আগের সংখ্যাগুলি

Sunday, April 14, 2019

সম্পাদকীয়




সাহিত্য সমালোচনা- এই শব্দটিকে যদি ভেঙে দেয়া হয়, তাহলে অবধারিতভাবেই দুটো শব্দ চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সাহিত্য ও সমালোচনা। সাহিত্যের সমালোচনা এবং সমালোচনার সাহিত্য দুটি পৃথক বস্তু বলেই আমার মনে হয়। পাশাপাশি এও মনে হয় জীবনানন্দের সমারূঢ় কবিতার সেই অধ্যাপকের মতো লিখনভঙ্গিমায় শেষ পর্যন্ত না হয় সাহিত্য না হয় সমালোচনা। সমালোচনার সাহিত্য বা সাহিত্যের সমালোচনার কথা দূরস্থান। তাহলে আমরা যেগুলো পড়ি সেগুলো কী? এককথায় শব্দের অপচয় এবং আপাতভাবে প্রাপ্ত জ্ঞানের বিস্ফোটক। দুঃখের বিষয় এই জ্ঞানের বিস্ফোটক এবং রসের অভাবে সমালোচনা সাহিত্য বাংলা থেকে লুপ্তপ্রায়। অনুগ্রহ করে রে রে করে তেড়ে আসবেন না!

এই যে দুটি ক্ষেত্র এলো, সাহিত্যের সমালোচনা এবং সমালোচনার সাহিত্য... এগুলো কী? প্রবন্ধ লিখতে বসেছি যখন তখন উদাহরণ দিয়েই বলা যাক। প্রথমে একটি রূপকে যাই। ধরুন, আপনি আম দেখলেন। হাতে নিলেন। তারপর আপনাকে জিজ্ঞেস করা হলো এই যে আম দেখছেন এটি দেখেই কী আপনার আম গাছ ভেসে এলো মনের মধ্যে? সত্যি কী আম দেখলে আমাদের মনে আম গাছ ভাসে না আম গাছ দেখলে আমাদের মনে আম উদয় হয়? আমার মনে হয় দ্বিতীয়টাই হয়। ম্যাঙ্গো জুস খেতে গেলে কিন্তু আমাদের মনে আমটাই ভাসে আগে। তাহলে আমগাছ সম্পর্কে কথা বলতে গেলে আমাকে তাকে বলা উচিত আমের গাছ। একে বলে সাহিত্যের সমালোচনা, যেখানে সাহিত্যের রসটাই প্রধান। যে সমালোচনায় বিশেষ কোনো সাহিত্যই প্রধান। অর্থাৎ সেই সমালোচনাটি লেখা হচ্ছে সেই বিশেষ লেখা বা লেখকের বিশেষ কোনো বই বা লেখা সম্পর্কে আলোচনা করার জন্য। এই ধরনের বেশিরভাগ লেখায় যেটি হয়, তাহলো, কোনো বিশেষ লেখা নিয়ে বিশেষ আলোচনা। সেই লেখাটির ছোট ছোট ক্লিপিংস। এর বেশি কিছু না। সেখানে সমালোচকের মনকে পাওয়া যায় না। একজন বস্নার্ব লেখক বা বিজ্ঞাপনের লেখকের থেকে তার কৃতিত্ব খুব বেশি কিছু না। তিনি যদি মনপ্রাণ দিয়ে লেখকের প্রশংসা করেন, তাহলেও না, যদি লেখককে গালমন্দ করেন, তাহলেও না। কারণ তার সমালোচনা থেকে কোনোকিছু সৃষ্টি হলো না। তার সমালোচনা সমালোচনাই থাকল। এখানে বিতর্কের বিষয়টি হলো-যে সমালোচনা বিশেষ এক লেখকের সৃষ্টিকে সম্পূর্ণভাবে তুলে ধরতে পারে, তা-ই আসল সমালোচনা। কারণ সেখানে সমালোচক নিজেকে সম্পূর্ণ বিযুক্ত রেখে লেখকের লেখা নিয়ে আলোচনা করে লেখাটিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। অর্থাৎ তিনি পাঠ্য থেকে বেরিয়ে নিজস্ব পাঠ দিয়ে ঢেকে দেননি সাহিত্যকে। অন্য কোনো পাঠ তৈরি হয়নি। খারাপ হোক, ভালো হোক, লেখকের লেখা সম্পর্কেই আলোচনা হয়েছে। কিন্তু আমার মতে এই ধরনের লেখা ক্ষণস্থায়ী। না আছে এর আগা না আছে গোড়া। না আছে প্রভাব, আছে শুধুই অভাব। কিন্তু কীসের অভাব? লেখক এবং পাঠকের মধ্যে যে যোগাযোগটি তৈরি হয়, তার মধ্যে থাকে লেখকের নিজস্ব অভিযাত্রার মধ্যে পাঠকের অভিযাত্রাও। যে কারণে পাঠকের পাঠ-ও সেই লেখাকে সমৃদ্ধ করে। সমালোচক যখন সেই পাঠকের পাঠকে লেখেন, অর্থাৎ নিজের অভিযাত্রাকে লেখেন, তখন সমালোচনা সেই পাঠককেও সমৃদ্ধ করে। কিন্তু সাহিত্যের সমালোচনায় এই পাঠ গুরুত্ব পায় না, বা কোথাও লুকিয়ে পড়ে।

