দেখলে ভুল করি
এই
বুঝি ফিরে এল লোকটা
হাতধোয়া
জলের শব্দে বুঝতে পারি
রেগে
আছে লোকটা
মেঘ
জানে না,
পাটিগণিত-বীজগণিত
জানে
না আব্বার রাগ জলের মতো’।
কবিতাটির
প্রথমে একটা সাসপেনশন কাজ করছে। কে ফিরে এল? কার ফেরার কথা ছিল?
অথচ, এতদিনের অপেক্ষা পেরিয়ে যেন সে
আসতে পারছে না কিছুতেই... রহস্য? ত
অনুভব? অনুভব
আর অনুভব। শেষ হয় মায়া দিয়ে। হৃদয়ের আকুতি। এছাড়া আর কী আছে একজন কবির কাছে। কিছু
বহু ব্যবহৃত শব্দ। অক্ষর। ধ্বনি। তার কাছেই শুধু তাঁর সমর্পণ। আশা।
ভরসা। তার কাছে স্নেহ, মায়া, মমতা
আর বেঁচে থাকা সবাইকে নিয়ে... ভাগী হওয়া এই মায়ার কাছে... স্নেহের কাছে তাই তো 'আব্বাচরিত'! তাঁর ছোট গৃহকোন যেন বিশাল
পৃথিবীর অংশ। সমস্ত পৃথিবীর আয়না যেন এই ঘর, গ্রাম। মাঠ,
পথ। তাই এই পারিবারিক যাপনেও এসে ভাগ বসায় রাজনীতি, বিপ্লব, ভবিষ্যতের
স্বপ্ন...
'বাবা
আমাদের জন্য রেখে গেলেন
মানপাতায়
ছাওয়া ঘর,
একটা উঠোন
তোমরা
যাকে হিন্দুত্ববাদের অধিকার ভেবেছ
সেই
উঠোনের তুলসীতলাকেই আমরা
কোরান
মেনেছি।’
'আব্বাচরিত'
বইটি পড়তে পড়তে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যেতে হয়। মনেহয়, এই যাপন, এই কাল, এই
সময় যেন পাট পাট করে সাজানো আমার নিজস্ব জীবন। নিজের সংসার। হাসি, কান্না, বিরহ, কষ্ট, বিচ্ছেদ...
সবকিছু মিলিয়ে মিশিয়ে একটা চলন্ত সমাজ। নিজের শৈশব, কৈশোর, যৌবন
ছাড়াও বৈপ্লবিক সত্ত্বাকেও প্রতিবিম্ব করতে পারে এই কাব্যগ্রন্থটি। তাই হয়ত কবি
ধর্মকে অস্বীকার করতে পারেন সহজেই। মা-বাবা, সংসার,
ডাল ভাতের সংসারের কাছে কতটুকু প্রয়োজন ধর্মগ্রন্থের! ঘর
মোছার মত? নাকি কবি বুঝিয়ে দিতে পেরেছেন সামান্য অক্ষর
দিয়ে ধর্মগ্রন্থ বানানো যায়। রুলস এবং রেগুলেশন বানানো যায়। কিন্তু আস্ত একটা
জলজ্যান্ত জীবনের জন্য চাই মায়ার জমাট বাঁধন। শক্ত গিঁট। আর
কে না জানে, একটা সমাজ তৈরি হয় নিজের সুবিধার্থে। যার
প্রতিফলন হতে পারে একটা পরিবার!
পিতাপুরাণ/
প্রীতম বসাক /
প্রচ্ছদঃ হিরণ মিত্র/ বৈভাষিক / মূল্যঃ ১২০
Poets utter great and
wise things which they do not themselves understand' (PLATO)
উৎসর্গে
"মাকু, তন্তুবিদ্যা / এবং/ পোশাকশিল্প/ অথবা/
ক্রুশবিদ্ধ পিতাকে"
এটাকেই
পিতাপুরাণের বিভাব কবিতা বলা যেতে পারে... কাব্যগ্রন্থটির পরিচয় বহন করছে এই
উৎসর্গ পৃষ্ঠাটি যেন। তারপর পাতার পর পাতা একজন সহজ, সরল, আটপৌরে সমাজের পিতা হয়ে ওঠা যেন! যেন জন্ম জন্মান্তরের ধ্যান ভেঙে জেগে
উঠছে তাঁর পিতৃসত্ত্বা। বুভুক্ষু স্নেহ আজ দয়া করে স্পর্শ করাচ্ছে নিবিড় হৃদয়ের। একান্তে
থাকা সেই হৃদয়ের ছবি, অনুরণন করে যাচ্ছেন কবি
প্রীতম বসাক, তাঁর পিতাপুরাণ কাব্যগ্রন্থটিতে।
ফিরে
আসছে পুরানো এক দৃশ্য। পুনরাবৃত্তি
ঘটছে দৃশ্যের। সেই কবে ছেড়ে আসা শৈশব, কৈশোর আজ যেন আবার
সন্তানরূপে ফিরে আসছে কাছে। সেই জলছবির স্নানযাত্রা নিয়ে কবিজন্ম থেকে তৈরি হচ্ছে
পিতাজন্ম। আর কে না জানে, ' বাবারা এমন দৃশ্যের জন্ম দেন
অবিরত '... আর সেই দৃশ্যের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে গাছের অবতলে।
টিকরে উঠছে রোদ। একটা ঘূর্ণন জমে উঠছে সারাটা ফেরার পথে। জীবন মানে যারা শুধু বলেন
শুধু এগোনো, ভুল
আসলে। জীবন
মানেই শুধু এক পা এগোনো তো দু পা ফিরে তাকানো স্মৃতির দিকে, ছেড়ে আসা মলাটের দিকে। নিজস্ব ক্ষেত্রফলে পেখম তুলে সেই নাচটাই নেচে
যাওয়াই জীবন। মায়া। আলো। ভালোবাসা। সংসার। এই
মায়ার রঙই দিতে পারেএকটা পেন্সিল। তারপর? ' বেরিয়ে এসো
মানুষের সন্তান। খেলা করি। চুমু খাই।'
ততক্ষণে
এসে ঘরে ঢুকে পড়েছে 'অপাপবিদ্ধ ক্রন্দন'। 'পিতা আর মাতা কুটকুট করে ধান ভাঙে'...শব্দ
ছড়ায় দিকদিগন্তে। চারপাশে কী শাঁখ বাজে? নাকি মুক্তির
আনন্দ! গান! স্নেহ তুলে ধরে মায়ালণ্ঠন।
' চলো
ফসলের আবেগে মানত রাখি
বিছানা
জুড়ে যেন খলবল করে
সম্ভাবনাময়
মৃৎশিল্প '
