অনেকদিন, বোধ হয় প্রায় ন-বছর আগে ' থ্রি ইডিয়টস ' বলে
একটি মুভি দেখেছিলাম । মুভিটি দেখার পর ছোট ছোট ভালোলাগার কিছু কোলাজ তৈরি হয়েছিল, ভালোলাগাগুলো গড়ে তুলেছিল কমিউনিকেশন মনের সাথে । এরপর বহুবার
ছবিটি দেখেছি, আজও অবসর পেলেই দেখি প্রায়শই ।
কবি নবকুমার পোদ্দার এর প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ ' বৃষ্টি ও টবের কোরিওগ্রাফ ' এবং ' পেখমবাড়ি ' পাঠ করার পর আমার মন ও মগজে কোথাও একটা ইন্দ্রজাল- মৌতাতময় করে নিয়েছিল আগেই, যা আমাকে দিয়ে আমাকে দিয়ে গ্রন্থ দুটি পাঠ করিয়ে নিয়েছিল বারবার !
যার রেশ ধরেই এ বছর বইমেলায় সংগ্রহ করি কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ' ছায়ামানব ' ... পড়তে শুরু করি । প্রথম পাতায় মুখোমুখি হই ' এই বসন্তে ' শিরোনামের কবিতাটির সাথে ! কবি বলছেন...
' ভাঙা হাড়ে তখনও আপনাকে রুগী রুগী লাগে নি
আপনি একা একা পাহাড়ে বেড়াতে গেছেন;
রাধাকে এক কাপড়ে রেখে
শোক হলুদ করিয়েছেন...
আপনার হৃদয়ে বর্ষা এসেছে
আপনি গোলাপি তেপান্তরে ডানা মেলেছেন !
শুধু এই বসন্তে
ডিমের কুসুম কতটা আন্তরিক সে খেয়াল রাখা আপনার উচিৎ ছিল
মহোদয়... '
দৈনন্দিন কথাবার্তার মতোই শুরু হয় প্রথম কটি লাইন, ফলে সহজেই ঢুকে পড়া যায় কবিতাটির অন্দরমহলে । ধীরে ধীরে কবিতাটি সংকেতময় হয়ে ওঠে কীভাবে, তা প্রত্যক্ষ করি । মগজ ভাঙতে শুরু করে এই ইশারা, ঘোর লাগে ! জীবনযাপনের বিভিন্ন মুহূর্তে আমাদের ব্যক্তিগত কিছু না বলা কথা জমা হয়ে থাকে, যা বলা হয়ে ওঠে না । কবির আবেগ আড়াল থেকে যেন সেই কথাগুলোই কবিতার শব্দ, সংকেতে বলে ওঠে এভাবে ...
' দশ হাত ' কবিতায় কবি বললেন --
' অজুহাত বুনি ।
.....................
রান্নাঘর থেকে ব্যাংকক পর্যন্ত
আমাদের সিনেমা সৌখিন । '
স্বতন্ত্রতায় সাহসী কবি, আজকের সময়ের নিরিখে ভাবনা ও শব্দবন্ধে তার প্রয়োগে যেন নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে আসলেন ।
আবার জীবনে চলার পথে পাওয়া অবহেলা থেকে জমা যন্ত্রণা, ক্ষোভ জন্ম দেয় ' অপেক্ষা ' কবিতাটির ! কবি যেন নিজেকেই কিছু বলছেন, বলছেন আর একটু সময় পার করার কথা । ভেতরের সম্ভাবনাগুলো বাঁচিয়ে রাখার কথা ভাবছেন । পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি- আরেঃ এ কথা তো আমারও, এই অনুভব সেতু গড়ে তোলে কবির ভাবনা প্রবাহের সাথে... কবি লিখছেন --
' অপেক্ষা করো হাঁস ।
দু বেলা অগ্রসর । আলো
প্রতিশ্রুতি । ঢেউ লিখে, জল দাবি করো ।
অপেক্ষা করো অদ্ভুত ।
নিয়ম পড়ো । নিয়ম মানো ।
ভাঙো নিজেকে ।
চতুর্দিকের মহড়া কেড়ে
ধান সুগন্ধি হয় না ।
বন্যা ঈশ্বরকে ধোয়ায় না
পৃথিবীর গোত্রকে ধুইয়ে দেয় । '
কেই বা এই কল্প ঈশ্বর ? কীসের মহড়া বা প্রস্তুতি চারদিকে ? আলোর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয় বারবার । কন্সেপচুয়ালি অনুভব করতেই থাকি, কোথাও একটা মিলমিশ তৈরি করে গড়ে ওঠে ছবি নিজেরই মনে !
