‘ভোরবেলা মানুষের
কপালের ভাঁজ দেখলেই বোঝা যায় কে প্রেমিক কে
অনুপ্রবেশকারী।ছেঁড়া
শার্ট,ধূসর চামড়ার জুতো আর মরা-সাহেবের টুপি
দেখলেই বোঝা যায়
কার কাছে পাসপোর্ট আছে,আর কে দাঁত দিয়ে সীমান্তের
তার কেটে ঢুকে পড়েছে
তোমার প্রাসাদে’।
মাননীয়
পাঠক,উপরের টানা গদ্যে লেখা লাইনকটি দিয়েই শুরু হচ্ছে একটি কবিতার
বই।‘মৃত্যু-পরবর্তী প্রার্থনা’।কবি উত্তম দত্ত।এটি কবির দ্বীতিয় বই।পূর্ববর্তী
‘বর্ণমালার দিব্যি’ পেরিয়েই এই গ্রন্থে আসা।জানুয়ারী-২০১৯ এ ‘প্রতিভাস’ প্রকাশিত
‘মৃত্যু-পরবর্তী প্রার্থনা’ বইটিতে রয়েছে ৪৯ টি কবিতা।প্রচ্ছদ এঁকেছেন সুদীপ্ত
দত্ত।কিছু কিছু কবিতার বই রয়েছে যার সামনে অদ্ভূত এক হিম ও আচ্ছন্নতা নিয়ে নতজানু
হয়ে বসে পড়তে হয়।প্রতিটি পাঠ থেকে নুতন এক জাগরণক্রিয়া ঘিরে ফেলতে থাকে পাঠককে!এই
বই এমনই এক গ্রন্থ যা পাঠককে খাঁটি পাঠকে রুপান্তরিত করে ফেলে।আমিও বারবার এই বই
পড়তে পড়তে নিজেকে আশ্চর্য এক জায়মানতার দিকে নিয়ে গেছি।শিউড়ে উঠেছি উত্তম দত্তর
উচ্চারণে_
‘পায়েসের বাটি
হাতে সাদা থান জেগে থাকে শুধু।
খোকা,তুই এলি’?
বাংলা কবিতার
একটি শক্তিশালী নাম উত্তম দত্ত।কবি হিসেবে তিনি সদাতরুণ।তার দেখবার
চোখ,শব্দব্যাবহারের জাদু,নির্মাণকৌশল,গল্প বলবার মুন্সিয়ানা,চারপাশের সবকিছুকে
নিরাসক্তি দিয়ে পর্যবেক্ষন করবার নিরপেক্ষতা তাকে একেবারেই ভিন্ন ঘরানার কবি
হিসেবে মান্যতা দেবে।উত্তম বলেন_
‘একটা বড়ো চেয়ার
দাও তাকে,
গাড়ি দাও,সৌধ
দাও,তুলে দাও বিদেশি বিমানে,
দু-একটা সভা-টভা
করে আসুক,
কবিতা-টবিতা,গান
ও ভাষণ’।
কবির কলম জুড়ে
আবছায়া এক ভোরের ঘোর।বুঝি নদীর জলে ধরা ছোঁয়ার খেলা।ধারালো বল্লমে শ্লোক গাঁথছেন
কবি এভাবেই_
‘শূন্য মাঠ।
মিথুন রাশি ছিল
তোমার স্কুলব্যাগে
এখনও মরেনি সে’
আবার খুব গোপনে
কবি উত্তম দত্ত গোপন গসপেল লেখেন_
‘পৃথিবীর সমস্ত
আস্তাবল থেকে যাবতীয় খড়
মুখে নিয়ে উড়ে
গেছে ইহুদি পাখিরা’।
গভীর প্রেম
বিছিয়ে দিয়ে তিনি এক মায়াবী আবহসঙ্গীত শোনাতে বসেন_
‘তোমার চোখে চোখ
রাখলেই টের পাই
গৃহশান্তি নষ্ট
হয়ে গেছে বহুদিন
একতলার রান্নাঘরে
ঢুকে পড়ছে রাস্তার ইঁদুর’
খাপ-পঞ্চায়েত ও
অলৌকিক নদী লেখার আগে ও পরে উত্তম দত্ত বেশ মনে করিয়ে দেন_
১।‘সংগম ও বিরহের
মাঝখানে যে দহ আছে,
তার নাম কালিদহ’।
২।‘আমাকে
তাচ্ছিল্য করলে জাহান্নামে যাবে তুমি’।
কি চরম