আর
একজন সাধারণ অক্ষর সাধক,
একজন সামান্য পথিক, ঈশ্বরের বার্তা পেয়ে
নিজেকে পিতা রূপে সাজিয়ে তোলেন। গল্প আঁকেন আর দৃশ্যফল ভাগ করে নেন সমস্ত পৃথিবীর
কাছে।
'we are all
old-timers/ each of us holds a locked razor' ( লাওয়েল)
'আকন্ঠ
পিতা হওয়া কি মুখের কথা বলো!' আর সেই গতজন্মের রহস্য
কুড়াতে কুড়াতে ' ফোকলা দিগম্বরী' র কাছে নিজেকে সমর্পণ করছেন কবি। নিয়ম অনুয়ায়ী জন্মের ষষ্ঠ দিন পরিচয়ের
দিন। কথিত আছে, ওইদিন শিশু চিনতে শেখে দৃশ্য। আলো। আপনদের।
এই মায়ার সংসারে ঢুকে পড়ে আস্তে আস্তে। ' এখান থেকেই তোকে
তুলে আমাদের গর্ভে স্থাপন করেছি প্রতিদিন জল দিয়েছি হাওয়া করেছি...' মায়া, মায়া
আর মায়া। হাসি, কান্না,
যাপনপর্বের সমস্ত টুকুই যেন মায়ার খেলায় ভরিয়ে রেখেছে শিশু। উড়ে
বেড়ানো পথিককে করেছে 'সেবাদাস'... একজন পিতা এই দৃশ্যের মোহে নিজেকে সমর্পণ করতে পেরে নিজেই নিজের কাছে
ধন্য হয়ে উঠছেন যেন! কান পেতে ধরার চেষ্টা করছেন সেই অনন্তের কথা। জাদুবিদ্যা আর
রহস্য কুড়োতে কুড়োতে হয়ে উঠছেন আকণ্ঠ পিতা।
"তোমার সঙ্গে বড়ো হচ্ছে পিতাজন্ম
এই
যে
তোমার
হাতে দিয়ে যাচ্ছি কবিয়াল
এই
যে
উঠোনে
পুঁতছি গানের বীজ
এই
যে
তালুতে
রাখছি আমলকী
আর
মায়ের দুধে এসে বসছে ঢেউ প্রণালী
তুমি
খুঁজে দিয়ো এ দীনের আলখাল্লা
খুঁজে
দিও পাখি সম্পর্কিত ম্যাপবই "
আর
এই ম্যাপবই নিয়ে,
খেলাধুলা নিয়ে, ঘোড়া হওয়া, রহস্যঘন সংলাপ পেরিয়ে পিতা হয়ে উঠেন কবি প্রীতম বসাক। আঙুলে তাঁর
ছু-মন্তর। চোখে তাঁর স্নেহময় নিবিড়তর দৃশ্য। ভয় ভেঙে, সংলাপ
ভেঙে হাঁটাপথ এসে বসে সংসারে। মায়ায়... ভাতের গন্ধে। আকুলিবিকুলিতে...
"জানো তো আমারও প্রিয় শব্দ ভাত
এই
যে তোমার মুখে
একটা
একটা করে
অশ্রুদানা
তুলে ধরছি
জেনো
নিজেকেই টিপে টিপে
দেখছি
আমি
দেখছি
যথাযথ সেদ্ধ হয়েছি কিনা
ভাত
হওয়া কি মুখের কথা বলো
বাবা
হওয়া"
স্বপ্নপুরাণ /
মানসকুমার চিনি /প্রচ্ছদ
ভাবনাঃ কবি /শ্রীরামপুর
প্রেস /
মূল্যঃ ৩০ টাকা
'The Poet, therefore,
is truly the thief of fire' ( র্যাঁবো)
কবি
তাঁর কবিতার মধ্যে কাকে খোঁজেন? কার অপেক্ষায় পাতার পর
পাতা ভরে তোলেন কালির আঁচড়ে! শূন্যতার কথা, রিক্ততার কথা,
অনুভূতি, অনুভবের কথা তুলে শুধু নিজেকে
তুলে ধরেন রোজ। রোজ শুধু নিজেকে খুঁড়ে তোলাই কাজ। কবিতা, অক্ষর, শব্দ নিয়েই তাঁর
ঘর, সংসার। সুখ দুখ। এই বিষাদের আসবাবই তাঁর ঘরের
সাজসজ্জা। আর তাই জন্ম নেয় বিষাদবোধ ' অক্ষম আমার বহন
ক্ষমতা বলে/ জীবন থেকে পালিয়ে বহুদূরে / পাখির বাসার কোটরে থাকি।' এই কোটর যেখানে শুধুমাত্র একটি পাখিই থাকতে পারে। একটি পাখিই 'তা' দিতে পারে ভবিষ্যৎ জন্মের। এই জন্ম যেন
ভারবাহী একাকীত্বের ফসল। কবি সেই মাঠে একা এসে দাঁড়ান। তুলে
নেন গাছের পাতা। শিকড়ে আঘাত করেন নিষ্ঠুরভাবে... কিন্তু এই নিষ্ঠুরতা কোথা থেকে
পান কবি? সমাজ? সংসার? নাকি একাকীত্ব বোধ থেকে? কেননা, '... বিবাহ
বাসরকে ধ্বংস করি/ দেখি সাদা কাগজের শিকড়ে/ জীবনের বিষাদ ফুটে আছে।' ( উৎসর্গপত্রের জীবন)
'দূরের
পাখিরা উড়ে যায়
ঘুণ
ধরা গাছে,
চিঠিতে এত কান্না ছিল বলে
ভূমিকম্পে
ভেঙে পড়ে ঘরবাড়ি... '
আমাদের
কোথাও যেন দুলিয়ে দিয়ে যায়। ধাক্কা মারে। স্বাভাবিক অনিবার্যতার দেওয়ালে চিড়
ধরেছে। ফাটলে তার দৃশ্য স্পষ্ট। কিন্তু সাজানো ঘর যখন
ভেঙে যায়, যখন বুঝতে পারি ধ্বংস স্বাভাবিক, অনিবার্য
তখনও মন বোধহয় সান্ত্বনা খোঁজে। না থাকা, থাকা গুলিয়ে যায় তখন। পাখি উড়ে গেলে, শব্দ
ভেঙে গেলে কী দরকার আর এই ঘরবাড়ির...মহাসময়ের আত্মা, বুকে
পোষমানা শূন্যতা তখন নিয়তি হয়ে দাঁড়ায়।
" হে নিরবধি কাল
এই
যে অশ্রু ঝরছে
তুমি
দেখবে না?
মহাসময়ের
আত্মা কথা বলছে
যে
শুনতে পায় তার জন্য
মহাকালের
ঘোড়া রাখি।
গাঢ়
হচ্ছে শূন্যতা, বুকে
পাথর জমছে
নিয়তি
কার?
তোমার না আমার? " ( অশ্রুপাত)
তোমার
না আমার?