উল্টো দিকে কোনো একটা লেখা বা কোনো একটা বই পড়ে পাঠকের নিজস্ব পাঠ যদি তাকে দিয়ে লিখেয়ে নেয় নিজস্ব অভিযাত্রার সংলাপ, তাহলে তা হয়ে ওঠে সমালোচনার সাহিত্য। কারণ সেখানে যেমন সেই পাঠ্য-এর পাঠ সেই পাঠকের মনে যে নিজস্ব অভিযাত্রার জন্ম দিল, তার ইতিবৃত্তান্ত। দুয়ে মিলে জন্ম নেয় সমালোচনা, যা সাহিত্য। সেখানে জ্ঞান থাকে না, রস ও জ্ঞানের এক পারস্পরিক ফিউশন থাকে। এ ধরনের লেখায় সেই পাঠ হয়ে ওঠে সময়ের কাছে এক বন্ধুর মতো সহবাসী। সমস্যার কথা হলো এই যে এই ধরনের লেখা এখনো পর্যন্ত আমাদের উপমহাদেশের সাহিত্যের সমালোচনা হিসেবে গণ্য নয়। কিন্তু যুগের পর যুগ ধরে ইন্টার-টেঙ্চুয়ালিটি এবং পাঠ্য-এর নিজস্ব আত্মীয়করণ-ই কোনো না কোনো বইকে, সৃষ্টিকে আরো নতুন নতুনভাবে আমাদের আবিষ্কার করতে শেখায়। আমাদের জীবনের মধ্যে বই বা সেই সাহিত্যটি ঢুকে যায়। আমাদের অবচেতনে সেই সাহিত্য তৈরি করে এক আবহমানতা।

যে সমালোচনা সাহিত্য এই আবহমানতা তৈরি করতে সক্ষম, সেই সমালোচনা সাহিত্য, সাহিত্যের পক্ষেও প্রয়োজনীয় এবং সমালোচনা নামক বিশেষ বিষয়টিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্যও দরকারি। কারণ ক্রমশ পৃথকভাবে কোনো না কোনো বিশেষ ব্যক্তির কোনো না কোনো সাহিত্য বা শিল্পকে সমালোচনা করার অধিকার ফুরিয়ে আসছে। যেভাবে পাঠ আমাদের কাছে যুগের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনশীল, সেভাবে তার সমালোচনাও পরিবর্তনশীল। তাহলে বিশেষ কোনো এক সময়ে কোনো এক সমালোচকের সমালোচনা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হবে কেন? সমালোচনা সাহিত্যকে পরিবর্তন কোনো এক জীবিত মাধ্যম না করে রাখলে এই মাধ্যম ক্রমশ আমাদের কাছে ক্ষণস্থায়ী।