' ছায়ামানব ' গ্রন্থটির ছায়ায় কখন যেন সাঁতরাতে শুরু করি অজান্তেই, এপাড়-ওপাড়ের মাঝ বরাবর ! ' নদী ' কবিতায় কবি লিখেছেন --
' ........................
আমি সাঁতার কেটে কেটে পূর্ণিমায় ফিরি
প্রতিদিন হাতে করে
শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদের খবর
পবিত্রসঙ্গম লিখে দেই ... '
কত কিছু ভেসে ওঠে সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে, কল্পনার চোখে খুঁজি... খুঁজতে শুরু করি ! কবি চলতে চলতে যা দেখেন, উপলব্ধিতে এসে জমা হয় । অন্তর্দৃষ্টি থেকে উৎপন্ন এক্সপ্রেশন শব্দে মেলে দেন বাঁকে বাঁকে !
ঘোর লাগা চোখে এগোতে থাকি । চোখে পড়ে ' চাঁদ ' ---
' চাঁদের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলাম !
মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে আবার চাঁদ দেখলাম;
এরকমভাবে চাঁদ দেখতে দেখতে কখন যেন চাঁদের বিষয়বস্তুতে ঢুকে পড়লাম
ভোর হয়ে এল
চারদিকের লোকজনকে দেখি
চাঁদের স্বাস্থ্য নিয়ে
বেশ গদগদ হয়ে উঠেছে '
কীভাবে পারিপার্শ্বিক নিয়ে নিজেকে বলা কিছু কথা কবিতা হয়ে ওঠে, কীভাবে পরিস্থিতির খসড়া অভিঘাত ফেলে কবিতায়- দেখলাম ! অদ্ভুত শৈলী, কোথাও কবি দায়বদ্ধ নয় সরাসরি বলে দিতে, অথচ পাঠক পড়তে পড়তে সংযুক্ত হতে থাকে, রেসপন্স করে ! বৃত্ত রচনা হয় !
এভাবেই ছায়ামানবেরা বোধহয় হাঁটতে থাকেন, তার ছায়া দীর্ঘতর হয় পাঠক হৃদয়ে । ১২ টি কবিতা নিয়ে নিঃসন্দেহে সংগ্রহযোগ্য একটি কাব্যগ্রন্থ, কবির ইমাজিনেশন, ভাষার অভিঘাত অভিমুখ বদলে বদলে গেছে প্রতিটি কবিতায় ! কবি নবকুমার পোদ্দার আভাস রাখেন না, ভীষণ আনপ্রেডিকটেবল প্রতিটি লেখায় ! ' ছায়ামানব ' কাব্যগ্রন্থে লুকিয়ে আছে কিছু অব্জারভেশন, ব্যক্তিগত আবেগ পার করে যা পাঠককে আয়নার সামনে এনে দাঁড় করায় । উপলব্ধি থেকে পুষ্ট চিন্তা, অভিজ্ঞতা উৎপন্ন বোধ দিশা দেয় চেতনাকে । কবিতা তার নতুন দিক খুঁজে পায় । প্রচ্ছদ কবিতাগুলির সাথে ও গ্রন্থটির নামের সাথে বেশ মানানসই । প্রচ্ছদশিল্পী কবিতাগুলো পড়েই প্রচ্ছদ নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন কী না, তা আমি জানি না ।
ফুটিফাটা গ্রীষ্মকাল আসছে, কবিতার ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেবেন সবাই । ' ছায়ামানব ' সঙ্গী হোক অবসরযাপনের ।
কাব্যগ্রন্থ -- ছায়ামানব
সহায়তা করলেন যারা
------------------------------
প্রকাশক -- বোধিসত্ত্ব ( বাতায়ন )
প্রচ্ছদ নির্মাণ -- দেবায়ন মুখার্জি
বিনিময় -- ৩০ টাকা
কবি নবকুমার পোদ্দার এর প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ ' বৃষ্টি ও টবের কোরিওগ্রাফ ' এবং ' পেখমবাড়ি ' পাঠ করার পর আমার মন ও মগজে কোথাও একটা ইন্দ্রজাল- মৌতাতময় করে নিয়েছিল আগেই, যা আমাকে দিয়ে আমাকে দিয়ে গ্রন্থ দুটি পাঠ করিয়ে নিয়েছিল বারবার !