সত্যিই তো! কোনদিকে মোড় নেবে এই অনিয়ন্ত্রিত ভাগ্যরেখা! কাকে এনে
বসাবে এই সাকার্সের দড়ির ওপর! জানা নেই? জানি না! প্রতি
মুহুর্তের লোভ হিংসা লালসা শুধু শুকনো পথের দিকে হেঁটে চলেছে। তার মায়া নেই,
ঘর নেই, বসবাসও নেই সম্ভবত। আর
এখানেই কবি যেন নিজেকেও সামিল করে নিতে চান। কিন্তু ব্যর্থতা যে তাঁর চির সঙ্গী।
বুকের পাথর আর গুড়িয়ে যেতে পারে না কিছুতেই। শুধু গাঢ় শূন্যতা নিয়ে, ভাঙা পথ তাঁকে জানান দেয় এটাই নিয়তি, ভবিতব্য...
" গুপ্ত সংঘের কোনও অনুমতি নেই
তাই
সংকল্প যাত্রা নিরর্থক
পৃথিবীর
অভিজ্ঞান হলে
তার
দুই চক্ষুপটে ভাব বিনিময় চলে
অনন্ত
আত্মা যে কারুকার্যময়
অনিত্য
অধিবাস পায়
অচিরে
ক্ষুধার চাপ বাড়ায়
তুমি
স্থাপন করেছ অসীম সম্ভাবনা
সেই
থেকে দুলছে লুব্ধক
অধীন
কুশলবার্তাবহ পর্যটক ( পর্যটক)
কবিতাটি
যেন মেট্রোপলিশ শহরের এক মুখ ও মুখোশের কথা বলে চলে। যেন অনিবার্য এক সঙ্কেত বহন
করে চলেছে এই ব্যর্থ সংকল্পের কাল। নিরবধি যে পথ শুধু সুখের দস্তানা পরে অপরের
ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে... তার সেই ব্যর্থতা, অভিমান সংকল্প আজ
পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। ঘটে যাওয়া কাল, ভিশন আজ মুখোমুখি
দাঁড়িয়েছে। আর
সেই পর্যটক অপ্রয়োজনীয় পথের কাছে লুব্ধকের মতো পথভ্রষ্ট! নিঃসঙ্গ।
' ভিখিরির
খিদে ছুঁয়ে দেখি পরম বিস্ময়/ আশ্চর্য শরীরের জাদুমন্দ্র সম্পর্কের..' ভিখারির খিদে? যুগ যুগ যুগান্ত ধরে যার কাছে
খিদেটাই অভ্যেস, খিদেটাই মুখ্য তাদের কাছে খিদের রঙ কেমন? ধূসর?
নীলাভ? নাকি লালাময় একটা লোভ?
নাকি এটাই বেঁচে থাকা... রসালো পৃথিবীর বিরুদ্ধে
যুদ্ধ ঘোষণা! আমরা
জানি না, যেহেতু খিদে মানে আমাদের কাছে শিবরাত্রির উপোস।
খিদে মানে আমাদের ডায়েট চার্ট মেইনটেইন করা! তবে শিকল ছিঁড়ে অন্ধের মুখেও আলো পড়ে, আর
তাতেই কবির সন্দেহ! কেননা,
এই পৃথিবীতে সহজ বলে কিছু নেই। আসল বলে কিছু। এক
নিরাশাযুক্ত ঘোরে জন্ম নিয়েছে সংসার। তার রঙ লাল। যুদ্ধের?কারণ 'কুলদেবতা, পিছনে
সাপ/ অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে/ দশাবতার তাস ফেলে/ ব্রহ্মস্বাদে ডুবে আছে শাস্ত্রমত।'
'বাংলা
১৩৬৩ বঙ্গাব্দে পঞ্জিকামতে যার জন্ম/ সে পোড়া মূর্তি দেখে ভয় পায়'--- ফাটা মাঠ। দুর্ভিক্ষের কাল ভেঙে নেমে আসা এই জরাজীর্ণ শিব, তৃষ্ণার্ত
মন নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন শুকনো নদীর দিকে। বিনীত ভিক্ষাপাত্রে কে তুলে দেবে বুনো ওল,
মানকচু। সব পুড়ে গেছে এই বাংলার, মাটি, ঘাস...
জল। এই পোড়া দেশের চোখে মরিচিকার ভার বহন করছে নদী! আর
তাই ' ঘণ্টা বাজে সুধার পাত্রে, গন্ধসুধা/
এই পাতালে রক্ত ওঠে রক্ত জ্বলে' কিন্তু তবুও লুপ্ত শিলার
অঙ্গ জুড়ে প্রতিধ্বনি / আতসকাঁচের মতো জ্বলে কুষ্ঠরোগী '
একাকীত্ব
কী শুধুমাত্রই অভ্যেস একটা! অভ্যেস মানেই তো সাধনা। চিরাচরিত প্রথা ভেঙে এগোই
যাওয়া কোন এক স্বপ্নের দেশে। হ্যাঁ স্বপ্নই তো, মনের কুঠুরিতে পুষে
রাখা সন্দর্পনে আলোক বিন্দু, কেউনা জানুক, ভাবুক তাইতো। কবিকে তবে হাঁটতে চেয়েছেন ওই গোপন কুঠুরির দিকে। যে
কুঠুরি ছুঁয়েছে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রের রথের চাকা, ভীষ্মের
মুকুট অথবা ইলিয়াস থেকে উঠে আসা দেবীর স্তন। দৌড়ে গেছেন পরাশরের কাছে শব্দের মানে
খুঁজতে আবার মায়ের কাছে বসেছেন বর্ণপরিচয়ের যুক্তাক্ষর খুলে। পাণিনি তখন চুপ করে
হাসছেন। চুপ করে ভাবছেন, এইযে হেঁটে আসছে প্রস্তর যুগ,
সেখানে কী সুশীতল জলের আভাস পিয়াস মেটাতে পারবে! বিষ্ণুপুরের
রাসে ভাঙা বাঁশির সুর তো পিরামিডে নিজস্ব আত্মাকে দান করেছে তাঁর কবিতারা! একই
আত্মতুষ্টি! নাকি হত্যা! হত্যা শব্দটি মানানসই হবে না কারন সবটুকু লেখা এসে
পৌঁছেছে সাক্ষাৎ বর্তমানে--- যেখানে অতীতের মৃত্যুস্তুপ নেই নাকি ভবিষ্যতের
ভুলভ্রান্তিময় আশা-নিরাশা।
লাল
কাঁকড়ার গর্ত /
শাশ্বত গঙ্গোপাধ্যায় / প্রচ্ছদঃ শোভন পাত্র /
সপ্তর্ষি /
মূল্যঃ ৭৫
"ধুতুরা নেশার বীজ, চোখ থেকে ঝরা জবাফুল
তান্ত্রিক
ছিটিয়ে দেয় শান্তিজল,
গ্রীষ্মে কিংবা শীতে
সমস্ত
শ্মশানে পোড়া টুকরো টুকরো স্তন, নাভি, যোনি
করোটির
ঢাকনা খুলি,
ধোঁয়া ওঠে, বাষ্প শুষে নিতে"
( নেশা)
অক্ষরবৃত্তের
সুনিপুণ কৌশলে কবি তাঁর প্রেম, বিরহ, গল্প, পথ সাজিয়েছেন একের পর এক। গভীর দর্শনের
দিকে এগিয়ে যাওয়া পথ। রাস্তা তাঁর। অনুভূতি মালায় সেজে উঠেছে একে একে 'ক্লান্ত ফুসফুস'। প্রতিটি কবিতাই যেন বলার
জন্য, ভাবার জন্য এসেছে... ছুঁতে পেরে চলে যাচ্ছে গভীর
থেকে গভীরতম এক উজানে। খুঁজে চলা পথের দিকেই ' যে কবিতা
লিখতে বসে, শেষ
করতে পারিনি কখনও / আধভাঙা লাইন একা পড়ে আছে, ডাকে;
কাছে শোন/ ক্লান্ত ফুসফুস, বসে যাওয়া গলা, শব্দ ছেঁড়া ছেঁড়া / যেন শেষরাতে উরু ভেঙে পড়ে থাকা দুর্যোধন'( দুর্যোধন)।
