ক্ষিতীশ ও পারিজাত। পারিজাত ও ক্ষিতীশ এবং রাজর্ষি।এবং আমি, আপনি,
আমরা, সাধারণ পাঠকেরা। তো এইভাবে পাঠ শুরু
হয়। বা একটা চলচ্ছবির পর্দা ওঠে। আর দর্শকাসনে নিজেদের
দেখি। এক ভাষ্যকারের গলা ভেসে আসে। দুটি চরিত্র আর দু তিনটে সময়কালে এগিয়ে পিছিয়ে কিছু
মন্তাজ।
চরিত্র দুটি নাগরিক জীবনে ঢুকে পড়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ভাঁজে
যা কিছু করে, বলে, ভাবে অথবা স্রেফ কিছুই
না করে অনেকগুলো সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে অথবা না দিয়ে থেকে যায়---সেই হওয়া না-হওয়াগুলো খুব রোগা আয়তনের দু’মলাটের পাঁচটি পাতার মধ্যে নিজেদের এত মুনসিয়ানায় আঁটিয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘ লেখা
হয়ে ওঠে যাকে কোনো জঁর এ বাঁধতে জাস্ট ইচ্ছেই করতে পারে না। “কলকাতা হত্যালীলা” হাতে
নিলে পাঠকের প্রত্যাশা মলাট ওল্টালে শেষ পৃষ্ঠা অব্ধি তাকে টানবেই। রাজর্ষির লেখার ঘরানার
সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিতির সুবাদে নামকরণ দেখে যে মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি এই পাঠকের অজান্তেই
ঠোঁটের কোনে এসেছিল প্রথম পাতাতেই তাতে মুগ্ধতার বিচ্ছুরণ চলে এল। শুরু হচ্ছে খুব নিস্পৃহ
অথচ ভয়ানক সচেতন একটা ন্যারেটিভের মধ্যে দিয়ে। যেন নাটক মঞ্চস্থ করার
আগে খুঁটিনাটি বলে দেওয়া হল। ক্ষিতীশ’ একটা
সময়ের মুখ। পুরনো, খুব চেনা তাইই প্রাসঙ্গিক।
“সাধারণের যা ধর্ম ক্ষিতীশের ধর্ম
কিন্তু তা নয়……
পারিজাত অনেক খেটেখুটে বুঝেছে ক্ষিতীশের
ধর্মের স্বভাবটা ভিন্ন……
ক্ষিতীশের ধর্ম প্রকৃতি-প্রত্যয়ের মতোই জটিল, জলের মতোই বহতা…
হিন্দু পদবী তাকে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের
উপমার মতো
উষ্ণ রেখেছে, যেন বর্ণহিন্দুত্বের খাঁজে খাঁজে ক্ষিতীশ মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ হয়ে পড়েছে
ক্ষিতীশ সেই প্রতিটা ধর্মে মন দেয়, প্রতিটি উত্তল-অবতল তার প্রনম্য
লক্ষ্য করলে বোঝা যায় সে কম্যুনিস্ট না, বাপ-দাদার মতো কংগ্রেসি নয়
ছোটো-বড়ো ঘটনাগুলি যে ধর্মবিবিক্ত নয় একথা যখন একটা গোটা দেশ
ভুলতে বসেছে, মায় পারিজাত; ক্ষিতীশ সিন্ডিকেট ভেঙে যাওয়ার খবরে
কাচা লুঙ্গি পরে যুগান্তরের উপরে চপচপে মুড়ি মাখে”।
প্রথম লেখাটির
এই পংক্তিগুলো বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত করতে হল শুধু রাজর্ষির ভাষা ও লেখার চলনের কোনও
ব্যাখ্যা দিয়েই বোধগম্য করা সম্ভব না বলেই। এমন এক সময়ের ভাষ্য এ, যখন পাতালরেলের মাটি কাটা শুরু হয় নি অথচ বাতাসে ক্ষয়ের জীবানু,
ক্ষয়রোগেরও। আর কাশির দমক মধ্যরাতে গাড়লের মতো চমকে মনে আনে অন্য
এক অনুষঙ্গে মহানগরের নিষ্ঠুর ট্রামলাইন। বন্ধ দরজার এপার ওপারে