যার রেশ ধরেই এ বছর বইমেলায় সংগ্রহ করি কবির তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ ' ছায়ামানব ' ... পড়তে শুরু করি । প্রথম পাতায় মুখোমুখি হই ' এই বসন্তে ' শিরোনামের কবিতাটির সাথে ! কবি বলছেন...
' ভাঙা হাড়ে তখনও আপনাকে রুগী রুগী লাগে নি
আপনি একা একা পাহাড়ে বেড়াতে গেছেন;
রাধাকে এক কাপড়ে রেখে
শোক হলুদ করিয়েছেন...
আপনার হৃদয়ে বর্ষা এসেছে
আপনি গোলাপি তেপান্তরে ডানা মেলেছেন !
শুধু এই বসন্তে
ডিমের কুসুম কতটা আন্তরিক সে খেয়াল রাখা আপনার উচিৎ ছিল
মহোদয়... '
দৈনন্দিন কথাবার্তার মতোই শুরু হয় প্রথম কটি লাইন, ফলে সহজেই ঢুকে পড়া যায় কবিতাটির অন্দরমহলে । ধীরে ধীরে কবিতাটি সংকেতময় হয়ে ওঠে কীভাবে, তা প্রত্যক্ষ করি । মগজ ভাঙতে শুরু করে এই ইশারা, ঘোর লাগে ! জীবনযাপনের বিভিন্ন মুহূর্তে আমাদের ব্যক্তিগত কিছু না বলা কথা জমা হয়ে থাকে, যা বলা হয়ে ওঠে না । কবির আবেগ আড়াল থেকে যেন সেই কথাগুলোই কবিতার শব্দ, সংকেতে বলে ওঠে এভাবে ...
' দশ হাত ' কবিতায় কবি বললেন --
' অজুহাত বুনি ।
.....................
রান্নাঘর থেকে ব্যাংকক পর্যন্ত
আমাদের সিনেমা সৌখিন । '
স্বতন্ত্রতায় সাহসী কবি, আজকের সময়ের নিরিখে ভাবনা ও শব্দবন্ধে তার প্রয়োগে যেন নিয়ম ভেঙে বেরিয়ে আসলেন ।
আবার জীবনে চলার পথে পাওয়া অবহেলা থেকে জমা যন্ত্রণা, ক্ষোভ জন্ম দেয় ' অপেক্ষা ' কবিতাটির ! কবি যেন নিজেকেই কিছু বলছেন, বলছেন আর একটু সময় পার করার কথা । ভেতরের সম্ভাবনাগুলো বাঁচিয়ে রাখার কথা ভাবছেন । পড়তে পড়তে আবিষ্কার করি- আরেঃ এ কথা তো আমারও, এই অনুভব সেতু গড়ে তোলে কবির ভাবনা প্রবাহের সাথে... কবি লিখছেন --
' অপেক্ষা করো হাঁস ।
দু বেলা অগ্রসর । আলো
প্রতিশ্রুতি । ঢেউ লিখে, জল দাবি করো ।
অপেক্ষা করো অদ্ভুত ।
নিয়ম পড়ো । নিয়ম মানো ।
ভাঙো নিজেকে ।
চতুর্দিকের মহড়া কেড়ে
ধান সুগন্ধি হয় না ।
বন্যা ঈশ্বরকে ধোয়ায় না
পৃথিবীর গোত্রকে ধুইয়ে দেয় । '
কেই বা এই কল্প ঈশ্বর ? কীসের মহড়া বা প্রস্তুতি চারদিকে ? আলোর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয় বারবার । কন্সেপচুয়ালি অনুভব করতেই থাকি, কোথাও একটা মিলমিশ তৈরি করে গড়ে ওঠে ছবি নিজেরই মনে !