হৃদয়ের
খোঁজ সহজ নয় বলেই হয়ত সত্য
এই পথপরিক্রমা। এই অন্বেষণ। শিসমহলে ঝলসে ওঠে নিজস্ব অবয়ব।
গৃহপালিত জোনাকির খোঁজে
হেঁটে
বেড়ায় জলবন্দী নূপুর। জলস্রোত ভেসে যায় দূরে। ভাসায় কাকে! আর তখনই কবি তৈরী করেন
এলাচ দিঘি। 'প্রেরণা', 'ভাইরাস' 'ক্যাজুয়াল
লিভ' 'টেরোড্যাকটিল' 'ম্যাসাজ
পার্লার' দুর্দান্ত একেকটি কবিতা। নতুন নতুন শব্দের
ব্যবহার, ইমেজের ব্যবহার, ধ্বনি
সৃষ্টি প্রতিটি কবিতাটিকে এক আশ্চর্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে। সাজিয়ে তুলেছে। বহতা
নদীর মতো। এরকমই একটি --
" বান্ধবী আমার কাছে সিলখোলা নতুন সাবান
অচেনা
লেবুর গন্ধ,
স্নান করতে গিয়ে কলঘরে
দুজনেই
চিনে নিই ঢেকে রাখা কালশিটে দাগ
শুধু
ফেনা ধুয়ে যায়,
শুধু পূর্বজন্ম মনে পড়ে'' ( জাতিস্মর)
তারপর
শুরু হয় আবার আরেকটি বিরাট
যাত্রা। পথ। জার্নি। দুধারে কাঁটাঝোপ। ক্ষুধার দোকান। কবি যেন ভ্রমণের জন্য
ভ্রমণের গান খুঁজে বেড়াচ্ছেন। স্থির নন। আবার অস্থির হয়ে তাড়াহুড়োতে হারিয়েও
ফেলছেন না চাবির রিং। বরং বলা যায়, তর্জণীর ফাঁকে চক্কর
কাটছে কাল, সময়---ইতিহাস ভূগোল।
' 'যে
পাঠক লুকিয়ে, তাকে
টর্চ জ্বলে চিনে নিতে চাই
কে
আসলে সে,
বাংলা ভাষার কোন রোগা দেবদূত?
কে
পড়ে আমার লেখা?
বইমেলা থেকে কিনে
গাছের
ছায়ায় বসে সে কি কোনও টুপিপরা ভূত?'
তেমনি
অজস্র তদন্তপুর পেরিয়ে,
যোগফল ভেঙে কবি লিখে ফেলেন 'শরীরের সব
কোষ,পেশি, তন্তু, টিস্যুর ভেতরে' জিভের সাহস। বাজে গালিবের
বাঁশি। জামশেদপুর তখন চুপ থাকে। 'চিলাপাতার জঙ্গলে খুঁজে
পাবে রামগুয়া গাছ'। আর অদ্ভুত গোলাপী রক্তে
শোনে আটাকলের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর শব্দ। আর গরম হয়ে ওঠা হেমন্ত যুগের স্রোতে ভাসে। '
করোটির ঢাকনা খুলি, ধোঁয়া ওঠে, বাষ্প
শুষে নিতে'...
কাব্যগ্রন্থটি
জুড়ে বসবাস করছে অসংখ্য লাল লাল কাঁকড়ারা। অতল গর্ত থেকে মাঝেমধ্যে ভেসে ওঠে। আর
শোনায় '
কালচিতি সাপ, ঘড়িহীন দেশ, সিল্করুট ট্রিপ, রায়মাটাং বনবাংলো- র কাহিনী। তারপর?
তারপর নেশা আর ব্রহ্মকমল- এ চুপচাপ বসে থাকে।
প্রচ্ছদটি
অপূর্ব। রঙ আর ইমেজের সঙ্গে ফুটে উঠেছে এক মোহমুগ্ধ লাল কাঁকড়ার গর্ত।
প্রাসঙ্গিকতা ভেঙে জেগে উঠছে মোহনীয় রূপের প্রকাশ। শব্দের অলঙ্কার ঘুরে বেড়াচ্ছে
প্রচ্ছদ এবং কাব্যগ্রন্থটিতে। নতুন এক জার্নি। তাই এখানে পাঠকও আবিষ্কারক।
নতুনভাবে,
নতুন শব্দটোনায় মগ্ধ। ঠিক যেন যাদু কাঠি ছুঁইয়ে দিয়েছেন কবি,
মায়ার বন্ধকে। আর পাঠক হারিয়ে যাচ্ছে অপূর্ব ভালোলাগায়।
ইশারা
অমনিবাস /
সুজিত দাস /
প্রচ্ছদঃ দেবাশিস সাহা /
সিগনেট প্রেস /
মূল্য ঃ ১০০
"বরেলি বাজারে ঝুমকো হারিয়ে ফেলার পর
উদভ্রান্তের
মতো তুমি যখন খুঁজে বেড়াচ্ছ হিরের দানা..."( লাস্ট পোস্ট)
কবি
সুজিত দাসের কাব্যগ্রন্থ "ইশারা অমানিবাস" মায়াবী এক কবিতার বই। অবশ্য
মায়াবী বললে খুব কম কিছু বলা হয়। কারণ মায়া অনেকসময়েই এক অসত্য আবহের মধ্যে আমাদের
ঠেলে দেয়। শব্দের মোহ আর কল্পনা এনে দিতে পারে সেই মায়াঘেরা অতল " যে
প্রমোদতরণী ভেসে গেছে হাজার নটিক্যাল মেইল দূরে এক স্তব্ধতার লিরিকে, তাকেই খুঁজে বেড়াচ্ছি ম্যাজিক টেলিস্কোপ দিয়ে'।
আমরা যদি ভালো করে লক্ষ্য করি তাঁর কবিতা, তবে হয়ত পেতে
পারি ম্যাজিক রিয়ালিজমের পৃথিবী। এই ম্যাজিক রিয়ালিজম তো লাতিন আমেরিকার মতো না। এ
হলো দেশজ। দেশজ আধুনিকতার যে জায়গায় আমাদের ভাষার সৃষ্টিগুলি একসময়ে সৃজনশীল হয়ে
নিজেদের প্রতিফলিত করত, ইউরোপীয় আধুনিকতা আসার পর থেকে তা,
তার লোকাস পরিবর্তন করে। স্বাভাবিক ভাবেই, ইউরোপীয় আধুনিকতার পথকেই আমাদের সাহিত্যে ধরা হয় আধুনিকতার পরাকাষ্ঠা
হিসেবে। কিন্তু এই ধারণা যে সত্য নয়, তা এখন প্রমাণিত।
দেশজ আধুনিকতার যে রাস্তা আমাদের জীবনে, যাপনে ছিল,
সেই পথ ধরে হেঁটে গেলে যে কত বিভোর দৃশ্য ও অসামান্য দর্শন
আমাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করে, তা বলাই বাহুল্য। এ নিয়ে এক
স্বতন্ত্র আলোচনা হতে পারে, কীভাবে দেশজ আধুনিকতার রাস্তা
ছেড়ে ইউরোপীয় আধুনিকতার পথকেই আমরা আধুনিকতার মূল রাস্তা হিসেবে ধরে নিলাম। তা
হয়তো এখানেই কখনো আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেব। কিন্তু এই ভাবনা যে মাথায় এলো,
তার কারণ দেশজ আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য হল, তাকে
কিছুই চাপা দিয়ে রাখতে পারে না, বা তার অভিযাত্রাকে কিছুই
সরিয়ে দিতে পারে না তার রাস্তা থেকে।
" রণথম্ভোর ন্যাশনাল পার্কে তুমি দাঁড়িয়ে আছো। সেক্টর ফাইভে তুমি দাঁড়িয়ে
আছো, তুমি দাঁড়িয়ে আছো সাহু নদীর পারে।
মৃগনাভি
নিয়ে,
ল্যাপটপ নিয়ে, অনুচ্চারিত স্রোত নিয়ে
তুমি
কী নির্জন দাঁড়িয়ে আছ!