সমালোচনার সাহিত্য বা সাহিত্যের সমালোচনা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও তার প্রথম জীবনে মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিয়ে যা লিখেছিলেন, পরবর্তীকালে তা ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্যের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি ও সাহিত্যিক তার প্রাচীন সাহিত্যে ইতিহাস থেকে আধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে লেখা পর্যন্ত অনেক লেখায় নিজের অনুভূতিমালার বিস্তার ঘটিয়েছেন এমনই মুন্সীয়ানায়, যে সেই সব লেখা হয়ে উঠেছে সমালোচনার সাহিত্য। রবীন্দ্র পরবর্তী সাহিত্যিকদের মধ্যে অমিয় চক্রবর্তী, সৈয়দ মুজতবা আলী, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশ গুপ্ত-এর কথাই মনে আসে এ প্রসঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ সমালোচনা সাহিত্যের যে প্রাণবন্ত ধারাটি তৈরি করেছিলেন তার সার্থক বাহক আমার মতে বুদ্ধদেব বসু, শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত।

রবীন্দ্রনাথের আলোচনার বিশ্বকে বুদ্ধদেব এগিয়ে নিয়ে গেলেন। রিলকে, হাইনে, বোদল্যের কবিতার অনুবাদের পাশাপাশি যে অনন্য ভূমিকা তিনি লিখতেন তা এক প্রকার সমালোচনা সাহিত্যই। কারণ সেই সব লেখাগুলোকে সেই সব কবিদের তিনি হাতে ধরে চিনিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাদের কবিতাই না, তাদের দর্শনবোধও আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে তার লেখালেখির মাধ্যমে। অথচ বোঝাই যায়, কোথাও তিনি ঐতিহ্যের কাছে অবনত যেমন নন, যেমন নন নিজের পাঠের প্রতি তীব্র বিশ্বস্ত, তেমনই তিনি নিজেকে সেই লেখাগুলোর মধ্যে মিশিয়ে দিতেও কখনো বাধা দেননি। তাই বুদ্ধদেব বসু বাঙালিদের হাতে ধরে আন্তর্জাতিকার আঙ্গিনায় নিয়ে গেলেন। পাশপাশি বুদ্ধদেব বসু ছিলেন বলেও কবিতা পত্রিকার হাত ধরে আমরা পেয়েছিলাম কবি জীবনানন্দ দাশকে। এই অসামান্য কবিকে বুদ্ধদেব বসু ছাড়া বাকি সকলেই আক্রমণ করতেন। কিন্তু বুদ্ধদেব তার সমালোচনায়, তার কবিতা পত্রিকায় বার বার কবি জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে এসেছেন। কোনো শক্তিমান কবিকে কেউ বুদ্ধদেব বসু বাংলা সাহিত্যকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কবি জীবনানন্দ দাশের প্রতিভাকে। এও সমালোচনা সাহিত্যের এক ইতিবাচক দিক। রবীন্দ্রনাথ তার প্রাচীন সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে যে কাজ শুরু করেছিলেন, বুদ্ধদেব তা-ই এগিয়ে নিয়ে গেলেন মেঘদূত, মহাভারতের কথা গ্রন্থগুলোতে। সমালোচনা যেখানে সাহিত্য, সেখানে বুদ্ধদেব বসু চিরকাল বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক ল্যান্ডমার্ক হিসেবেই থাকবেন। জীবনানন্দ দাশ, কবি হিসেবে যদিও, বুদ্ধদেব বসু ছাড়াও যে জীবনানন্দই থাকতেন, সে বিষয়ে আমাদের কারো সন্দেহ নেই। এমনকী, বুদ্ধদেব বসুর কাছ থেকে জীবনানন্দ দাশ যে কমফোর্ট জোন পেয়েছিলেন, তা তাঁর আদৌ দরকার ছিল কিনা, সে বিষয়ে অনেক মতপার্থক্য আছে। 

বুদ্ধদেব বসু সমালোচনা সাহিত্যে যে উচ্চতা নির্মাণ করে গেলেন অনেকটা তার-ই ওপর কাজ করলেন শঙ্খ ঘোষ এবং অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। অবশ্যই বুদ্ধদেবের পথে না। কারণ একটি উচ্চতা এক নির্দিষ্ট পথে অতিক্রম করে তার প্রাথমিক বাধাগুলোকে। কিন্তু সেই উচ্চতাকে এক নির্দিষ্ট পথে অতিক্রম করে তার প্রাথমিক বাধাগুলোকে। কিন্তু সেই উচ্চতাকে অনুবর্তন না করে অন্য পথে স্পর্শ করতে গেলে প্রয়োজন ছিল এমন এক অভিনিবেশের, যা নিজস্ব ভাষায় এক সাহিত্য হয়ে ওঠে। শঙ্খ ঘোষের সমালোচনা সাহিত্যে সেই ঐতিহ্যের বিস্তার রয়েছে। অন্যদিকে অলোকরঞ্জনের রয়েছে একাডেমিক ভাবনার সঙ্গে রসবোধের এক অনন্য ভাষা। শঙ্খ ঘোষ যেখানে কথা বলেন অনেকটা বন্ধুর মতো, সেখানে অলোকরঞ্জন নিয়ে যান এক অনাস্বাদিত পূর্ব প্রত্নের জগতে। এই দুই কবি ও প্রাবন্ধিকের সমালোচনা সাহিত্য তাই আজও বাংলা সাহিত্যের সপ্তসিদ্ধু ও দশদিগন্ত।