বাস্তবতাকে একটু পরিসর দেন কবি।আর সেই পরিসরে পুরাণ থেকে নেমে আসতে দেখি দেবরাজ
ইন্দ্র,অহল্যা_
‘তখন ভাতের
ফ্যানকে আমরা অমৃত বলে ডাকতাম।
মাঝে মাঝে স্বর্গ
থেকে নেমে এসে ইন্দ্রকাকু
আমার মাকে একবাটি
অমৃত দিয়ে যেত।
দুপুরবেলা আমরা
পাঁচভাই
সেটা ভাগ করে
খেতাম।
মা আমাদের
ইন্দ্রকাকু আর অহল্যা ম্যাডামের
গল্প শোনাতেন’।
হাহাকারের
গল্পগুলিকে চোখের জলের লবণে মিশে যেতে দেখি উত্তম দত্তর কবিতায়_
‘বাবার ছবির কাছে
নতজানু হলে শুনতে পাই
দূর থেকে ভেসে
আসা জলপ্রপাতের শব্দ’
সমস্ত শরীর দিয়ে
কবিতাকে বোঝেন তিনি।দুনিয়ার সমস্ত বাজনাকে বেজে উঠতে দেখি তার কবিতায়।তিনি অতীত
থেকে উলের বল গড়িয়ে দিতে থাকেন সাম্প্রতিকের দিকে।অথচ কোথাও অতিকথন নেই।বাড়তি কোন
শব্দ নেই।কবি দৃশ্যের ভেতর কেবলই অনন্তের সব চেনা ও অচেনাকে মিলিয়ে দেন।এইভাবে তার
কবিতায় অতিবিরল এক দর্শন জেগে উঠতে থাকে_
‘একটা পরিত্যক্ত
প্রাসাদের ভেতরে মোমবাতির আলোয় মুখোমুখি বসে পাশা
খেলছে দুজন
মানুষ।তাদের নগ্ন শরীর ছুঁয়ে জেগে আছে পৃথিবীর সব মাছি,
কৃমি-কীট,সমস্ত
বাদুড়’।
মাতিসের রঙের
সাথে রঙ খেলতে থাকে সেজান।অরি মিশো,বোদলেয়ার,জন ডান,গঁগা গল্প করতে করতে জীবন ও
জীবনানন্দের কাছেই কিভাবে বুঝি চলে আসেন।উত্তম লেখেন_
‘মন ভালো
নেই।আমার পুরুষ গেছে
দাহ করতে
দূরবর্তী শ্মশানের দেশে’।
কিংবা_
‘পিতামহ,এক মুঠো
সাদা ভাত ও ভালোবাসার জন্য
আর কত নীচু হব
আমি?
কুঠারের দেশে এই
গাছ-জন্ম ভালোবেসে আর
কতকাল
মাথা নেড়ে যাব
শীতের বাতাসে’?
নপ্রতিবেশী
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কবিকে বিদ্ধ করেছিল সুতীব্রভাবেই।সেই অভিঘাত তাকে দিয়ে
লিখিয়ে নেয়_
‘খড়িনদীর স্রোতের
মতো এইসব সরল ও শানিত
উচ্ছ্বাসের সামনে
দাঁড়িয়ে
আমি মনে মনে
প্রার্থনা করতামঃ
বাঘা সিদ্দিকি,এ
যুদ্ধ যেন কখনও বন্ধ না হয়’।
আসলে কবি তো
এপিটাফ লেখেন!হাহাকারের গান শোনান।জীবন পেরিয়ে অন্য নকসির এক তাঁতকলের রুপমায়ায়
আকাশের মেঘের নিচে উড়তে থাকা অগনণ পাখিদের টেনে আনেন ক্যনভাস ও চালচিত্রের খুব
ভেতরেই।তাই বুঝি কবি ৪৯ নং কবিতায় চিরায়ত এক নারীকে বলছেন_
‘তোমাকে ভীষণভাবে
চাই এই মড়কের দেশে
দরজা খোলো
মরিয়ম’।
এই বই আমার কাছে
এক মনোশিক্ষার গীত।চিরদিনের এক অখন্ড গান।শহরের কেন্দ্র থেকে ছড়িয়ে পড়ছে ৪৯ টি গলি
আর আলপথ।
কবি উত্তম দত্ত
বাংলা কবিতার অহংকার।কবিকে প্রণাম।
No comments:
Post a Comment