এই
বাদরিয়া আকাশ ভুলে গিয়ে,
পুরুষ পেখমকে তুচ্ছ করে
কী
নিষ্ঠুর এই দাঁড়িয়ে থাকা!"
যেমন
এই বিশ্বায়নের যুগেও পরিবর্তন হয় না বাংলার মাঠ, ঘাট, গাছ, পাখি, প্রকৃতি,
পরিবর্তন হয় না বাংলার পুরাণ, শিকড়,
কাহিনি, রঙ, রীতি, প্রথা, তেমন
আমাদের আবহমান অবচেতনার স্তরে স্তরে প্রবাহিত হতে থাকে অখণ্ড চেতনার এক ধারা। তাই
কবির কবিতায় চলে আসে বিভিন্ন কথা ও কাহিনি। আমাদের লোকগাথাগুলির মধ্যে, বিভিন্ন কাব্যের মধ্যে, রীতিপ্রথা পালনের
মধ্যে, গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে যে সব লুকিয়ে থাকা
কাকচরিত্র গুনগুন করে ওঠে, তা বয়ে চলেছে ঠিক কত বছর ধরে
আমরা কেউ জানি না। অথচ, সেই সব স্বর, সুর, চিত্র, দর্শন
মিলিয়েই আমাদের মন। তাই বড় চেনা লাগে। সুজিত দাসের কবিতা তাই আমাদের শিকড় ধরে টান
দেয়। সন্ধেবেলায় পড়তে পড়তে মন খারাপ হয়ে যায়। মনে হয়, এই
সব তো বড় চেনা। কিন্তু ভালো করে চিনতে পারছি না কেন। অথচ প্রাণের গভীরে কী যেন ঘাই
মারছে। এই যে জগতের পরিসর সুজিত দাস তাঁর ' ইশারা
অমানিবাস' গ্রন্থে রচনা করেছেন, তা
যেন সুদূরব্যাপী এক ইশারার মতো আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমাদেরও আছে ফেলে আসা এক সময়,
আর সেই সময় আমাদের সমসময়ের পাশেই বিরাজ
করছে।
' ইশারা
অমানিবাস' গ্রন্থটিকে বরং বলা যায় এক ধরনের অনুবর্তন।
বাংলার যে আত্মার কাছে একসময়ে ফিরে যাওয়ার কথা ভেবেছিলেন বিভূতিভূষণ, কমলকুমার, ঋত্বিক ঘটক, সেভাবেই কবি ফিরে যান এক একটি আর্কিটাইপের কাছে। সেই আর্কিটাইপের মধ্যে
অনেক কুসংস্কারও যে নেই, তাও নয়। কিন্তু সংস্কারের মতো
কুসংস্কারও আমাদের কবিতার এক অংশ, আমাদের যাপনের এক
চরিত্র। বাস্তবে যে পথের পাঁচালী সুলভ গ্রামের প্রশান্ত বাস্তবতার চিত্র তিনি এঁকে
চলেন, সেখান থেকেই যেন বা প্রবল এক জাম্প কাটে তিনি
আমাদের নিয়ে যান কল্পনার জগতে। তিনি তাঁর কবিতায় মিথকে নিজের মতো করে নির্মাণ
করেন। মিথকে তিনি এক অদ্ভুত কাব্যিক উচ্চতায় পুনঃনির্মাণ করেন নিজস্ব দক্ষতায়। বলা
যায়, সাহিত্যিক ভাষায় এক মিথিকাল প্যারালালিজম ঘটে। মিথকে
ব্যবহার করে মিথের পালটা এক মিথের বাস্তবতার কাছে আমাদের নিয়ে যাওয়ার এই কাব্যিক
ডিসকোর্স বাংলা কবিতায় খুব একটা আছে বলে মনে পড়ে না। বলতে পারি বিষ্ণু দে, সুধীর দত্ত, অশোক দত্ত এবং নির্মল হালদারের
কথা।
তাই, নিজের
কথাকেই সামান্য পরিবর্তন করে বলতে পারি, মায়াবী ঠিক না,
বলা যায় কুহকী বাস্তবতার কথা। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ এক
ইন্টারভিউয়ে বলেছিলেন, যাকে আপনারা ম্যাজিক রিয়ালিজম বলে
লাফালাফি করছেন, তা আসলে আমার ছোটবেলা থেকে শোনা বিভিন্ন
উপকথা। আমরা সেই উপকথাতে, সেই সব গল্পের মধ্যে বাঁচি।
সুজিত দাসের এই কাব্যগ্রন্থ যেন বা সেই ভাবনাকেই আবার মান্যতা
দিল। আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে গেল আবহমান কাল ধরে শোনা আমাদের সেই সব বাস্তবতার
পুনর্নির্মাণে।
"...