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের কথা এখানে বলা যায়, যিনি সমালোচনা সাহিত্যকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। কিন্তু  তাঁর তাঁর লেখা পড়ে অনেক সময়-ই লেখার গুণাগুণ বিচার করা যায় না। মনে হয় তাঁর লেখা বতাঁর নিজের গদ্যরীতির প্রতি একদেশদর্শী।  সাম্প্রতিককালে একমাত্র জয় গোস্বামীর গোষাইবাগান সমালোচনা সাহিত্যে ধারায় এক অভিনব সংযোজন। কারণ তার লক্ষ্য থাকে না শুধু সমালোচনা করার। তার লক্ষ্য থাকে পাঠের অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরার। এক্ষেত্রে কবি উৎপলকুমার বসুর কথা বলতেই হবে, বিশেষ করে তিনি যেভাবে একটি বিকল্প পাঠ করতেন এবং সমান্তরাল পাঠটিও সঙ্গে সঙ্গে দেখিয়ে দিতেন। 

লেখকের যখন মৃত্যু ঘটে যায়, তখন পাঠকের জন্ম হয়। আর পাঠক তাকে লেখেন। সমালোচক হলেন সেই পাঠক যিনি সেই লেখাকে আবার লিখছেন। নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে মিশিয়ে দিচ্ছেন পাঠের মধ্যে। লেখক হারিয়ে যাচ্ছেন না। আসলে তিনি আবিষ্কৃত হচ্ছেন। সমালোচনা সাহিত্যের কাজ এই আবিষ্কার-ই। এক সময় নিশ্চয় আসবে যখন সমালোচনা সাহিত্য এক স্বতন্ত্র সাহিত্য হিসেবেই তার সপ্তসিন্ধু ও দশদিগন্ত উন্মোচন করবে আমাদের কাছে।

তবে, যাই হোক, আসল কথা হল পড়া। তবে, সে কি আর কেউ আলোচনা করার জন্য করে? পড়া একপ্রকার সহবাস। সকলের সঙ্গে তো আর সকলের সহবাস হয় না। 

নতুন বছরে সকলকে শুভেচ্ছা জানাই। বাংলায় সহিষ্ণুতা আসুক। এবং সরাসরি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, এই ভারতবর্ষ যারা চালাচ্ছে এখন, তাদের দিন অবসান হোক। মুছে দিন ফ্যাসিস্ট ও সাম্প্রদায়িক শক্তিকে। এরা থাকলে কিন্তু আমি আপনি আমাদের ভাবনা কিছুই বাঁচবে না। সঠিক অবস্থান নেওয়া এখন জরুরি। 


সম্পাদনা- বেবী সাউ হিন্দোল ভট্টাচার্য সন্দীপন চক্রবর্তী মণিশংকর বিশ্বাস শমীক ঘোষ 
যোগাযোগ- abahaman.magazine@gmail.com

“শিকড়ে এত মধু ধরেছিলাম যে একটি আর্তকে নিশ্চিন্দি দিতে পারে” অনিন্দিতা গুপ্ত রায়