দুই বন্ধু নাকি দুই “সখা”র এক মধুর জীবনযাপন যাকে বহু মাত্রায় ব্যাখ্যার লোভ সংবরণ করা দায়।
“ মাদুরের শেষ অবধি পা ছড়িয়ে ক্ষিতীশ বলে---
বে করব ভাবছি।
সত্যি? পারিজাতের সিগারেট দিনশেষে জ্বলে ওঠে।
ক্ষিতীশ চাপা গলায় বলে—বউদি
বুঝি জেগে গেল
শুয়ে পড়ো, যাও”।
রাজর্ষির লেখার
সবচেয়ে ধাক্কা দেওয়া যে বিষয় তা হলো কোনও দশকএর লক্ষ্মন আক্রান্ত চলন থেকে তিনি একেবারে
মুক্ত। অসামান্য গদ্যকারও তিনি বটে, কিন্তু সচেতন প্রয়াসও
নেই এই দুইয়ের মধ্যবর্তী কোনও সূক্ষ্ম বিভাজনের। বরং পাঠককে হতবুদ্ধি
করে দিতেই পছন্দ করেন তিনি। তাঁর সমসাময়িক আর কোনও কবির লেখায় পেয়েছি কি এমন অনুষঙ্গ---
“আজ থেকে কুড়ি বছর পরে হয়তো আরো কাছাকাছি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হবে।
রাস্তার অন্ধকার থেকে শুধু একপক্ষ দেখতে পাবে আলোর বৃত্তকে
গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে পার্ক সার্কাসের দিকে তাকালে সব অন্ধকার। সেদিক
থেকে একটি মোটরবাস এসে একঝুড়ি লোক নামিয়ে দিয়ে গেল। গ্রামদেশের
দিকে সব এক। মেঠোপথ, বাঁশবাগান নয়ানজুলি শশ্মসদনঘাট সব অন্ধকারে
ডুবে আছে”।
এই মফস্সলের গন্ধমাখা নগরজীবনে দুই বন্ধুর নিজেদের ফেলে আসা চন্ডীমন্ডপ এ চা খাওয়ার দৃশ্যের মতো অকিঞ্চিৎকরও কবিতার ভাষা পেয়ে যায়। রাজর্ষি সচেতনভাবে কবি ও চরিত্রদের বয়ানের ভাষা আলাদা রাখেন আর তা মারাত্মক সূক্ষ্মতায়।
তবু ক্ষিতীশ ও পারিজাত আসলে সমগ্রের একটা অংশমাত্র। কারন “কলকাতা হত্যালীলা” নামক ক্ষীনকলেবর পুস্তিকাটি যে বিপুল বিস্ফোরণসম্ভাবনা ধারণ করে আছে, যে রহস্য ও উন্মোচনের প্রত্যাশা তা পরবর্তী পাঁচ পাতার লেখাগুলোয় পাঠককে একেবারে পেড়ে ফেলে। একেকটা লাইন যেন একেকটা গল্পের ভ্রূণ, তবু গল্পের কাঠামোহীন।“ খররৌদ্রদিনে এমত আকৃতির প্রকোষ্ঠকে/ পিপাসা বলে”, অথবা
“তুমি লেখালেখির কাছে কিছু চাওনি।
লেখালেখির তো চাইবার অধিকার আছে; কাঁকন, নাকছাবি আর
পাঠকের ধৈর্য। যাচঞার অতিরেকে ভুলে যাওয়া যাওয়া উইদাগ”।
একটি অসম্ভব লেখা পাঁচ পাতার কবিতাটি---এর তূল্য কোনও লেখা ইদানিংকালে পড়েছি বলে মনে করতে পারছি না---
“রুইমাছের গোল হাঁ কাউকে চুমু খেতে চায়।
নিশীথ নীল শ্যাওলা গভীর জলের সচন্দন জঙ্ঘামধ্যে
বিবাহগৃহে উদাসীন পাত্রপক্ষ শুইয়ে দিয়ে গেছে”।
“কলকাতা হত্যালীলা” পাঠ একটি অভিজ্ঞতা। মাত্র দশ পাতার একটি বইয়ের পাঠ কতখানি সময়সাপেক্ষ ও মস্তিষ্কের খিদের আহার হতে পারে, তা বোঝার জন্য এই ভ্রমণে যেতেই হবে পাঠককে।
(নামকরণের পংক্তিটি বইয়ের শেষ লেখার অংশ)
কলকাতা হত্যালীলা
রাজর্ষি দাশ ভৌমিক
প্রকাশক—শুধু বিঘে দুই
প্রচ্ছদ---চিরঞ্জিৎ সামন্ত
মূল্য—৩৫ টাকা
মুগ্ধতা। বইটি সংগ্রহ করার ইচ্ছে রইল।
ReplyDeleteসাম্প্রতিক সময়ে কবিতার বই নিয়ে এতটা প্রাণখোলা লেখা পড়া হয়নি। খুব ভালো লাগলো।
ReplyDelete