হেরে
যাওয়ার আগে
মাথা
বিক্রি করার আগে,
সেক্স করার আগে
এমনকী
ছেলেকে মিথ্যে বলার আগে একটা ভীষণ দৌড়"
অথবা
" তোমার লোডশেডিং নেই, কিন্তু অন্ধকার আছ্র,
মাইগ্রেনের
ব্যথা আছে দুই ভ্রুর আশেপাশে। আমিও আছি, রাধামাধব।"
আর
" এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি,
উনিশে
মার্চ বলে কোনও তারিখ নেই ক্যালেন্ডারে।
উনিশে
মার্চ বলে কিছু হয় না। বললাম না, মার্চ মাসের
উনিশ
তারিখ আব্বুলিশ। উনিশে মার্চ চলন্ত মিনিবাস।
অতঃপর
ছায়াপথ হইতে একখানি নক্ষত্র অভিসারে বাহির হইল।
সব
নক্ষত্রেরই যেমন হইয়া থাকে,
লঘুসংগীতের ন্যায় ঈষৎ প্রগলভ চলন।"
এর
পাশাপাশি অবশ্যই বলতে হবে তাঁর শব্দচয়ন ও শব্দব্যবহারের কথা। তিনি যেমন অকুণ্ঠভাবে
বিদেশী শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেমন ব্যবহার করেছেন
সংস্কৃত শব্দ, তৎসম শব্দ, তেমন
ব্যবহার করেছেন প্রচলিত শব্দ, কথ্য ভাষাও। একই সঙ্গে,
আধুনিক ও চিরকালীন এক ভাষাপ্রবাহের জন্ম দিয়েছেন তিনি এই কাব্যে।
ভাষা, উপমা, অলংকারের যে কোনও
দেশকাল নেই, তা তাঁর কবিতার মধ্যে বারবার ফুটে ওঠে। বলা
যেতে পারে এই বই বাংলা ভাষায় এক স্বতন্ত্র ধারার কবিতার আবহমানতাকে আবার আমাদের
কাছে হাজির করে।
কাব্যগ্রন্থের
কবিতাগুলির সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রচ্ছদও সমান আকর্ষণীয়।
উইপোকা
ও নাক্ষত্র /
রণজিৎ অধিকারী /
প্রচ্ছদঃ হিরণ মিত্র / প্রকাশকঃ দি সী বুক এজেন্সি /
মূল্যঃ ৮০
আধুনিক
কবিতার এক অন্যতম কাব্য-আঙ্গিক হল ইঙ্গিতময়তা, যেখানে খুব অল্প কথায়
মহাকাব্যিক পরিস্থিতি গড়ে তোলা যায়। চমকপ্রদ কাব্যঝংকার, চিত্রকল্পের
উন্মার্গগামীতার পাশাপাশি, নির্জন কাব্যভাষ্যের এক
ধারাবাহিকতা তাই দেখতে পাওয়া যায় বাংলা কবিতায়, যেখানে
অল্পেই প্রস্তুত করা হয় বৃহতের আয়োজন। এক মুঠো ধুলোর মধ্যেও যে মহাকাশের অস্তিত্ব
টের পাওয়া যায়, তা তো আর মিথ্যে নয়, কথা হল এই এক মুঠো ধুলোর মধ্যে কীভাবে মহাকাশ আছেন, তাকে দেখা। তার জন্য মহাকাশকে যেমন জানতে হয়, তেমন
ভাবেই জানতে হয় ধুলোকেও। আর কবি বা শিল্পী প্রজ্ঞার গভীর স্তর থেকেই ধুলোর মধ্যে
মহাকাশকে ও মহাকাশের মধ্যে ধুলোর অস্তিত্বকে টের পান। কবি রণজিৎ অধিকারীর কবিতায়
এই বৈশিষ্ট্যকে টের পাওয়া যায়। আমাদের আলোচ্য গ্রন্থ ' উইপোকা
ও নাক্ষত্র' তেও এক প্রকৃত কবির নির্মেদ
কাব্যব্যক্তিত্বের যে প্রতিফলন আমরা পদে পদে টের পাই, তা
কবিতা নামক শিল্প মাধ্যমকেই আরও গভীর পর্যায়ে উন্নীত করে, সন্দেহ নেই।
যেমন
ধরা যাক 'দেবী' শীর্ষক কবিতাটির কথা।
" ওই হাত পেতেছেন দেবী
কী
দেবে দাও
রক্তে
ভেসে যাচ্ছে বেদী
হাড়িকাঠ
কেঁপে উঠল ভয়ে,
অমাবস্যা চারিদিকে
তবুও
দেবীর মুখ প্রসন্ন হল না!"
চিত্রকল্পগুলি
কিন্তু সহজ। সেখানে কোনও শব্দের জাগলারি নেই, বা শব্দের সঙ্গে শব্দ
মিলিয়ে নতুন অভিনবত্ব তৈরি করার বাসনাও নেই। আসল কথা হল কাব্যসজ্জায়। প্রতিটি
চিত্রকল্প যেন এক একটি জাম্প কাট এবং সবকিছু মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে এক ভিন্ন অর্থ।
এই
ভাবে বলা যায় আহ্লাদ,
রাক্ষস, ডিম প্রভৃতি কবিতার কথা। যেখানে
সামগ্রিক ব্যঞ্জনার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে কবির অভিপ্রায়। আবার এমন কবিতাও আছে ,
যা সামগ্রিক ভাবে গঠন করছে এক নতুন চিত্রকল্প। সেখানে চিত্রকল্প
হয়ে উঠেছে দর্শন।
যেমন-
" তুমি ডিম এনেছ
সারাসন্ধে
বৃষ্টি আর প্রস্তুতির হাওয়া
অস্থির
পা ঠুকে যাচ্ছে,
দেওয়ালে ধাক্কা
কেমন
টলমল আর আঁচড়া কামড় অন্ধকার
অল্প
আলোয়
আঁটো
লাল চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকছি বেরোচ্ছি
আমার
কিছু মনে নেই,
এমন বুঁদ হয়ে
তুমি
কেমন যত্নে ডিমের ভেতর আমাকে নিচ্ছ
নমস্কার
গর্ভ
আমি
আবার জন্ম নিচ্ছি।" ( ডিম)
তাঁর
প্রতিটি কবিতা অমোঘভাবে এক দর্শনের দিকে আমাদের ঠেলে দেয়। তা হয়ত কখনও হয়
স্টেটমেন্ট,
আবার কখনও সামগ্রিক ভাবেই হয়ে ওঠে এক অভূতপূর্ব চিত্রকল্প।
সেখানে চিত্রকল্পের নির্মাণই যেন বা কবিতার নির্মাণ। যেহেতু কবিতার আসলে কোনও
ক্লাইম্যাক্স নেই, তাই এক একটি অমোঘ ক্লাইম্যাক্স তাঁর
কবিতায় যখন আমাদের অভিভূত করে, তখন বুঝতে পারি, আদতে সেই ক্লাইম্যাক্স আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এক ক্লাইম্যাক্সহীন চলমান
সময়ের দিকে, যার কোনও শুরু বা শেষ নেই, যাওয়াটাই আসল।
এই
প্রসঙ্গে অবধারিত ভাবেই বলতে হয় 'গ্রহণ' শীর্ষক কবিতাটির কথা-
" এই গম্ভীর বেগে বাহিত নাড়ি নক্ষত্রসমূহ
আমি
তাদের প্রণাম করি।
আমার
শতকোটি আয়ু
জলাশয়, সমুদ্র, পাহাড়
হয়ে
গাছতলায়
এসে বসে
ধ্যান
আসে।
ওই
মণ্ডলস্থিত বায়ু ও বায়ুভুক
ওই
অন্তরিক্ষ ও অন্তরস্থ প্রাণ
আমি
তাদের দ্বারস্থ হই;
হে
দ্বারবান,
দ্বার
খোল
আমি
পরিগ্রহ করি। "
তাঁর
কবিতার মধ্যে এক প্রশান্ত অস্থিরতা আছে। এই প্রশান্ত অস্থিরতাই কবিকে আঞ্চলিক
চিত্ররূপময়তার মধ্যেও করে তোলে গ্লোবাল সিটিজেন। আজকাল বাংলা কবিতায় লোকালের
গ্লোবালে এবং গ্লোবালের লোকালে প্রতিফলিত হওয়ার পারস্পরিকতা দেখা যায়, তাই তা দেশ-কাল-সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বব্যাপী।
" 'এই একফালি জমিমাত্র আমার'
যে
বলল,
তার দিকে তাকাই
বিনীত
অহংকারে মেশা ওই একফালি জমি
আমাদের
ভূত- ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে থাকে।
কতখানি
জমি তবে একফালি! কে করল
অত
ফালফাল!