ক্ষিতীশ পারিজাত পারিজাত ও ক্ষিতীশ এবং রাজর্ষিএবং আমি, আপনি, আমরা, সাধারণ পাঠকেরা তো এইভাবে পাঠ শুরু হয় বা একটা চলচ্ছবির  পর্দা ওঠে আর দর্শকাসনে নিজেদের দেখি এক ভাষ্যকারের গলা ভেসে আসে দুটি চরিত্র আর দু তিনটে সময়কালে এগিয়ে পিছিয়ে কিছু মন্তাজ  চরিত্র দুটি নাগরিক জীবনে ঢুকে পড়ে বেঁচে থাকার লড়াইয়ের ভাঁজে যা কিছু করে, বলে, ভাবে অথবা স্রেফ কিছুই না করে অনেকগুলো সম্ভাবনার জন্ম দিয়ে অথবা না দিয়ে থেকে যায়---সেই হওয়া না-হওয়াগুলো খুব রোগা আয়তনের দুমলাটের পাঁচটি পাতার মধ্যে নিজেদের এত মুনসিয়ানায় আঁটিয়ে নিয়ে একটা দীর্ঘ লেখা হয়ে ওঠে যাকে কোনো জঁর এ বাঁধতে জাস্ট ইচ্ছেই করতে পারে নাকলকাতা হত্যালীলাহাতে নিলে পাঠকের প্রত্যাশা মলাট ওল্টালে শেষ পৃষ্ঠা অব্ধি তাকে টানবেই রাজর্ষির লেখার ঘরানার সঙ্গে অল্পবিস্তর পরিচিতির সুবাদে নামকরণ দেখে যে মৃদু প্রশ্রয়ের হাসি এই পাঠকের অজান্তেই ঠোঁটের কোনে এসেছিল প্রথম পাতাতেই তাতে মুগ্ধতার বিচ্ছুরণ চলে এল শুরু হচ্ছে খুব নিস্পৃহ অথচ ভয়ানক সচেতন একটা ন্যারেটিভের মধ্যে দিয়ে যেন নাটক মঞ্চস্থ করার আগে খুঁটিনাটি বলে দেওয়া হল ক্ষিতীশএকটা সময়ের মুখ পুরনো, খুব চেনা তাইই প্রাসঙ্গিক

সাধারণের যা ধর্ম  ক্ষিতীশের ধর্ম কিন্তু তা নয়……
পারিজাত অনেক খেটেখুটে বুঝেছে ক্ষিতীশের ধর্মের স্বভাবটা ভিন্ন……
ক্ষিতীশের ধর্ম প্রকৃতি-প্রত্যয়ের মতোই জটিল, জলের মতোই বহতা
হিন্দু পদবী তাকে বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের উপমার মতো
উষ্ণ রেখেছে, যেন বর্ণহিন্দুত্বের খাঁজে খাঁজে ক্ষিতীশ মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ হয়ে পড়েছে
ক্ষিতীশ সেই প্রতিটা ধর্মে মন দেয়, প্রতিটি উত্তল-অবতল তার প্রনম্য
লক্ষ্য করলে বোঝা যায় সে কম্যুনিস্ট না, বাপ-দাদার মতো কংগ্রেসি নয়
ছোটো-বড়ো ঘটনাগুলি যে ধর্মবিবিক্ত নয় একথা যখন একটা গোটা দেশ
ভুলতে বসেছে, মায় পারিজাত; ক্ষিতীশ সিন্ডিকেট ভেঙে যাওয়ার খবরে
কাচা লুঙ্গি পরে যুগান্তরের উপরে চপচপে মুড়ি মাখে

প্রথম লেখাটির এই পংক্তিগুলো বিচ্ছিন্নভাবে উদ্ধৃত করতে হল শুধু রাজর্ষির ভাষা ও লেখার চলনের কোনও ব্যাখ্যা দিয়েই বোধগম্য করা সম্ভব না বলেই এমন এক সময়ের ভাষ্য এ, যখন পাতালরেলের মাটি কাটা শুরু হয় নি অথচ বাতাসে ক্ষয়ের জীবানু, ক্ষয়রোগেরও আর কাশির দমক মধ্যরাতে গাড়লের মতো চমকে মনে আনে অন্য এক অনুষঙ্গে মহানগরের নিষ্ঠুর  ট্রামলাইন বন্ধ দরজার এপার ওপারে দুই বন্ধু নাকি দুই সখার এক মধুর জীবনযাপন যাকে বহু মাত্রায় ব্যাখ্যার লোভ সংবরণ করা দায়

