খুব ধীর ভাবে আলতো করে অথচ গভীর অসহ্য এক চাবুক যেন সপাং
করে আমাদের চৈতন্যে ঘা মেরে আঁতের চোরা পাঁককে মুহূর্তে ছড়িয়ে দিতে পারে সেই কবিতা
যার ভেতরে একইসঙ্গে ধরা থাকে বিষ, বাসুকি, দংশন ও পিয়াস,
প্রেম আর মধু। সেই কবিতাই আমাদের হঠকারীতা আর কালো চশমাকে গুড়িয়ে দিতে
পারে যার মধ্যে ফুটতে থাকে কম্পন আর সংযম। সেই কবিতাই সমস্ত মিথ্যাকে কুপোকাৎ করে আত্মাকে চেনায়
প্রকৃত বাস্তবতার রঙে যার মধ্যে উদ্ভাসিত হয় প্রতিজ্ঞা আর প্রতারণা। অতি সম্প্রতি একটি কবিতার বই পড়তে পড়তে
এই অনুভবটি মাথায় খেলে গেল। যতদূর সম্ভব বইটি তাঁর প্রথম প্রকাশিত বই। আর প্রথম প্রকাশিত বই হিসেবে সবারই
কিছু ত্রটি বিচ্যুতি থাকে। এই বইটিও তা থেকে ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু দু একটি সেই অসতর্ক পদক্ষেপ
গুলিকে বাদ দিলে আমরা যে প্রজ্ঞা প্রমিতি আর প্রতিজ্ঞার দারুণ সাক্ষাৎ পাই তাকে মেনে
নেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকে না। যেন তীব্র বজ্রের মতোই আচমকা ভূপতিত হয়ে মানুষের সমস্ত
অহংকারকে ফালাফালা করে দিতে পারে, দুমড়ে মুচড়ে দিতে পারে তার ভেতরের প্রতাপকে। অভিজিৎ ঘোষের “অলীক বাড়ির খোঁজে”
এরকমই একটি কাব্য যেখানে একটি তরুণ যাপনের আহত বিষণ্ণতাকে নিংড়ে
দিয়েছেন স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায়।
অতিবাস্তবতার কথাই অভিজিৎ সবসময় ভালোবাসেন। তিনি রগরগে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে
চান। প্রেম ও পিছুটান এলেও তা যে মায়ারই
ফাঁস তাও স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলেন না। প্রথাগত চমক নির্মাণে এই কবি বিশ্বাসী নন। কবি চেয়েছেন এই সমাজের ভেতরের রূপকে
ছেঁচে তুলতে। কান্না আর্তনাদ, শীৎকার, গোঙানি সবমিলিয়ে ভয়ঙ্কর রংমিলান্তি যার ছোবল ঘনিয়ে আসে ক্ষণে ক্ষণে অথচ কোন
ব্যথায় ন্যুব্জ হয় না দেহ। স্লো পয়জনের মতো একটু একটু গ্রাস করতে থাকে আমাদের সত্তাকে। মানুষ সহজেই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে এই বাজারে। বিপণনের কারবারে তার প্রচণ্ড উত্তাপে
গলে পুঁজ হয়ে যাচ্ছে কবির সংবেদনশীলতা। বিশ্বাসঘাতকতার এই পরিস্থিতিগুলোকে
কবি নিঁখুত ভাবে তুলে আনেন। বিশ্ব অর্থনীতি যখন মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদ আর পুঁজির আগ্রাসনে
যারপরনাই ক্ষয়িষ্ণু তখন তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ তার চকিত ঝলকানিতে মুগ্ধ হয়ে ওঠে। দেখেও দেখে না তার ভেতরের কদর্য রূপটি। শুধু আহত হয় যৌব সমাজ। বেকারত্ব কালোবাজারি ফাটকাবাজ মুখোশে
ভরে ওঠে দেশ। ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি পাশ্চাত্যের উগ্র
মডার্ন কালচারে ক্ষতবিক্ষত হয়। দেশ ও মাটির বন্দনাকে এখন সবাই বিকিয়ে যাওয়া ভাবে। যেন তেন প্রকারেণ স্মার্ট হওয়াটাই যেন
মানুষের এমনকি কবিদেরও নিয়তি। আমি ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ি আমি বাংলা জানি না – এ কথা বুক ফুলিয়ে
বললে আজ সম্মান বাড়ে, পাঁজরে শক্তি জমে। তেমনি মাটি মানুষের কথা বললে কবিকেও
অপদস্থ হতে হয়।
কবিকে বলতে হয় নাগরিক ভোগবাদী জীবনের কথা, অস্তিত্বের সংকটের কথা আর এসবের মাঝে নিপুণ রমণের কথা। যৌনতার কথা না থাকলে আবার পাবলিক খাবে
না। এই সকল রংবাজির বিরুদ্ধে অভিজিৎ ঘোষ
বলে দেন-
কী অবাক কাণ্ড জানেন
গোলাপ গাঁদার বাইরে
কোনো ফুল চিনতেই
পারি না
আতঙ্ক
খুব শান্ত স্বরে কথাগুলো বললেন কবি অথচ তা তীব্র ভাবে
বেজে উঠল মনে। তীক্ষ্ণ একটা প্রশ্ন ধেয়ে এল প্রাণে। সার্বিক করুণ মর্মন্তুদ। অসহনীয় এক জিজ্ঞাসার তূণ যেন বিদ্ধ
হল বুকে। কবি নিজেও এই জিজ্ঞাসায় বিদ্ধ-
এখন রীতিমতো আতঙ্কে আছি-
টাকাপয়সা, গোলাপ-গাঁদা ছাড়া
ছেলের জন্য আর কী উত্তরাধিকার ছেড়ে
যাচ্ছি?