আমাদের
ফালাফালি জুড়ে তৈরি ওই
জগৎ
সংসারের কেউ না আমরা।
জন্ম
ও মৃত্যু দিয়ে ফালি করা জীবন
আমাদের
রসেবশে টইটই করুক। " ( ফালি)
আর
ঠিক এভাবেই কবি আমাদের উত্তরাধুনিক এক পৃথিবীর সংকটের কাছে নিয়ে যান এই
কাব্যগ্রন্থে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করতেই হবে প্রবেশক এবং রাক্ষস কবিতাদুটির কথা।
প্রায় প্রতিটি কবিতাতেই অপ্রত্যাশিতের মতো আসে চিত্রকল্প। অন্তর্লীন এক নতুন
ভাষাপ্রবাহ আমাদের নিয়ে যায় সেই কাব্যপ্রবাহের বিভিন্ন বাঁকে। এই কাব্যগ্রন্থের
কোনও শুরু বা শেষ নেই। যে কোনও জায়গা থেকে শুরু হতে পারে এবং যে কোনও বিন্দুই
এখানে কেন্দ্র।
অসাধারণ
প্রচ্ছদ,
ছিমছাম এই গ্রন্থটিকে উপযুক্ত মর্যাদা দিয়েছে।
শূন্য থেকে শূন্যে/ ঈশিতা ভাদুড়ী/ ধানসিড়ি/ প্রচ্ছদ- সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়/১০০টাকা
হাইবুন এই বাংলায় খুব কম লেখা হয়েছে।
আবার হাইবুনে লেখা বাংলা ভাষায় একটি সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ লেখাও এই বাংলায় হয়নি।
হাইবুন কী, তা নিয়ে লেখিকা ঈশিতা ভাদুড়ী স্পষ্ট ভাবেই লিখে দিয়েছেন তাঁর গ্রন্থের
ভূমিকায়। হাইবুন হল দু ধরনের কবিতার মিশ্রণ। একটি গদ্যকবিতা এবং একটি হাউকু নিয়েই
হাইবুন। শূন্য থেকে শূন্যে সমগ্র কাব্যগ্রন্থটিই এক একটি অসামান্য হাইবুন। এই
অভিনব কাব্যগ্রন্থ বাংলা ভাষায় এক অনন্য ল্যান্ডমার্ক সন্দেহ নেই। কাঠামো বা
আঙ্গিকগত ভাবে তো বটেই, ভাবনার জায়গাতেও অনেক গভীর অনুভূতিমালা নিয়ে আসে এই কবিতার
বইটি।
যেমন জলের দাগ নামক হাইবুনটির কথাই বলা
যায়-
“ এই যে সামনে-পেছনে দেয়াল দিয়ে রেখেছ
কালো, ভাঙতে পারি না। আর প্রতিদিন এক ইঞ্চি এক ইঞ্চি বেড়ে যায় তারা আরও। তারপর
দীর্ঘ সময় ধরে রচিত হয় যে পিঞ্জর, সেই পিঞ্জরেও লেগে থাকে তীব্র যন্ত্রণা। জানি,
কালো দেয়ালের কথা শুনলে ঘুমিয়ে পড়ে আলো, ছিঁড়ে যায় মেঘ, ক্ষয়ে যায় ফুসফুস। জানি।
কালো দেয়ালের কথা শুনতে কে বা চায়! যন্ত্রণার কথাই বা কে!
শিরদাঁড়া বেয়ে
নেমে আসে অশ্রু
জলের দাগ।“
সংযমের সঙ্গে এই সব কবিতায় মিশে গেছে জেন দর্শনের সূক্ষ্মতা এবং অপরিসীম রূপদক্ষতা। চিত্রকল্প সে একপ্রকার দর্শন, অনেক সময় কবিতার ক্ষেত্রে আমরা ভুলে গিয়ে কলমের শক্তি প্রদর্শনেই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু ঈশিতা ভাদুড়ীর এই কবিতাগুলিতে মিশে গেছে কবির রূপদক্ষতার সঙ্গে পরিমিতির সাধনা। নির্মেদ কাব্যদর্শনের হাত ধরে আছেন বলেই কবির এই কাব্যগ্রন্থটি এত সার্থক ভাবে বাংলা কবিতায় হাইবুনকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছে। ভয়পোকা বলে একটি কবিতার কথা এখানে উল্লেখ করতেই হবে।
" কেউ জলে নামলেই ভীতি নাচে এমন, অমিতেশের কথা মনে পড়ে ভীষণ, সমুদ্রে করেছে নিশ্চল তাকে। কেউ মোটরবাইকে স্টার্ট দিলেই ভয়পোকা কামড়ায় এমন, রণেনের কথা মনে পড়ে ভীষণ। বাইশেই বেজেছিল স্তব্ধ ধ্বনি। হাসপাতালের কথা শুনলেই কাঁপুনি ধরে ভীষণ, টিঙ্কুর ছায়া এসে দাঁড়ায় সামনে। অবসাদের কথা কেউ বললেই হিম হই এমন, প্রমোদ বসু মনে পড়ে। আর, অ্যাসাইলাম শব্দে অদ্রীশ বিশ্বাস।
বিষাদ থেকে
উড়ে যায় পালক
বিষাদে আরও
মনে হয় না, এই বই যেভাবে আমার আপনার সহবাসী বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, তা ব্যাখ্যা করে বলা সম্ভব! কারণ, এই বই এক চরম নীরবতা নিয়ে আসে মনের মধ্যে। তার পর, আর কোনও কথাই থাকে না।
এই বইয়ের অলংকরণ, সজ্জা এবং প্রোডাকশন, এই বইয়ের কবিতাগুলির মতোই চিরকালীন সংগ্রহে রাখার মতো।
সংযমের সঙ্গে এই সব কবিতায় মিশে গেছে জেন দর্শনের সূক্ষ্মতা এবং অপরিসীম রূপদক্ষতা। চিত্রকল্প সে একপ্রকার দর্শন, অনেক সময় কবিতার ক্ষেত্রে আমরা ভুলে গিয়ে কলমের শক্তি প্রদর্শনেই ব্যস্ত থাকি। কিন্তু ঈশিতা ভাদুড়ীর এই কবিতাগুলিতে মিশে গেছে কবির রূপদক্ষতার সঙ্গে পরিমিতির সাধনা। নির্মেদ কাব্যদর্শনের হাত ধরে আছেন বলেই কবির এই কাব্যগ্রন্থটি এত সার্থক ভাবে বাংলা কবিতায় হাইবুনকে প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছে। ভয়পোকা বলে একটি কবিতার কথা এখানে উল্লেখ করতেই হবে।