মাদুরের শেষ অবধি পা ছড়িয়ে ক্ষিতীশ বলে---
বে করব ভাবছি
সত্যি? পারিজাতের সিগারেট দিনশেষে জ্বলে ওঠে
ক্ষিতীশ চাপা গলায় বলেবউদি বুঝি জেগে গেল
শুয়ে পড়ো, যাও

রাজর্ষির লেখার সবচেয়ে ধাক্কা দেওয়া যে বিষয় তা হলো কোনও দশকএর লক্ষ্মন আক্রান্ত চলন থেকে তিনি একেবারে মুক্ত অসামান্য গদ্যকারও তিনি বটে, কিন্তু সচেতন প্রয়াসও নেই এই দুইয়ের মধ্যবর্তী কোনও সূক্ষ্ম বিভাজনের বরং পাঠককে হতবুদ্ধি করে দিতেই পছন্দ করেন তিনি তাঁর সমসাময়িক আর কোনও কবির লেখায় পেয়েছি কি এমন অনুষঙ্গ---

আজ থেকে কুড়ি বছর পরে হয়তো আরো কাছাকাছি ল্যাম্পপোস্ট বসানো হবে
রাস্তার অন্ধকার থেকে শুধু একপক্ষ দেখতে পাবে আলোর বৃত্তকে
গড়িয়াহাটের মোড়ে দাঁড়িয়ে পার্ক সার্কাসের দিকে তাকালে সব অন্ধকার সেদিক
থেকে একটি মোটরবাস এসে একঝুড়ি লোক নামিয়ে দিয়ে গেল গ্রামদেশের
দিকে সব এক মেঠোপথ, বাঁশবাগান নয়ানজুলি শশ্মসদনঘাট সব অন্ধকারে
ডুবে আছে

এই মফস্সলের গন্ধমাখা নগরজীবনে দুই বন্ধুর নিজেদের ফেলে আসা চন্ডীমন্ডপ চা খাওয়ার দৃশ্যের মতো অকিঞ্চিৎকরও কবিতার ভাষা পেয়ে যায় রাজর্ষি সচেতনভাবে কবি চরিত্রদের বয়ানের ভাষা আলাদা রাখেন আর তা মারাত্মক সূক্ষ্মতায়

তবু ক্ষিতীশ পারিজাত আসলে সমগ্রের একটা অংশমাত্র কারন কলকাতা হত্যালীলানামক ক্ষীনকলেবর পুস্তিকাটি যে বিপুল বিস্ফোরণসম্ভাবনা ধারণ করে আছে, যে রহস্য উন্মোচনের প্রত্যাশা তা পরবর্তী পাঁচ পাতার লেখাগুলোয় পাঠককে একেবারে পেড়ে ফেলে একেকটা লাইন যেন একেকটা গল্পের ভ্রূণ, তবু গল্পের কাঠামোহীনখররৌদ্রদিনে এমত আকৃতির প্রকোষ্ঠকে/ পিপাসা বলে”, অথবা

তুমি লেখালেখির কাছে কিছু চাওনি
লেখালেখির তো চাইবার অধিকার আছে; কাঁকন, নাকছাবি আর
পাঠকের ধৈর্য যাচঞার অতিরেকে ভুলে যাওয়া যাওয়া উইদাগ 
একটি অসম্ভব লেখা পাঁচ পাতার কবিতাটি---এর তূল্য কোনও লেখা ইদানিংকালে পড়েছি বলে মনে করতে পারছি না---
রুইমাছের গোল হাঁ কাউকে চুমু খেতে চায়
নিশীথ নীল শ্যাওলা গভীর জলের সচন্দন জঙ্ঘামধ্যে
বিবাহগৃহে উদাসীন পাত্রপক্ষ শুইয়ে দিয়ে গেছে  

কলকাতা হত্যালীলা পাঠ একটি অভিজ্ঞতা মাত্র দশ পাতার একটি বইয়ের পাঠ কতখানি সময়সাপেক্ষ মস্তিষ্কের খিদের আহার হতে পারে, তা বোঝার জন্য এই ভ্রমণে যেতেই হবে পাঠককে
(নামকরণের পংক্তিটি বইয়ের শেষ লেখার অংশ)
কলকাতা হত্যালীলা
রাজর্ষি দাশ ভৌমিক
প্রকাশকশুধু বিঘে দুই
প্রচ্ছদ---চিরঞ্জিৎ সামন্ত
মূল্য৩৫ টাকা