জারুলেরা এইভাবে বিনা পরিচয়ে
ফুটেই ঝরে যাবে? ঐ
এরকম ভাবেই ঝরে যায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি। ঝরে যায় দেশ মানুষ মনুষত্ব। শুধু বিলাস, শুধু যৌনতা আর নাগরিক
অস্তিত্ব সংকটের কচকচানি পড়ে থাকে। পড়ে থাকে হিসাব, হিসি, অওরত। বেশ্যাদের নুপুরের ঝঙ্কার সাদা পাতায়
ঝিলিমিলি কাটে। আর প্রকৃত শ্রম, সংগ্রাম, মেহনত এভাবেই ফুটে শুকিয়ে যায়। এই বিবাদ থেকে মানবতাকে রক্ষা করে থাকেন
মায়েরাই। “আজ মহালয়া”
কবিতাটিতে অভাবের সংসারকে মা কীভাবে আগলে রেখে সবাইকে হাসি মুখে রাখেন
তাই দেখানো হয়েছে। এই মা হয়ে ওঠেন দেবী। “আজকের শিশুকাল” কবিতায়
দেখি বন্দী ধ্বস্ত প্রাণহীন শৈশব-
আমার ছেলে
পশমের কাঠবেড়ালির নাম রেখেছে মিঠু
ওকে খাওয়ায়, যত্ন করে, ঘুম পাড়ায়
ওর অনাদরে কেঁদে ওঠে
আমি চুপচাপ বসে ছেলের কাণ্ড দেখি
আর ভাবি
ফ্রেমে বাঁধানো আলপথ দেখে দেখে
কেটে যাবে ওর শিশুকাল?
আজকের শিশুকাল
আধুনিক স্মার্ট শৈশবের এই পরিণতি। বাইরে বাইরে প্রচণ্ড সবজান্তা আর ভেতরে
ভেতরে নকলকেই আসল বলে ধরে নেওয়া। এইরকম একটি শ্রীহীন, নির্জীব, প্রাণহীন
জীবন জন্ম দেয় নাগরিকতার। শৈশব থেকেই শিশুরা অভিনয়ের শিক্ষা দেয়।
এই কাব্যের বেশ কিছু কবিতায় একধরণের শ্লেষ পরিলক্ষিত হয়। মিথ্যা ভণ্ডামি, প্রতারণা, নাগরিকতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। কখনো কখনো কবিতায় মূর্ত হওয়া পেলম রোমান্টিসিজমের বিরুদ্ধেও। যেমন “অলীক সাধ” কবিতায় মিথ্যা অমরত্বের বিরুদ্ধে একটি জমকালো শ্লেষ ছুঁড়েছেন কবি। কবি অমরত্বের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন। নানা শহর, নগর, গ্রাম, গঞ্জ ঘুরে সব ফোঁ ফোঁ মনে হওয়ার পরে কবি সাক্ষাৎ
পেলেন প্রকৃত সত্যের –
বদলে যেতে দেখেছি মুখ
প্রতি মিনিট প্রতি সেকেণ্ড
এ কেমন সময় শুধু বদলে যায়
বদলে বদলে যায় অলীক সাধ
আসলে বদলে যাওয়াই নিয়তি। বদলে যায় সবকিছু । জীবন যাপন সংস্কার প্রবাহ প্রেম। পড়ে থাকে শুধু অভ্যাস। নীরস জটিল বিষময় অভ্যাস। তাই কবির নিজেকে একজন ব্যর্থ মানুষ
বলে মনে হয়। অবশ্য এই ব্যর্থতার চোরাটান ঘুচিয়ে
দিতে পারেন মেদবহুল পিছিল আত্মসর্বস্ব জীবনের বিপরীতে কোনো প্রাকৃত কোলাহলহীন জীবনের
কাছে সত্তাকে ছেড়ে দিয়ে-
আমার ভাল লাগছে না ফারুক
তুই কোথায়?