" কেউ জলে নামলেই ভীতি নাচে এমন, অমিতেশের কথা মনে পড়ে ভীষণ, সমুদ্রে করেছে নিশ্চল তাকে। কেউ মোটরবাইকে স্টার্ট দিলেই ভয়পোকা কামড়ায় এমন, রণেনের কথা মনে পড়ে ভীষণ। বাইশেই বেজেছিল স্তব্ধ ধ্বনি। হাসপাতালের কথা শুনলেই কাঁপুনি ধরে ভীষণ, টিঙ্কুর ছায়া এসে দাঁড়ায় সামনে। অবসাদের কথা কেউ বললেই হিম হই এমন, প্রমোদ বসু মনে পড়ে। আর, অ্যাসাইলাম শব্দে অদ্রীশ বিশ্বাস।
বিষাদ থেকে
উড়ে যায় পালক
বিষাদে আরও
মনে হয় না, এই বই যেভাবে আমার আপনার সহবাসী বন্ধু হয়ে উঠতে পারে, তা ব্যাখ্যা করে বলা সম্ভব! কারণ, এই বই এক চরম নীরবতা নিয়ে আসে মনের মধ্যে। তার পর, আর কোনও কথাই থাকে না।
এই বইয়ের অলংকরণ, সজ্জা এবং প্রোডাকশন, এই বইয়ের কবিতাগুলির মতোই চিরকালীন সংগ্রহে রাখার মতো।
মন্ত্র/
বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়/ আনন্দ পাবলিশার্স
এক উদাস মানুষ নিজেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।
সে কি আউটসাইডার কোনও? নিজের মুখ তার কাছে পরিচিত। কিন্তু সেই মুখের অন্তরালে
রয়েছে এক অন্য ছায়া। অন্য এক উত্তরণের গল্প। হতে পারে, এই উত্তরণ মেনে চলেছে
অদ্বৈত বেদান্তের দর্শন। আবার এও হতে পারে সেই দর্শনের সঙ্গে মিলেমিশে গেছে
দ্বৈতবাদ। কিন্তু কী সেই অন্বেষণ যা তাঁকে চালনা করছে এক অনিবার্য আত্মানুসন্ধানের
দিকে? বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্ত্র হল সেই উপন্যাস, যা প্রত্যেক পাঠককে একবারের
জন্য হলেও নিজের মুখোমুখি দাঁড় করায়। আমাদের ইন্দ্রিয়ের অনুভূতিমালার নানান
প্রেক্ষিতগুলি জীবন নামক যুদ্ধক্ষেত্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে যে দ্বন্দ্বের মুখোমুখি
হয়, তাকে কবি বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন এক অনিবার্য নৈর্বক্তিক দূরত্বে। এই
দূরত্ব্ব যে দরকার ছিল, এ ধরনের উপন্যাসের ক্ষেত্রে। প্রতিটি চরিত্রের চরিত্রায়ণের মধ্যেই
আছে লেখকের এক নৈর্বক্তিক দূরত্ব। যেন এখানেও তিনি দ্বৈত দর্শনের ভূমিকাটুকুর কথা
খেয়ালে রেখেছেন। আসক্তি এবং নিরাসক্তির এক সঙ্গত যেন চলছে থাকে এই উপন্যাসের পরতে
পরতে।
আমি এক্ষেত্রে আর একটু বিস্তৃত করে
বলতে চাই বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে একধরনের মহাকাব্যিক
উপাদান। যদিও উপন্যাসের আবহ এবং কাঠামো দুইই ভীষণ মাটির কাছাকাছি। এমন এক দার্শনিক
আত্মানুসন্ধানের উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে দুর্লভ। কিন্তু এই অন্বেষণ যদি উপন্যাসের
আত্মা হয়, তবে তার শরীর এক নিখুঁত রক্তমাংসের অবয়ব। সাধারণত দর্শনের ভাবালুতায়
অনেক কবি ও গদ্যকার ভুলে যান, তাঁরা রক্তমাংসের কারবারী। অথবা তখন তাঁর লেখায় এসে
হাজির হয় এক রহস্যোপম ভাষা। যার উদাহরণ আমরা পেয়ে থাকি কমলকুমারের লেখায়। কিন্তু
তুলনা না করেই বলা যায়, এখানে বিনায়ক ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে সম্পূর্ণ আধুনিক। কোথাও
কোথাও উপন্যাসের নিয়তিনির্দিষ্ট সংজ্ঞাকেও তিনি চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছেন।
একজন কবিই এই উপন্যাসের শেষ অংশটুকু রচনা করতে পারেন। তিনি তা করেওছেন। কারণ এমন
শেষ হয়েও হইল না হায়-এর মতো সমাপ্তি সাধারণত উপন্যাসে দেখা যায় না। কিন্তু কোন
ভাবেই এই সমাপ্তি উপন্যাসের নিজস্ব গতিপথকে ম্লান করে দিচ্ছে না, বরং এক নতুন
অভিযাত্রার দিক নির্দেশ করছে। মনে পড়ে যাচ্ছে হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ উপন্যাসের
সমাপ্তির কথা।
হ্যাঁ,বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই
উপন্যাসকে যদি তুলনা করতে হয়, তবে হেরমান হেসের সিদ্ধার্থ উপন্যাসের সঙ্গেই করা
উচিত। কিন্তু তার আবহ পৌরাণিক। বিনায়ক অনেক আধুনিক।
মানসদা, কবি মানসকুমার চিনি কবিতা লিখে জীবনের যতদূর সর্বনাশ করা যায় করেছেন। আজ তিনি প্রায় বিচ্ছিন্ন এক জীবনকে বয়ে নিয়ে চলেছেন। তাই এইসময়ে তাঁর কবিতাবিষয়ে কিছু আলোচনা করে কবি বেবী সাউ প্রকৃতই এক জরুরি ও প্রাসঙ্গিক শুভ কাজ করলেন। তাঁকে নমস্কার।
ReplyDelete