' ছায়ামানব ' গ্রন্থটির ছায়ায় কখন যেন সাঁতরাতে শুরু করি অজান্তেই, এপাড়-ওপাড়ের মাঝ বরাবর ! ' নদী ' কবিতায় কবি লিখেছেন --
' ........................
আমি সাঁতার কেটে কেটে পূর্ণিমায় ফিরি
প্রতিদিন হাতে করে
শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদের খবর
পবিত্রসঙ্গম লিখে দেই ... '
কত কিছু ভেসে ওঠে সূক্ষ্ম ইঙ্গিতে, কল্পনার চোখে খুঁজি... খুঁজতে শুরু করি ! কবি চলতে চলতে যা দেখেন, উপলব্ধিতে এসে জমা হয় । অন্তর্দৃষ্টি থেকে উৎপন্ন এক্সপ্রেশন শব্দে মেলে দেন বাঁকে বাঁকে !
ঘোর লাগা চোখে এগোতে থাকি । চোখে পড়ে ' চাঁদ ' ---
' চাঁদের দিকে তাকিয়ে কী যেন ভাবলাম !
মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে আবার চাঁদ দেখলাম;
এরকমভাবে চাঁদ দেখতে দেখতে কখন যেন চাঁদের বিষয়বস্তুতে ঢুকে পড়লাম
ভোর হয়ে এল
চারদিকের লোকজনকে দেখি
চাঁদের স্বাস্থ্য নিয়ে
বেশ গদগদ হয়ে উঠেছে '
কীভাবে পারিপার্শ্বিক নিয়ে নিজেকে বলা কিছু কথা কবিতা হয়ে ওঠে, কীভাবে পরিস্থিতির খসড়া অভিঘাত ফেলে কবিতায়- দেখলাম ! অদ্ভুত শৈলী, কোথাও কবি দায়বদ্ধ নয় সরাসরি বলে দিতে, অথচ পাঠক পড়তে পড়তে সংযুক্ত হতে থাকে, রেসপন্স করে ! বৃত্ত রচনা হয় !
এভাবেই ছায়ামানবেরা বোধহয় হাঁটতে থাকেন, তার ছায়া দীর্ঘতর হয় পাঠক হৃদয়ে । ১২ টি কবিতা নিয়ে নিঃসন্দেহে সংগ্রহযোগ্য একটি কাব্যগ্রন্থ, কবির ইমাজিনেশন, ভাষার অভিঘাত অভিমুখ বদলে বদলে গেছে প্রতিটি কবিতায় ! কবি নবকুমার পোদ্দার আভাস রাখেন না, ভীষণ আনপ্রেডিকটেবল প্রতিটি লেখায় ! ' ছায়ামানব ' কাব্যগ্রন্থে লুকিয়ে আছে কিছু অব্জারভেশন, ব্যক্তিগত আবেগ পার করে যা পাঠককে আয়নার সামনে এনে দাঁড় করায় । উপলব্ধি থেকে পুষ্ট চিন্তা, অভিজ্ঞতা উৎপন্ন বোধ দিশা দেয় চেতনাকে । কবিতা তার নতুন দিক খুঁজে পায় । প্রচ্ছদ কবিতাগুলির সাথে ও গ্রন্থটির নামের সাথে বেশ মানানসই । প্রচ্ছদশিল্পী কবিতাগুলো পড়েই প্রচ্ছদ নির্মাণে হাত দিয়েছিলেন কী না, তা আমি জানি না ।
ফুটিফাটা গ্রীষ্মকাল আসছে, কবিতার ছায়ায় একটু জিরিয়ে নেবেন সবাই । ' ছায়ামানব ' সঙ্গী হোক অবসরযাপনের ।
কাব্যগ্রন্থ -- ছায়ামানব
সহায়তা করলেন যারা
------------------------------
প্রকাশক -- বোধিসত্ত্ব ( বাতায়ন )
প্রচ্ছদ নির্মাণ -- দেবায়ন মুখার্জি
বিনিময় -- ৩০ টাকা
No comments:
Post a Comment