ফেসবুক, হোয়াটস আপ নয়,
তুই আয়
হাত ধর
সামনের রাস্তাটা অন্তত পেরিয়ে যাই…
ফারুক তুই কোথায়
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর “উলঙ্গ রাজা”
কবিতার শিশুটির মতোই সততার প্রতীক এই ফারুকদের কাছে পেতে চেয়েছেন কবি
যাঁদের চোখে চশমা নেই আছে প্রকৃত দৃষ্টি, মুখোশ নেই আছে মুখের
লাবণ্য।
বইটির প্রতিটি কবিতাই কোনো না কোনো শ্লেষ অথবা বিদ্রুপে
ভাস্বরিত। এর ফলে প্রবলভাবে নাটকিয়তা চলে এসেছে। কখনো তীব্রভাবে অপেক্ষা করে থাকতে হয়েছে
শেষ লাইনটির জন্য। কখনো অতিরিক্ত বর্ণনাধর্মীতা কবিতার
চলাচলকে আহত করেছে।
“সমুদ্র, সৈকত ও আমি” সিরিজের কবিতাগুলোও এমন একটি নাটুকেপনা দ্বারা গ্রথিত-
খানিক দূরে বসে আছেন মিস্টার সান্যাল
সঙ্গে একদম পাশে মিসেস সান্যাল
পাশে তবু যেন কত ব্যবধান
সমুদ্র, সৈকত ও আমি
এই চিত্রকল্প এই অনুভূতি বাংলা কবিতায় বহুবার এসেছে। এখানে নতুন কোনো কথা নেই,
শুধু গতানুগতিকতার বিবরণ। এছাড়া কবি সমসময় দ্বারা ভীষণভাবে আক্রান্ত। বাস্তবতা শুধু তার নির্জলা দহনটুকু
নিয়ে কোনো কোনো সময় অতিরিক্ত ভাবে উপস্থাপিত হয়েছে । এটাও কবিতার ক্ষতি করেছে। বাস্তবতাকে তুলে ধরা ভালো কিন্তু বাস্তবতার
একঘেয়েমি আর্তনাদও যে একপ্রকারের ফ্যাশন তা থেকে কবিকে নিঃশব্দে বেরিয়ে আসতে হয়। সেই বাস্তবতার হুজুগে মাতলে কবিতার
বারটা বেজে যায়। আমাদের মনে হয়েছে সেই ডামাডোলের সস্তা
হিল্লোল থেকে মাঝে মাঝে অভিজিৎ বের হতে পারেননি। তবে যাই হোক সেগুলি খুবই সীমাবদ্ধ, অল্প। এসব কিছু থেকে বেরিয়ে এসে শেষ মেষ তিনি
বলতে পেরেছেন-
একটু দূরে শূন্য মাঠ বর্ষার প্রতীক্ষায়
চাষি তুলে নিয়ে গেছে বোরো
এখানেই পুড়িয়েছিলাম আলু
ওই আলপথ ধরে ঝাঁপ দিয়েছি দিঘিতে
ফিরে এসো শৈশব
কিংবা
সহসা এ কোন ধ্বংসলিপি দেওয়ালে দেওয়ালে
সব রঙ ধূসর আঙুল ছোঁয়ালে
তথাপি হাঁটি পথ তারাদের দেশ থেকে দেশে
স্বপ্নে দেখা অলীক বাড়ির খোঁজে
অলীক বাড়ির খোঁজে
এই স্বপ্ন, এই অন্বেষণ এই পরিব্রাজনের ভেতর জেগে থাকে
কবির আশা যা সমস্ত পলায়নপর মানসিকতাকে ভেঙে দিয়েছে। এখানেই কবিতার শক্তি, কবিরও।
অলীক বাড়ির খোঁজেঃ অভিজিৎ ঘোষ
প্রচ্ছদ: শ্যামলবরণ সাহা
প্রকাশক: নাটমন্দিরঃ ১০০ টাকা (প্রথম প্রকাশঃ
ডিসেম্বর ২০১৮)
No comments:
Post a Comment